পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ইতিকথা | পর্ব ১

সজীবুর রহমান


পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কারণ আমদের দেশে অর্থনীতিতে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে বাণিজ্য, কারখানা এবং উৎপাদনের উপকরণ সমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার ইতিহাস জানতে গেলে শুরু করতে হবে সেই আদিম সমাজ ব্যবস্থা থেকে।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটটা এসেছে কয়েকটি ধাপ পার করে। ধাপগুলো হলো আদিম সাম্যবাদ সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ তারপর পুঁজিবাদী সমাজ। মূলত বণিক শ্রেণীর হাত ধরেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পথ চলা শুরু। সর্বপ্রথম এর আবির্ভাব হয়েছিল ইউরোপে। ১৭৮৯সালে ফরাসি বিপ্লবের ভেতরেই ইউরোপে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হয়েছিল। বুর্জোয়া শব্দটি এসেছে “বারগস” থেকে যার মানে হচ্ছে বণিক।

তাহলে মানব ইতিহাসের প্রথম থেকে শুরু করা যাক। মূলত একটি সমাজের গর্ভ থেকে আরেকটি সমাজের জন্ম হয়। শ্রম হচ্ছে মানুষের অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। মানুষ তার বুদ্ধি ফলে বিভিন্ন উন্নতি সাধন করেছে, এটা কিন্তু তার শ্রমেরই ফল।

মানুষের অগ্রযাত্রার পেছনে দুইটি জিনিস রয়েছে শ্রমশক্তি এবং উৎপাদন শক্তি। মানুষের জীবনধারা ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে এই দুটো জিনিস।

আমরা যদি আদিম মানুষের কথা চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখতে পারবো মানুষের সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন কিভাবে আসলো।

আদিম মানুষের জীবনের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের সবারই ধারণা রয়েছে। অদিম মানুষের একমাত্র কাজ ছিল পশুশিকার করা অথ্যৎ খাদ্য সংগ্রহ করা। এর জন্য তাদের শ্রমশক্তি ব্যয় করতে হতো। তারপরে আস্তে আস্তে তারা অস্ত্র বানানো শিখলো, আগুন জ্বালানোর শিখলো। এগুলো ছিল তাদের শ্রমের ফল। এরপর আসলো ফসল উৎপাদন এবং পশু পালন যা তাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। এটি অদিম মানুষের সহজাত প্রবৃতিকে পরিবর্তন করল। আদিম মানুষের প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করার অগ্রযাত্রা ছিল এই পশু পালন এবং কৃষিকাজ।

তারা লক্ষ্য করল স্ত্রী পশু সন্তান প্রসব করে। তাই তারা এগুলোকে শিকার হিসেবে না মেরে বন্দী করে পালন করত এবং সন্তান প্রসবের অপেক্ষায় থাকতে। এতে করে তাদের খাবারের অনিশ্চয়তা অনেকটাই কমে যেত এবং এর সাথে তারা বীজ থেকে শস্য উৎপাদন শুরু করে। খাদ্য সামগ্রী মজুদ করার সূচনা হয়েছিল এইভাবে। পশুপালন ও শস্য উৎপাদন করে তারা খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষন করে রাখত এবং এই সংরক্ষিত খাদ্য তাদের অনাহারে থাকার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমিয়ে দিল। এখান থেকেই সৃষ্টি হল আদিম মানুষের জীবিকার বিভক্তি।

আদিম সমাজে সবার সমান অধিকার ছিল, কোন শ্রেণীবিভক্তি ছিল না। তাদের অস্ত্র, হাতিয়ার সহ কোন কিছুই ব্যক্তিসম্পত্তি ছিল না, সব কিছুতেই সবার সমান অধিকার ছিল।

যখন উৎপাদন করা শুরু করল অর্থাৎ পশুপালন এবং শস্য উৎপাদন তখন থেকেই সম্পদের ধারণাটা সূচনা হয়। তখন পশু এবং খাদ্যশস্য ছিল তাদের কাছে সম্পদ। এখান থেকেই তাদের জীবিকার বিভক্তি হয়ে যায় এবং শ্রেণীবিভাগ দেখা দেয়। মেয়েরা এবং বৃদ্ধরা পশু পালন এবং শস্য উৎপাদন করত আর পুরুষেরা শিকার করত। আর এই শিকারের মাংসে সবারই সমান অধিকার ছিল।

উৎপাদনের প্রথম দিকে অর্থাৎ তারা যখন পশুপালন ও শস্য উৎপাদন করত তখন বিবিন্ন গোষ্ঠী তাদের মধ্যে বিনিময় প্রথার সৃষ্টি করে। যেমন এক গোষ্ঠী একটা পশু শাবক দিয়ে আরেক গোষ্ঠীর কাছ থেকে শস্যদানা নিবে। এভাবে তারা বিনিময়ের মাধ্যমে লেনদেন করত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যারা উৎপাদন করছে তারা এগুলো সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারছে। এই বিনিময় প্রথা আদিম সমাজকে দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত করে দেয় ।একদল যারা শিকার করত তারা উৎপাদন করত না, আরেকদল যারা উৎপাদন করত তারা শিকার করত না।

আগেই জেনেছি মানুষের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের মূল হচ্ছে শ্রমশক্তি ও উৎপাদন। যখন মানুষ উৎপাদন করতে শিখলো তখন এই উৎপাদনকারি সমাজটি হয়ে গেল প্রগতিশীল, আর শিকারি সমাজটি হয়ে গেল প্রতিক্রিয়াশীল। মানব সভ্যতার যতবারই নতুন সমাজ ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটেছে তার পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল অধিক উৎপাদন। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই প্রতিটি নতুন সমাজ ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছে।

আদিম সাম্যবাদ সমাজে যারা উৎপাদন করত তাদের খাবারের কষ্ট কম হতো এবং কম শ্রমে অধিক উৎপাদন করতে পারতো কিন্তু শিকারীরা অধিক পরিশ্রম করত কিন্তু তাদের উৎপাদন (এখানে খাবারকে বোঝানো হচ্ছে) কম হত। যার কারণে পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি হয় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা। শিকারিরা তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এবং শ্রম কমানোর জন্য নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারা অপেক্ষাকৃত ছোট এবং দুর্বল গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে দাস হিসেবে বন্দী করতো এবং এই দাসদের দিয়ে তাদের সকল কার্যক্রম করাতে শুরু করল। এতে করে তারা কম শ্রমে বেশি উৎপাদন করত।

এই দাসদের তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করত এবং এদের দিয়ে যা মনে চায় তাই করাতো, এখান থেকেই শুরু হয় “দাস সমাজ”।

দাস সমাজ সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত আছি। আদিম সাম্যবাদী যুগে শ্রেণি বলে কিছু ছিল না কিন্তু দাস সমাজে প্রথম শ্রেণী ও শোষণের আবির্ভাব হয়। মানব সমাজের ইতিহাসে এ সময় দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল শোষক শ্রেণী যারা দাস মালিক অর্থাৎ যারা সমাজের সম্পদের মালিক অথচ শ্রম করে না আরেকটি শোষিত শ্রেণী যারা হচ্ছে দাস। এরা শ্রম করে উৎপাদন করে কিন্তু ওই সম্পদের প্রতি তাদের কোনো অধিকার ছিল না। শ্রেণি যেখানে আছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ সেখানে অবশ্যম্ভাবী।

দাসেরা বারবার শোষণ-নিপীড়নের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছেন আর অন্যদিকে দাসপ্রভুরা চেয়েছে দাসেদের উপর কর্তৃত্ব খাটাতে। আর এই ধারণা থেকেই পরে সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, বিচার, আইন ইত্যাদি। দাসদের কে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে এবং শোষণ করার জন্য মূলত তখন দাসপ্রভুরা এসবের আবির্ভাব ঘটায়। রাষ্ট্রের ধারণা সৃষ্টি হয় তখন। মূলত এইসব আইন কানুন, সেনাবাহিনী এই সব দাসদের আন্দোলন ঠেকাতে ও দমন করতে তৈরী করা হয়েছিল। যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হলো সেই দিন থেকে পুরুষ নারীকে তার সম্পদ হিসেবে ভাবতে লাসল, তারা তাদের ভোগ পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে লাগলো।

এভাবে এক সময় দাস প্রথা হয়ে গেলো প্রতিক্রিয়াশীল। দাসেরা বিক্ষোভ ধর্মঘট শুরু করল। দাস প্রভুদের একাংশ খেয়াল করল এই সমাজ ব্যবস্থা আর চলতে পারে না পরিবর্তন দরকার। কারণ তাদের চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন হচ্ছিল না।সেই সময় কৃষিকাজের নতুন যন্ত্রপাতি, কারখানা সহ বিভিন্ন মেশিন তৈরী হলেও উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে না।এর মূল কারণই ছিল দাসেরা শুধুমাত্র প্রভুর জোর আরোপের জন্যই উৎপাদন করত উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে তাদের কোন চিন্তাই ছিলনা।কারণ এই উৎপাদনে তাদের কোন স্বার্থ ছিল না, তাই উৎপাদন বেশি হতো না। তখন প্রগতিশীল দাস প্রভুরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবল যেখানে উৎপাদন হবে আরো বেশি। এই ধারণা থেকে সৃষ্টি হল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ।

সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল উপাদান ছিল জমি। জমির মালিক হবে ভূস্বামীশ্রেণী যারা কাজ করবে না,তাদের জমিতে চাষ করে ফসল ফলাবে কৃষক আর উৎপাদনের একটা নির্দিষ্ট অংশ ভূস্বামী পেত।

যেমন ভারতবর্ষে হিন্দু রাজত্বে কৃষকদের রাজাকে দিতে হতো উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ অনেকটা এই রকমই । এতে করে কৃষকরা খুব যত্ন করে উৎপাদন করত কারণ এতে তাদের স্বার্থ জড়িত ছিল। বেশি উৎপাদন হলে তারা ভাগে বেশি ফসল পাব। আর এই কারণে এই সমাজ ব্যবস্থায় ভূস্বামীরা অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হত।

এসময় কিন্তু দাস সমাজের মত শোষণ নিপীড়ন ছিল শুধুমাত্র শুধুমাত্র পার্থক্য এই ছিল যে, দাস সমাজ ব্যবস্থায় মালিকের সম্পত্তির উপর দাসদের কোন অধিকার ছিলনা আর এখানে কিঞ্চিত মাত্র অধিকার ছিল।এসময় হস্তশিল্পের ও কুটির শিল্পের প্রলচলন শুরু হয়। মুদ্রার প্রচলন ও বাণিজ্যিক প্রসার লাভ করেছিল সামন্তযুগে। এইসময় জমি ছিল মূল সম্পদ। জমি যেহেতু সম্পত্তি তাই উত্তরাধিকার কে হবে?

এই চিন্তা ভাবনা মূলত এই সময় আসে। দাস মালিকদের দাসদের দমন করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল রাষ্ট্র সেনাবাহিনী আইনকানুন। ঠিক এই সময় রাষ্ট্রের ধারণা মূলত রূপ ধারণ করে , গঠিত হয় সেনাবাহিনী ।এই সময় সর্বোপ্রথম সুদ লেনদেন শুরু হয়।

এ সময় নারীর স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে খর্ব করা হয়েছিল শুরু হয়েছিল বহুবিবাহ, বেশ্যাবৃত্তির মত কাজ। ঠিক এই সমাজ ব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে ওঠে ,চারিদিকে যখন এই সমাজ ব্যাস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় ঠিক তখনই ধারণা আসে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment