জয় চন্দ্র দাস
প্রযুত্তির উন্নতি ও জীবন যাত্রার মানের আধুনিকায়নের ফলে আমাদের জীবনের অপরিহার্য এক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে প্লাস্টিক। প্রতিনিয়ত আমরা ব্যবহার করছি প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের বোতলে পানি খাওয়া, প্লাস্টিকের প্লেটে খাবার খাওয়া, প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা। এছাড়াও প্রতিনিয়ত আমরা অবহেলায় রাস্তা ঘাটে , যেখানে সেখানে নিক্ষেপ করছি চিপস বা বিভিন্ন রকমের খাবারের প্যাকেট, বোতল, পলিথিন, বিভিন্ন রকম পণ্যের মোড়ক।
এসব ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের একটি অংশের গন্তব্য হচ্ছে সমুদ্রে। এভাবে আমরা নিজেদের কি পরিমাণ বিপর্যয় যে ডেকে আনছি তা হয়ত আমরা নিজেরাও জানি না। চলুন আজ জেনে নেয়া যাক কিভাবে এই প্লাস্টিক আমাদের মানবদেহের , সামুদ্রিক প্রাণীদের তথা সমগ্র পৃথিবীর ক্ষতি করছে।
প্রথমেই আসি মানবদেহের ব্যপারে। প্লাস্টিকে এমন সব ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা মানুষের শরীরের জন্য চরম ক্ষতিকারক। তাদের মধ্যে অন্যতম কিছু উপাদানের নাম ও প্রতিক্রিয়া নিচে উল্লেখ করা হলঃ
১। স্টাইরিনঃ প্লাস্টিকের প্যাকেজিং, ডিসপোজেবল কাপ (ওয়ানটাইম কাপ) ও রাবার কনটেইনারে ব্যবহৃত স্টাইরিন নামক রাসায়নিক পদার্থটি মানব দেহে গেলে এক সময় তা থেকে ক্যান্সার ও লিউকেমিয়া হতে পারে। ডেইলি মেইল অন লাইনে গত ৩১ মে একটি গবেষণার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষ স্টাইরিনের ছোঁয়ায় আসে পরিবেশ থেকে। আবার প্রিন্টার, ফটোকপিয়ারের সাথে যারা কাজ করে এবং সিগারেট পান করে তারাও স্টাইরিনের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রভাবিত। গবেষণাটি হয়েছে ডেনমার্কে।
২। পলিভিনাইল ক্লোরাইডঃ টেবিল ক্লথ, বেডিং এর কভার, মাংসের র্যাপার ইত্যাদিতে এ উপাদানটি থাকে। এতে শিশুদের হাঁপানি হতে পারে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে পারে। মহিলাদের বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে।
৩। বিসাফেনলঃ অধিকাংশ প্লাস্টিক বোতলে এ যৌগটি থাকে । অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতিকারক। । অন্তঃসত্ত্বা মহিলার শরীরে এটি ঢুকলে শিশুর ওজন হ্রাসের সম্ভাবনা থাকে । শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। শিশুর মহিষ্কের বিকাশ রোধ করে।
৪। হাই ডেনসিটি পলিইথিলিনঃ পলিপ্যাক, প্রসাধানীর কনটেইনার, দুধের বোতলে এ উপাদানের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এতে স্ত্রী হরমোনের নিঃসরণ ও লক্ষণ বেড়ে যায়। হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। শিশুশরীরে কোষের গঠন বদলে দেয়।
৫। পলিইথিলিন টেরেফটালেটঃ প্লাস্টিক বোতলে এটি বেশি থাকে। এর থেকে অ্যান্টিমনি নিঃসৃত হয়। এটি স্ত্রী হরমোনের পরিমাণ ও লক্ষণ বাড়ায়। পুরুষ হরমোন নিঃসরণ কমায়। এছাড়াও পেটের অসুখ ও পাকস্থলীতে ক্ষত সৃষ্টি করতে এটি বিরাট ভূমিকা রাখে।এতো গেলো শুধুমাত্র মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে । সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন আশংকায় প্লাস্টিক যে কত বড় ভূমিকা রাখছে তা হয়ত বলে বোঝানো সম্ভব না। প্রায় সাত বিলিয়ন মানুষের ব্যাবহার করা প্লাস্টিকের অনেকাংশেরই শেষ গন্তব্য হল সমুদ্র।
এক তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সাল নাগাত পৃথিবীতে মোট তৈরি করা প্লাস্টিকের পরিমাণ হল ৬.৩ বিলিয়ন। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল এর মাঝে মাত্র ৯ শতাংশকে পুনরায় ব্যাবহার উপযোগী করা হয়েছে, ১২ শতাংশকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বাকি ৭৯ শতাংশই পৃথিবীতে জমা থেকে গেছে ।
সামুদ্রিক প্রাণীর একটি বড় অংশ সাধারণত খাদ্যের জন্য সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা (জুপ্ল্যাঙ্কটন) এবং উদ্ভিদকণার (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) উপর নির্ভরশীল। গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায়, সমুদ্রে এক পাউন্ড প্ল্যাঙ্কটনের (যেগুলো মাছসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য) বিপরীতে ছয় পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য বিদ্যমান! আর এসব প্লাস্টিকের কারণে পানিতে জুপ্ল্যাঙ্কটন ও ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন উৎপাদনের পরিমাণ ক্রমশ কমছে।
অন্যান্য দ্রব্য যেমন কিছুদিনের মাঝেই পচন ধরে কিন্তু প্লাস্টিকের বেলায় তা ব্যতিক্রম। অণুজীব এদের সহজে পচাতে পারে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে এরা সমুদ্রের পানিতে অবিকৃত অবস্থায় জমা হতে থাকে। তবে না পচলেও বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক কারণে এদের আকৃতি ক্রমশ ছোট হতে থাকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব প্লাস্টিককে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক । আর এরাই ক্ষতিটা করে সবচেয়ে বেশি।
প্ল্যাঙ্কটন সাইজের এই প্লাস্টিককণাকে সামুদ্রিক মাছেরা খাদ্য মনে করে ভুল করে ফেলে। খাদ্যের সাথে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণিকা গুলো সামুদ্রিক প্রাণীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এর ফলে পরিপাক ও প্রজননের মত গুরুত্বপূর্ণকাজ বাঁধাগ্রস্ত হয়ে যায়। ফলে প্রাণীটি ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে । শুধু মাছই না। পাখিরা এবং অন্য সব সামুদ্রিক প্রাণীরাও এর বাইরে না। গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন সামুদ্রিক কাছিমদের বেশিরভাগই প্লাস্টিক ব্যাগ এবং জেলিফিশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ফলে তারা প্লাস্টিককে খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলে।
এছাড়াও সামুদ্রিক পাখিরাও শিকার হচ্ছে একই রকম বিপদের। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সমুদ্রে বিচরণকারী কোন কোন পাখির পাকস্থলীর ৮০% জায়গা প্লাস্টিক বর্জ্যে দখল করতে পারে বা করে থাকে! এগুলো হজম হয় না, যার ফলে আস্তে আস্তে পাখীগুলো না খেতে পেরে করুণভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। তবে এর মধ্য এলবাট্রোস এর মত বড় পাখিদের অবস্থা হল সবচেয়ে ভয়ানক। সমুদ্র এলাকায় থাকা এই সব পাখিদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। এদের মৃতদেহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই পাখিদের একটি বড় অংশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার। প্লাস্টিক যেভাবে ভয়ানকভাবে ক্ষতি করছে প্রাণিজগতের তা বলে শেষ করা যাবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী , ইনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।