বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা

অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা


বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।

© কাজী নজরুল ইসলাম।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে পরিবারের সহযোগিতা বিশেষ করে স্ত্রীর অবদান অনস্বীকার্য।

মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা। ফজিলাতুন্নেছার বাবা মারা যাওয়ার পরে তিন বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। পাঁচ বছর বয়সে রেণু তাঁর মাকে হারায়। পিতা-মাতা হারা রেণু বঙ্গবন্ধু’র পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য ভাই- বোনের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, তাঁদের বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিলো ১৯৪২ সালে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তঁার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে বঙ্গমাতা নিজেকে যুক্ত করেন।

বঙ্গমাতা নিজের গহনা বিক্রি করে ছাত্রলীগের সম্মেলনে টাকা দিয়েছেন। ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে দলকে পরিচালনা করতেন। আব্দুর রাজ্জাকের একটি লেখায় পড়েছি- আওয়ামী লীগের অফিসের ভাড়া এবং তাঁর নিজের বাসার ভাড়া দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে বঙ্গমাতা- অফিসের ভাড়া এবং মরহুম রাজ্জাক সাহেবের বাড়ি ভাড়ার টাকাও বঙ্গমাতা জুগিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার কতর্ৃক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়।

এমনকি বেগম মুজিবকে গ্রেফতার করার হুমকিও দেয়া হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন সংঘটিত হয়। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায়। বেগম মুজিব জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্যারোলে মুক্তি নেয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।

সত্যি সত্যিই গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। সে সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদের মুখে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো ‘বঙ্গবন্ধু’।

সেই থেকে শেখ মুজিব বাঙালির দেয়া খেতাব বঙ্গবন্ধু-তে পরিণত হন। বেগম মুজিব প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে জোড়ালো আপত্তি না করলে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হতো না।

আমরা প্রায় সবাই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা জানি। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর উপর স্বাধীনতা ঘোষণার একটি চাপ ছিলো, অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের কড়া দৃষ্টি ছিলো। আমরা অনেকেই জানি সেই ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে মাথার উপর সুসজ্জিত হেলিকপ্টার ঘুরছে, আর মঞ্চের চারপাশে সাদা পোশাকে পাকিস্তানী আর্মি বঙ্গবন্ধুর উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। সকল বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণা চেয়েছিলো। অথচ বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতার ডাক দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হতেন।

এমন একটি সময় বেগম মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। বেগম মুজিব জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে এবং সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মন থেকে যা বলতে ইচ্ছা করে- তাই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তঁার পরামর্শের যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায় ঐতিহাসিক এ ভাষণে। বঙ্গমাতা উল্লিখিত দু’টি ঘটনায় প্রত্যক্ষ অবদান যদি না রাখতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে অবদান- সেখানে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার সহযোগিতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ৮ই আগস্ট বঙ্গমাতার ৯০তম জন্মবার্ষিকী। আমাদের শ্রদ্ধা আর অফুরন্ত ভালোবাসা রইলো তঁার প্রতি।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *