নদী বাঁচলেই বাঁচবে বাংলাদেশ

নদী বাঁচলেই বাঁচবে বাংলাদেশ

মোজাহেদুর ইসলাম ইমন


নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদী ও বাংলাদেশ একই সূতোয় গাঁথা দুটি নাম। এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশে সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নদীগুলো। বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ,যার সৃষ্টি নদীবাহিত পলি জমাট বেঁধে। পদ্মা,মেঘনা,যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। এসব নদ-নদী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৈচিত্র্য দান করেছে। বলতে গেলে এ নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। সে জন্যই নদীর সাথে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান।

সহস্র সহস্র বছর ধরে বাঙালির জীবন-সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে নদীই প্রধান ভূমিকা পালন করে গেছে। বাঙালির জীবন কেটেছে নদীর জলে স্নান করে-সাঁতার কেটে,বাঙালির গ্রাম-গঞ্জগুলো গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে পাড়ে। বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে নদীকে নির্ভর করে। তাই বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য নদী।

পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে পানিই সবচেয়ে আদি ও অফুরান। কারণ প্রতি বছর প্রাকৃতিক চক্রে পানি সাগর থেকে বাষ্পীভূত হয়ে বৃষ্টির আকারে ভূমিতে পতিত হয় এবং নদীতে প্রবাহিত হয়ে আবার সাগরে যায়। ক্রমবর্ধমান মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জীব ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। একসময় আমাদের ছিলো প্রায় দেড় হাজার নদী। নদীগুলো ছিলো প্রশস্ত,গভীর ও পানিতে টইটম্বুর,বর্ষাকালে প্রমত্তা। আজ মোট নদী সংখ্যা সর্ব সাকুল্যে ২৩০।

আমাদের দেশে সীমান্ত অতিক্রান্ত নদী সংখ্যা ৫৭টি, যার ৫৪টি ভারত এবং ৩টি মায়ানমারের সাথে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিগত একদশক থেকে বর্তমান নদী সমূহের মধ্যে ১৭টি নদী একেবারই নদীর চরিত্র হারিয়ে,শুকিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। আরো ৮টি নদী বিপর্যস্ত ও মৃত্যুমুখী। এর মধ্যে যদি ভারতীয় আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প চালু হয় তবে আমাদের নদীগুলোতে প্রায় ৪০% ভাগ পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে। আর ১৫-২০% হ্রাস পেলেই আরো ১০০ টি নদীর সাংবৎসরিক নব্যতা বিনষ্ট হয়ে যাবে।

সুপেয় পানি মানুষের মৌলিক অধিকার,বেঁচে থাকার জন্য জন্মগত অধিকার। আমাদের নদীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রবাহের ওপর আমাদের জনবসতি,কৃষি,অর্থনীতি এবং যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই নদীতে পানির প্রবাহ থাকাটা আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার প্রতিনিয়ত আমাদের কাছ থেকে হরণ করা হচ্ছে।

প্রথমত, উজানে অবস্থিত ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিয়ে তাদের সেচ প্রকল্পে এবং নৌপথ সচল রাখার কাজে ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, খরার সময় অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর প্রবাহের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে সেচকাজে লাগানো হচ্ছে। তৃতীয়ত, নদীর হাঁটুজল প্রবাহের উৎস বিল ও জলাশয়গুলোকে অতি নিষ্কাশন করে চাষের আওতায় আনা হয়েছে। চতুর্থত, সারা দেশে অগভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের জন্য পানি অতি উত্তোলন করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে ফেলা হয়েছে। পঞ্চমত, নদীগুলোর পাড়ের খাসজমি দখল করে ভরাট করে বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ষষ্ঠত, পরিবেশ বির্পযয়ের নদীগুলো বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সপ্তমত,নদী-খাল ও জলাভূমিতে শিল্পবর্জ্য,পলিথিন,প্লাস্টিকের মতো কঠিন বর্জ্য ফেলে ভরাট করাও চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে নদী ব্যবস্থাপনা বা সংরক্ষণ বিষয়ে কারোই কোনো মাথাব্যথা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ভূমি মন্ত্রণালয় যেহেতু জমিজমার রেকর্ড রাখে ও খাসজমি বিলিবণ্টনের দায়িত্বপ্রাপ্ত,সেহেতু এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিভূ হিসেবে ডেপুটি কমিশনাররা বিনা দ্বিধায় নদী-নালা ও জলাভূমি লিজ দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নদী দখল রোধ এবং বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণের জন্যেও দায়বদ্ধ হতে হবে। নদীতে অবাধে পয়ঃ ও শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এ কারণে প্রতিটি শহর ও বন্দরের আশপাশের নদী চরমভাবে দূষিত হচ্ছে।

দূষণমুক্ত,পানি বিশুদ্ধ আর পাড় দখলমুক্ত।এমন নদী এখন বাংলাদেশে বিরল। অস্তিত্বহীনতায় ভুগছে বেশির ভাগ নদ-নদী। নদী রক্ষায় নামা বিভিন্ন আন্দোলনও মুখথুবড়ে পড়ছে। ‘নদীর পাড় নদীকে ফিরিয়ে দাও’ এই শ্লোগান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আন্দোলন করলেও কিছু হচ্ছে না। প্রভাবশালীরা নদীগুলোর টুঁটি চেপে ধরে আছে। বাংলাদেশে নদীর ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করার বিষয়ে অনেক আইন থাকলেও প্রয়োগের বেলায় জনপ্রতিনিধিদের রয়েছে অনীহা এবং আইনের সীমাবদ্ধতা,দুর্বলতা ও ফাঁকফোকরগুলো জনসেবকদের দায়িত্ব পালনে বাঁধাও হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়।

নদী বাঁচাতে আমরা যতই বুলি দেই, এর প্রতিকার করতে হবে রাজনীতিবিদদের ‼

লেখকঃ সাধারণ সম্পাদক,গ্রীন ভয়েস
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment