বাংলাদেশে গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়নে ই-কমার্সের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে গ্রামীণ উদ্যোক্তা উন্নয়নে ই-কমার্সের চ্যালেঞ্জ

হোসনে আরা খান নওরীন: নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পেয়াঁজ, আলু ও চিনি এবং কোরবানীর গরুও যে অনলাইনে কেনা যায়, তা এই করোনাকাল শিখিয়ে দিল দেশের মানুষকে। বিশেষত শহরের মানুষকে। করোনাকালীন সময়ে শহর অঞ্চলে এখন অনেকেই অনলাইনে কাঁচাবাজার সারছেন। পাশাপাশি ওষুধ ও ইলেকট্রনিকস পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনছেন।

করোনাকালে তাঁরা অনলাইনে পণ্য কিনেছেন। ফলে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাঁদের একটা অংশ অনলাইনের ক্রেতা হিসেবে থাকবেন। যারা ক্রেতাদের ভালো সেবা দিচ্ছে, তারাই ভালো করবে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে ই-কমার্সের কোন অস্তিত্ব নাই বললে চলে।

অথচ আমাদের দেশে প্রায় ৮০% লোক গ্রামে বাস করে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ই-ক্যাবের তথ্যমতে-দেশের ই-কমার্সের ক্রেতারা মূলত শহরকেন্দ্রিক; তন্মধ্যে ৮০% ক্রেতার ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের। এদের মধ্যে ৩৫% ঢাকার, ৩৯% চট্টগ্রামের এবং ১৫% গাজীপুরের অধিবাসী। অন্য দু’টি শহর হলো ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ এবং আরেকটি মেট্রোপলিটান শহর সিলেট। ৭৫% ই-কমার্স ব্যবহারকারীর বয়স ১৮-৩৪-এর মধ্যে। তবে গ্রামে গ্রামে পণ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা চালু হয়নি।

অনলাইনে বিক্রির প্রবৃদ্ধি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ দেশে করোনাকালে ই-কমার্সে লেনদেন বেড়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মধ্যে গত ৮ মাসে ই-কমার্স সেক্টরে লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় এক লাখ পণ্য ডেলিভারি হচ্ছে প্রতিদিন এবং ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘের ট্রেড বডি হিসেবে পরিচিত ইউএনসিটিএডি বিজনেস-টু-কনজুমার (বিটুসি) ইলেকট্রনিক কমার্স নামের একটি সূচক প্রকাশ করেছে, যেখানে ১৩০টি দেশের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার, নিরাপদ সার্ভার, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ার হার ও পোস্টাল ডেলিভারি সিস্টেম এই চারটি বিষয় বিবেচনায় রেখে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে।

১৩০টি দেশের মধ্যে অবশ্য বাংলাদেশের ঠাঁই হয়নি। ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলো এই সূচকের শীর্ষে রয়েছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। উন্নয়নশীল ও বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ঠাঁই করে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোরিয়া, হংকং ও সিঙ্গাপুর। অবশ্য অনলাইনে কেনাকাটার দিক থেকে ব্রাজিল, চীন ও রাশিয়া ফেডারেশন ভালো করছে। আফ্রিকা অঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহার কম হওয়ায় ই-কমার্সের প্রসার হচ্ছে না।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে দেশে শুরু হয় ই-কমার্স ব্যবসা। প্রথম দিকে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন, মানুষকে অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মোকাবেলা করে বিগত কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অনলাইনে কেনাকাটা। বিভিন্ন গবেষনাপত্র বিশ্লেষন করে আমার কাছে গ্রাম অঞ্জলে ই-কমার্সের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ ৩টি মনে হয়েছেঃ

১। গ্রাম অঞ্চলে ইন্টারনেট অপ্রতুলতা এবং ইন্টারনেট থাকলেও নেটওয়ার্ক দুর্বল।

২। পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়েও গ্রাম পর্যায়ে অনেকক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায়। এলাকাভিত্তিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও বর্তমানে দেশে প্রচলিত ক্যাশ অন ডেলিভারী, কন্ডিশন ডেলিভারী, মোবাইল ব্যাংকিং, চেক, টিটি, ডিডি, পেমেন্ট গেটওয়ে এগুলোর প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে বেশভালো ভাবে ব্যবসা করা সম্ভব।

৩। সঠিক সময়ে ডেলিভারী দেওয়া অনেকক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সম্ভব নয়। তবে এটি সত্যি যে, অযথা টেনশন না করে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে থেকে কিভাবে ভালো সার্ভিস পন্য ও মান নিশ্চিত করে বেশী বিক্রি করা যায় সে কথাই সকলের ভাবা উচিত।

উল্লেখ্য যে, প্রথাগত ব্যবসায়িরাও এসব ঝামেলায় রয়েছেন যশোরের একজন নকশীকাথা প্রস্তুতকারক কিন্তু খুব সহজে চট্টগ্রামে তার পাইকারকে স্যাম্পল পাঠাতে পারছেন না। কিন্তু যশোরের নকশীকাথা কিন্তু ঠিকই ঢাকায় চাহিবামাত্র পাওেয়া যায় এমনকি ফুটপাতে পর্যন্ত। তাহলে মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাস্তা বের করে নিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের বেচাকেনা বা ব্যবসা কোনেটাই থেমে নেই।

স্থানীয় পর্যায়ে ই-কমার্সে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাইটে ক্রেতা ধরে রাখা। ক্রেতাদের আস্থা ফেরানো গেলে তাদের ধরে রাখা যাবে। সুতরাং দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা আর ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষের তৈরি অনেক পণ্যের আমরা নামই জানি না। দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে চাইলে সবার আগে নজর দিতে হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দিকে। বর্তমানে করোনাকালীন গ্রামীন উদ্যোক্তা হতে পারে প্রায় ২ কোটি কর্মহীনদের সমস্যার সমাধান।

লেখকঃ ফাউন্ডার ও সিইও, নওরীন’স মীরর।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment