প্রেম করে সম্মতিতে সহবাস করলে কী হবে?

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস এখন নিত্য দিনের ঘটনা কিন্তু সেটা ধর্ষণ এর পর্যায় পরে কিনা মূল্যায়ন করা দুষ্কর হয়ে দাড়িয়েছে ৷ অনেকের ধারণা এটা ধর্ষণ! প্রতিকারের জন্য মামলাও করে থাকে। কিন্তু সম্মতিতে সহবাস আর ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারলে অনেক নারী ভুল পথে অগ্রসর হবে। তাই ধর্ষণ ও সম্মতিতে সহবাসের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে।

বর্তমান যুগে বিবাহ বহির্ভূত সম্মতিতে সহবাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। অহরহ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস সংগঠিত হচ্ছে।

বর্তমান যুগে প্রেম একটি অতি পরিচিত শব্দ। বেশির ভাগ তরুণ তরুণী প্রেমের সম্পর্কের সাথে জড়িয়ে তা সহবাস পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত সহবাসের কারণে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। অনেক সময় সহবাস হয় কিন্তু পরবর্তিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উঠা হয় না !

আবার সহবাসের কারণে গর্ভবতীও হচ্ছে অনেক। ফলে গর্ভপাত ছাড়া উপায় থাকছে না। কারণ সন্তানের আইনগত অভিভাবক থাকছে না।

আইনগত অভিভাবক না থাকলে জন্ম গ্রহণকারী সন্তানকে আইনের ভাষায় জারজ সন্তান বলে। কোনো নারী চায় না তার সন্তান আইনগত অভিভাবক ছাড়া জন্মগ্রহণ করুক। এই ধরনের সহবাসকে একটি পর্যায় ধর্ষণ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকে না জেনেই ভুল করে বসে যে সে প্রতিকার পাবে যদি তাঁর পার্টনার পরবর্তীতে ছেড়ে চলে যায়।

কিন্তু আইনে সম্মতিতে সহবাস করলে তার কোন প্রতিকার দিতে পারে না। তাই ধর্ষণের প্রতি প্রতিবাদ সুলভ মনোভাব নিয়ে বলা যায় ধর্ষণ একটি ঘৃণ্য, জঘণ্য ও বর্বরোচিত অপরাধ।

যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয় বর্তমান সমাজে। ধর্ষণ মুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে সম্মতিতে সহবাস, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস ও ধর্ষণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য সম্মতিতে সহবাস, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস ও ধর্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

প্রথমত, ধর্ষণ:

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এর ধারা ৯ অনুযায়ী ধর্ষণ বলতে বোঝায়, ‘যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।

তাহলে ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহীত সম্মতিতে সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ হবে না। এই আইন অনুযায়ী দাঁড়ালো যে, কোন নারী সম্মতি না দিলে সেটা ধর্ষণ হবে।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি -১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারাতে বলা হয়েছে, ‘ কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটির যেকোনো অবস্থায় কোন নারীর সাথে যৌনসঙ্গম করলে সে ধর্ষণ করেছে বলে গণ্য হবে ‘।

প্রথমত, স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ।
দ্বিতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে।
তৃতীয়ত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা হলে।

চতুর্থত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে, সে স্ত্রীলোকটি স্বামী নয় এবং পুরুষটি ইহার জানে যে, স্ত্রীলোকটি তাকে এমন অপর একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে, যে পুরুষটির সাথে সে আইন সম্মতভাবে বিবাহিত হয়েছে বা বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে ।

পঞ্চমত, স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যতি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সকল আইনেই সম্মতির বিষয়টি স্পষ্ট করেছে যে সম্মতি ছাড়া সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ হবে কিন্তু সম্মতিতে সহবাস করলে ধর্ষণ হবে না! আবার অনেকে জানেই না যে অনেক সময় নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাস করলেও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে যদি স্ত্রীলোকটির বয়স ১৪ বছরের কম হয়৷ এখনও আমাদের দেশে ১৪ বছরের কম বয়সে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়৷ তাহলে তারা প্রতিনিয়ত তাঁর স্বামীর নিকট হতে ধর্ষণের স্বীকার হয়!

দ্বিতীয়ত, সম্মতিতে সহবাস :

সম্মতিতে হলেও ইসলামে বিবাহ বহির্ভূত সহবাস বৈধ নয় কিন্তু বাংলাদেশের আইনে সম্মতিতে সহবাসের বৈধতা রয়েছে। তাই সম্মতিতে সহবাস বৈধ যা আদালতে গেলে সম্মতি থাকলে সেটা আর ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না।

এ ক্ষেত্রে সম্মতিটা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে যদি কেউ তার স্ত্রীর সাথেও সম্মতি ছাড়া সহবাস করেন সেটিও ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যেখানে সম্মতি আছে সেখানে অপরাধ নাই আর যেখানে সম্মতি নাই সেখানে অপরাধ আছে! তাহলে আপনি সম্মতি দিয়ে বিবাহ ছাড়া সহবাস করলে সেটার কোনো আইনগত প্রতিকার পাবেন না।

তৃতীয়ত, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাস:

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাসটা হলো একটি চুক্তির মত আর চুক্তি যদি আদালতে বলবৎ যোগ্য না হয় তাহলে তার আর মূল্য থাকে না। বেশির ভাগ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাসেই লিখিত কোনো ডকুমেন্ট থাকে না।

এক্ষেত্রে জোড়পূর্বক, ভয় দেখিয়ে, মৃত্যুর বা জখমের ভয় দেখিয়েও সহবাস হয় না। তাহলে আইন অনুযায়ী সেটা আর ধর্ষণ বলে গণ্য হচ্ছে না। তাহলে দাঁড়ালো বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহবাসও ধর্ষণের আওতায় আসবে না।একারণেই আসবে না যে আপনি সম্মতি দিয়ে সহবাসটি করেছিলেন৷

বাংলাদেশের সংবিধান ভারত ও ব্রিটিশ আইন ব্যবস্থা অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছিল। তাই ভারতের এই বিষয় সম্পর্কিত রায় বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের আইনেও সম্মতি থাকলে সেটা আর ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয় না। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলো বম্বে হাইকোর্ট ,’প্রেমের জেরে শারীরিক সম্পর্ক, পরে ধর্ষণের অভিযোগ আনা যাবে না ‘।

বাংলাদেশের আইনেও এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়৷ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী
ধর্ষণ হতে হলে ভিক্টিমের বয়স ১৬ বছরের কম হতে হবে। এমনকি ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সাথে তার যৌনকর্মের সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।

তবে যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তাহলে যৌনকর্মে ভিক্টিমের সম্মতি থাকলে ধর্ষণ বলে গণ্য করা যাবে না। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম ৫১ ডিএলআরের ১২৯ মামলায় বলেন যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে সহবাস করে তাহলে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে না ‘।

মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যদি কোনো নারী কোনো পুরুষের সাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সহবাস করে তাহলে সেই নারী আইনগত কোনো প্রতিকার পাবে না।

বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে উভয় পক্ষ পূর্ণ সম্মতি থাকে বিধায় এটা ধর্ষণের পর্যায় পরে না এবং আইন দ্বারা বলবৎ করা যায় না। এখানে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী নারী বা পুরুষ যে কোনো কেউই হতে পারে। কিন্তু কেউই এর জন্য আইনের আশ্রয় পাবে না। এক্ষেত্রে নারীরা ভুক্তভোগী দাবী করে ধর্ষণের অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়ের করেন। যা আদালতে গ্রহণযোগ্য নয়৷

সুতরাং কেউ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে সহবাস করতে চাইলে তা থেকে দূরে থাকায় সমাজ, দেশ ও সেই ব্যক্তির জন্য মঙ্গল।

লেখক
মো. সোহেল রানা

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment