নৈতিকতার বুনিয়াদি শিক্ষা: পরিবার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা

নৈতিকতার বুনিয়াদি শিক্ষা: পরিবার এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা

ডঃ শেখ মাহাতাবউদ্দিন


কালের আবর্তে দুর্নীতির খবর এখন প্রতিদিনের তিন বেলার খাবারের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি যারা করছে কিংবা করতে সাহায্য করছে তারা সকলেই এই দেশের নাগরিক এবং হয়ত আমার আপনার মতই মানুষ কিংবা আমাদের কাছের কেউ।

নৈতিকতার এবং সৎভাবে জীবন যাপনে এই যে অনীহা, এটা কি এক দিনের ফসল নাকি আমাদের সম্মিলিত অবহেলা এবং বহু বছরের জমানো জঞ্জাল? একটি জাতির প্রতিটি পেশাই সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐ সকল পেশাতে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের নৈতিকতার এবং সততার প্রতিচ্ছবিই হল একটি জাতির বর্তমানের অবস্থা ও অবস্থান। এই পেশা গুলোর মধ্যে অন্যতম এক পেশা যা প্রায় প্রতিটি পেশাকে প্রভাবিত করতে পারে তা হল শিক্ষকতা।

একটি সমাজের শিক্ষক এবং চিকিৎসক যখন দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পরে তখন ধরে নিবে ঐ সমাজ অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে, এটি একজন মনীষীর বানী। গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে একটি জাতির প্রায় সকল পেশার ব্যক্তিবর্গ জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় পারিবারিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ব্যয় করেন। সে অর্থে একজন ডাক্তারকেও তাঁর জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আসতে হয়। অর্থাৎ একটি দেশের জনগনের মধ্যে নৈতিকতার এবং সততার পূর্ণ বিকাশ কেবল দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সম্ভব আর তা হল পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আবার এই দুইটি প্রতিষ্ঠান একে অপরের পরিপুরক, একটির অভাব কিছুটা হলেও অন্যটি দিয়ে পূরণ করা সম্ভব (শুধুমাত্র নৈতিকতা এবং সততা শিক্ষার অর্থে বুঝানো হয়েছে)। কিন্তু এই দুই সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সমসাময়িক ব্যর্থতা একটি জাতির জন্য ভয়াবহ পরিনাম ডেকে আনে। আর্থসামাজিক এবং অনুকরণীয় নগরায়ন আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ এবং দর্শনকে বিঘ্নিত করছে একথা আমরা সকলেই এক বাক্যে মেনে নিব।

এই নগরায়নের প্রভাব কাটিয়ে প্রতিটি শিশুকে সঠিক নৈতিকতার শিক্ষা দেয়ার কথা ছিল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে। কিন্তু সেখানেও আমরা পরিকল্পনা করতে পারিনি কিংবা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করতে ব্যর্থ হয়েছি। যদি ব্যর্থই না হতাম তাহলে প্রতিটি সেক্টরে এমন নিত্য নতুন পদ্ধতিতে চুরি, রাষ্ট্রের অর্থ লুণ্ঠনের শৈল্পিক নিদর্শনের সংবাদ দেখতে হত না।

উন্নত বিশ্বের দিকে যদি তাকাই, তারা সন্তানদের মূল নৈতিকতার শিক্ষাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়েই দিয়ে দেয়। আমাদের পরিণত বয়সেও সামান্য লাইনে দাঁড়ানোটাকে সহ্য করতে পারি না অথচ জাপানি বাচ্চাদের এই লাইনে দাঁড়ানো শেখানো হয় যখন তাদের বয়স ২-৩ বছর। এর পরে প্রায় ৪-৫ বছর পর্যন্ত তারা শুধু নীতি এবং নৈতিকতা শিখে!

অথচ আমেরিকা ফেরত আমার মেয়েদের (বয়স ৬.৫) মহাম্মদপুরের নামকরা একটি স্কুলে কেজি শ্রেণীতে ভর্তি করার পরে দেখলাম ওদের আসলে প্রথম শ্রেণীর বই পড়ানো হয়! কারন জানতে চাইলে জানতে পারলাম, প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় শ্রেণীর এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে উনারা তৃতীয় শ্রেণীর বই পড়ান! এই কারনেই নাকি উনাদের এত নাম যশ! আশ্চর্যের বিষয় হল উনার কাছে নাকি আমার পূর্বে কোন গার্ডিয়ান এমন ‘অলীক’ বিষয়ে কথা বলতেই আসেন নাই।

অর্থাৎ আমরা গার্ডিয়ানরাও এমন আজগুবি প্রেসারকেই ধরে নিচ্ছি স্কুলের সফলতা হিসেবে! জাপানে একটি প্রাক বা প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়া খুবই কঠিন কাজ, স্নাতকে বা স্নাতকোত্তর এর সাথে নির্দিষ্ট কিছু সার্টিফিকেট অর্জন না করতে পারলে তাদের অমন ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর অনুমতি নাই! অর্থাৎ কেউ চাইলে কলেজ বা হাইস্কুলের শিক্ষক হতে পারবে কিন্তু প্রাথমিক স্কুলের না। কিন্তু ঐ লেভেলে আমাদের নীতি কি ছিল? কিছুদিন আগেও শুধুমাত্র এস এস সি পাশ করেলেই আমরা প্রাথমিকের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি!

একজন শিক্ষার্থীর মননশিলতার কিংবা সৃজনশীলতার কতটুকুন অংশ এই লেভেলের শিক্ষা দ্বারা উজ্জীবিত করা সম্ভব? যে শিক্ষক নিজেই পরিপক্ক নন সেই শিক্ষক কিভাবে তাঁর শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ সততা এবং নৈতিকতার সবক দিবেন?

এখন প্রশ্ন আসে প্রাথমিকে না হয় শিক্ষার্থী কিছুটা ছাড় পেয়ে আসল কিন্তু মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছাড় পেল কিভাবে? আমাদের চারপাশে বিগত ১০ বছরে শিক্ষকতা পেশাতে কারা নিয়োগ পেয়েছে কিংবা নিয়োজিত হচ্ছে তা খেয়াল করেলেই উত্তর পেয়ে যাব। অনেকেই ‘যার নাই কোন গতি সে করে পণ্ডিতির’ মত এক অবিবেচক কথার পূর্ণ উদাহরণ হয়ে নিজেদের এই পেশাতে নিয়ে এসেছে। ফলে এরা শিক্ষকতাকে শুধুমাত্র মাসের শেষে বেতন প্রাপ্তির একটি মাধ্যম হিসেবেই দেখছে। শিক্ষক হিসেবে সমাজের কিংবা দেশের প্রতি যে দায়িত্বশীলতা তা এই সকল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে খুঁজে পাবার আশা করাই দিনে দিনে অন্যায় হয়ে পরছে। শিক্ষকতা পেশাতে থেকেই এরা জড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অপরাধ কিংবা নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে! উপরন্তু, নিজেদের শিক্ষকতাকেই শিক্ষকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উক্ত প্রতিষ্ঠানের যে কজনা ভালো শিক্ষক আছেন তাদের তাড়াতেও এদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না।

ফলাফল, শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে সৎ এবং মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন শিক্ষকের সংস্পর্শে আশার সম্ভাবনা থেকে। অপরদিকে বিশ্বের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ডিগ্রী অর্থাৎ পিএইচ ডি তে অর্জন দেখছে। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও বিশ্বের প্রথম সারির ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটি থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রী থাকলে ঐ ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিচ্ছে! অথচ আমাদের দেশে এস এস সি কিংবা এইচ এস সি পরীক্ষাতে ৪.০০ বা কোন কোন ক্ষেত্রে ৪.৫ না থাকলে আপনার হার্ভার্ড কিংবা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি ডিগ্রিও কোন কাজে দিবে না। তবে যদি এস এস সি কিংবা এইচ এস সি এর ফলাফল ঠিক থাকে তবে অনালাইন পিএইচ ডিও অনেক মুল্যবান এবং আপনি যে পদের জন্য হার্ভার্ড কিংবা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি ডিগ্রিধারী আবেদনই করতে পারল না সেই পদে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইলে এবং সঠিক রঙ ধারণ করতে পারলে নিয়োগ পেয়ে যাবেন এটা কিন্তু নিশ্চিত!

প্রাথমিকের সর্বনাশে আমাদের নিরব দর্শকের ভুমিকা দেশকে কিভাবে নিম্নগামী করছে তা আমরা এখন অবলোকন করছি। বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের এই দূরদর্শিতা পরিহারকৃত নিয়োগ ব্যবস্থা আমাদের কোন পাতাল পুরীতে নিয়ে ঠেকাবে তা কি আমরা কল্পনা করছি? যদি করে থাকি তাহলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিক এবং গবেষণা পাগল শিক্ষক নিয়োগ প্রদানের কোন বিকল্প রয়েছে কি আমাদের হাতে? ইতোমধ্যেই যে পরিমাণ জঞ্জাল নিয়োগ দিয়ে ফেলা হয়েছে সেগুলোকেও তো এই জাতি আগামী ৩০-৩৫ বছর বেতন দিয়ে লালন পালন করতে হবে, এদের থেকে নুন্যতম সাপোর্ট পেতে হলেও তো অন্তত সমপরিমাণ যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ দিতে হবে, তাই নয় কি?

পরিশেষে বলব, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নৈতিকতা এবং মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষকের ব্যাবস্থা করাই আমাদের শিক্ষা খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতীয়মান হওয়া বাঞ্ছনীয়। যা আমাদের একঝাক সৎ এবং নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সহযোগিতা করবে। অন্যথা হলে, অনর্থ যা হচ্ছে তা অদূর ভবিষ্যতে যে বহুমাত্রিকতা পাবে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সমস্যা আমরা সকলেই জানি সমাধানও অনেক ক্ষেত্রেই জানা, শুধু দরকার হল ঐ সকল সমস্যা সমাধানের আগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা।

এটা করতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং অনাগত সন্তানদের জন্য একটি সত্যিকারের সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা উপহার দেবার জন্যই। তা না হলে আমাদের অগ্রজ প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাগণের যে স্বপ্নের সাম্যের বাঙলার জন্য আত্মাহুতি তা অধরাই রয়ে যাবে।

লেখক: ডঃ শেখ মাহাতাবউদ্দিন
সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি এবং খাদ্য প্রকৌশল বিভাগ (এন এফ ই), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *