পথশিশুদের শিক্ষায় আমাদের করণীয়

ইসরাত জাহান ইতি


শিশু পথে জন্মানোর কারনে সে পথশিশু হয় না বরং এ সমাজ তাদেরকে পথশিশু বানায়। পথশিশু হল সেইসব শিশু যারা দারিদ্র্য বা গৃহহীনতার কারণে শহর, নগর বা গ্রামের রাস্তায় বসবাস করে। তাছাড়া বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা মা মারা যাওয়ায়, গ্রামে দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়া, গ্রাম থেকে শহরে চলে আসা কাজের খোঁজে বা বাবা মায়ের অসচেতনতার কারনে অনেক শিশু ঢাকায় এসে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এদিকে অর্থ লোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর কারনেও এখন কিছু শিশুরা পথে দিন কাটায়। বাংলাদেশে লাখ লাখ পথশিশুদের নিরাপদ থাকার স্থানের যেমন অভাব রয়েছে তেমনি রয়েছে অপরাধে জড়িয়ে পরার ব্যাপক সম্ভাবনা।

জাতিসংঘ শিশু সনদে বর্ণিত ঘোষণা অনুযায়ী ১৮ বয়সের কম বয়সী সকলকেই শিশু বলে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগই শিশু। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার পথশিশু রয়েছে।

রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক ও খোলা আকাশের নিচে তাদের বাস। এই পথশিশুদের বড় অংশই রয়েছে রাজধানী ঢাকায় ৷ এদের বয়স ৬ থেকে ১৮ বছরের নীচে ৷ বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ নেই৷ কেউ বলেন ২০ লাখ৷ আবার কেউ বলেন ২৫ লাখ৷ ঢাকা শহরে আছে কমপক্ষে ৬-৭ লাখ ৷ তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে৷

সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না৷

ঢাকা শহরের দুইটি জায়গায় পথশিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশী, কাওরান বাজার ও কমলাপুর । কার্যক্রম পরিচালক ড. আবুল হোসেন একটি প্রেজেন্টেশনে বলেন কমলাপুরের পথশিশুদের প্রায় ৫৩ শতাংশ ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী এবং প্রায় ৮৩ শতাংশ পথশিশু তারা তাদের খাবার নিজেরাই সংগ্রহ করে। তাদের ৬০ শতাংশ মাদক নেয় এবং প্রায় ৮০ শতাংশ পথশিশু যথাযথভাবে টয়লেট ব্যবস্থা নেয় না। তার ওপর শারীরিক, অর্থনৈতিক, যৌন নির্যাতন, মাদক এবং নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিশুদের জাড়ানো হচ্ছে ৷ ফলে সার্বিকভাবেই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে পথশিশুরা ।

সম্প্রতি আরো এক গবেষণায় দেখা যায়- দেশে প্রায় ৮০ লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে ১০ লাখেরও বেশি। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনো মাদক সেবন করে। বিবিএস এর তথ্য মতে শিশুরা বড়দের মত কাজ করে ৮৫ শতাংশ , স্কুলে যায় না ২৪ লাখ শিশু, মজুরি পায় না ১৬ লাখ শিশু, পরিবারকে সহায়তা দিতে কাজ করে ৩০ শতাংশ শিশু, কৃষি ও কল কারখানায় কাজ করে ৬৫ শতাংশ শিশু।

শিক্ষা সবার জন্মগত মৌলিক অধিকার । অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এ দেশের অনেক ছিন্নমূল শিশুরা । একটি শিশুকে স্কুলে আসতে গেলে তাকে তো পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে ও পেট ভরে খেয়ে আসতে হবে ৷ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষায় পথশিশুদের অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না, যদি না তাদের অন্যান্য চাহিদাগুলো পূরণ করা যায় ৷ শিশুর ভিতরে স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে হবে ৷ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটি ভালো জায়গায় তৈরি করতে হবে । প্রতিটি শিশুর মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা।

তেমনিভাবে সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের ভেতরও রয়েছে আলাদা একটি জগৎ। তাদের চিন্তাধারাও আলাদা আলাদা। একটু সহযোগিতা, সহানুভূতি আর একটু ভালোবাসায় বদলে দিতে পারে তাদের জীবন। এই শিশুদের মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যতের কত কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ইত্যাদি ।

শিশুদেরকে আমরা কাজে না এনে স্কুলে দিতে পারি ৷ আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে অবশ্যই পথশিশুদের মৌলিক অধিকার সুযোগ গুলো পূরণ করতে হবে। শিক্ষার আলোয় পথশিশুরা আলোকিত হলেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তারা অংশগ্রহণ করতে পারবে। কেবল শিক্ষাই পারে দেশকে দারিদ্র মুক্ত করতে। শিক্ষাই জাতীয় ও সামাজিক সমস্যা গুলোর স্থায়ী সমাধান করতে পারে।

পথশিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমাদের দেশের বেশীর ভাগ লোকই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। বেঁচে থাকার আহার টুকু কখনো রোজগার করতে না পারলে ওরাই পেটের জ্বালায় বেছে নেয় চুরি, ডাকাতিসহ নানা সামাজিক অপরাধমূলক কাজ। অনেক কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ কাজে কারখানার মালিকেরা শিশুদের অল্প টাকার বিনিময়ে কাজ করায়। এতে অকালেই অনেক শিশুরা ঝরে পড়ে।

এসব শিশুরা যদি শিক্ষার সুযোগ পায় তাহলে তারা ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে অবগত থাকবে। তাই এসব ছিন্নমূল টোকাই-পিচ্চিদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ওদের মেধা ও শ্রমের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটিয়ে দেশের সম্পদে পরিণত করতে হবে।

এসব অধিকার বঞ্চিত শিশুকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। ভিক্ষা নয়, দেশের উৎপাদনের বড় একটি অংশের যোগান দেয়া যেতে পারে ওদের দ্বারাই। উন্নত দেশে দেখা যায় যে, শিশুর সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। তেমনি আমাদের দেশের অবহেলিত শিশুদের সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলে সমাজে আর কোন অরাজকতার সৃস্টি হবে না।

শিক্ষা বঞ্চিত সমাজ সভ্যতা তিমিরে নিমজ্জিত । শিক্ষা, বিনোদনসহ এবং সকলের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা সমাজ ও রাষ্ট্র দায়িত্ব । দেশের এসব সমস্যার প্রেক্ষিতে তাদেরকে হাতের কাজ শিখানো, কারিগরী শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকল্প নেই। শিশুদের নৈতিকতা শিক্ষাও দিতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ না থাকলে মানুষের জীবন বিপথে পরিচালিত হয়।

উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তারা যেন আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। বিভন্ন সরকারী সুযোগ সুবিধা তাদেরকে করে দিতে হবে। তাদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষা ও শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে। শিশুদেরকে শিক্ষা দানের জন্য ‍বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পথ শিশুকে বাদ দিয়ে জাতি বা দেশ কখনো নিরক্ষরতা, উন্নতি, এবং আধুনিকায়নে স্বাক্ষর রাখতে পারবে না ।

অসহায় পথশিশু যাদের ক্ষুধার জন নেই একমুঠো খাবার, মায়ের হাতের পিঠাপুলি সেতো স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নেই দেহ ঢাকার এক টুকরো কাপড়, তার কাছে শীত মানেই বিভীষিকা । বাসস্থান হলো খোলা আকাশ, রাত মানেই তার কাছে দুঃস্বপ্ন । শিক্ষাতো তাদের কাছে শুধুই বিলাসিতা । আর চিকিৎসা সেতো সরকারি হাসপাতালের অবহেলা।


ক্ষুধা যেন আজ সুকান্ত ভট্টাচার্য এর কবিতার মত

“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ।”


লেখকঃ শিশু সাহিত্যিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *