বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় গোড়ায় গলদ: নেই কারো মাথা ব্যথা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এর কতটুকু যথোপযুক্ত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আশা করা যায়? পিএসসি পরীক্ষার নামে প্রাথমিক শিক্ষায় চলছে জিপিএ পাওয়ার প্রতিযোগিতা। তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ডজনখানেক বই।

অথচ মূল্যবোধ সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে, এই বয়সে এতগুলো বই সম্পর্কে ওরা বোঝে কি? তাদের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টির গুণগুলো জোর করে চাপা দেয়া হচ্ছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিপরীতে চর্চা করা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকের পড়া। প্রতিদিন ভোরবেলা দেখা যায়, ছোট ছেলেমেয়েরা কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে কোচিংয়ে যাচ্ছে।

তবে মজার বিষয় হলো, বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রস্তুতির পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে ওদের মা-বাবা অভিভাবকেরাও। প্রতিযোগিতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের চেয়ে মায়েদের ‘পড়ালেখার প্রস্তুতি’ই বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক শিক্ষায় রূপান্তরিত হলেও সেটার ভার সহ্য করার মতো ক্ষমতা যে কোমলমতি শিশুদের নেই, এ কথা সরকারি মহলের কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না।

ওই মহলের চিন্তা কিভাবে শিক্ষাটাকে আপডেট করা যায়। শিক্ষার্থীদের শিষ্টাচার ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বর্তমান শিক্ষা কতটুকু যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিকে নজর দিলেই এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়।

প্রাথমিক স্কুলগুলোতে চলছে ম্যানেজিং কমিটির অনিয়ম। রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্যের বিস্তার ঘটাতে ঘটাতে ইউনিয়ন থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে ওয়ার্ড, এমনকি তৃণমূলপর্যায়ে রাজনীতিটা এমনভাবে প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, তার প্রভাব থেকে প্রাথমিক স্কুলগুলোও বাদ যাচ্ছে না। ম্যানেজিং কমিটিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী অভিভাবকেরা লড়ছেন রাস্তাতে আর তাদের ছেলেমেয়েরা এরই কুফল ভোগ করছে স্কুলে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে সঙ্ঘাত ও দ্বন্দ্ব।

বাড়ি থেকে শিখিয়ে দেয়া হয়, অমুকের ছেলে কিংবা মেয়ের সাথে মিশতে পারবে না। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাটা স্কুল থেকেই তার সহপাঠীকে কথিত দুশমনে পরিণত করে দিচ্ছে। এর ফল ভবিষ্যতে মনুষ্যত্ব বিকাশে অনুকূল হবে না।

বেশির ভাগ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির সমস্যা নিয়ে উপজেলা-জেলাকর্তা ব্যক্তিরা রয়েছেন মহাবিপাকে। সরকারি কারিকুলামের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা প্রদানের বিভিন্ন পদ্ধতি স্কুলে প্রয়োগের ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর ম্যানেজিং কমিটি গঠনে হানাহানি রেষারেষি ইত্যাদি থেকেও বর্বরতার শিক্ষা পাচ্ছে এই ছোট ছেলেমেয়েরা। ফলে তাদের মূল্যবোধ সৃষ্টির বদলে জায়গা করে নিচ্ছে হিংসার বিষয়টি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে তৈরি করে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিষয়টি। এ পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী নিজের সম্পর্কে কতটুকুই বা ধারণা নিতে পারে? সবেমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে না হতেই ওদের নিতে হচ্ছে ছাত্র সংসদের মতো নেতৃত্বের ভার।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা শুধু শিক্ষাঙ্গনেই পাওয়া যায় না। শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে মূল্যবোধ সৃষ্টির চর্চাকেন্দ্র। এই শিক্ষাঙ্গনে সঠিক মূল্যবোধ পেতে দরকার শিক্ষকদের যথাযথ ভূমিকা।

পরিবেশ থেকে সৃষ্ট যেসব অনৈতিকতা শিশুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, আজ সেই অনৈতিক প্রভাব যদি কোনো শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করে তাহলে সেই শিক্ষাঙ্গনে প্রদত্ত নৈতিকতা শিক্ষার্থীকে কখনো খুব ভালো উপহার দিতে পারে না।

ইউনিসেফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসে প্রাথমিক স্কুলে শিশুদের কোনো বাড়ির কাজ দেয়া হয় না; হলেও খুব কম। লেখাপড়া করতে শিশুদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় না। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের গুরুগম্ভীর কোনো পরীক্ষায় বসতে হয় না। দেশটির শিশুরা সবচেয়ে বেশি সুখী জীবন কাটায়।

শিশুদের জন্যে এই সুখী জীবন নিশ্চিত করাটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রোজকার হোমওয়ার্ক নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের। ষোল বছর বয়সে গিয়ে তাদের মাত্র একটি বাধ্যতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আর আমরা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কী করছি? বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।

ফ্রান্স যেমন স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক বাছাই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে মনোযোগী। জাপানে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বাছাই করার ক্ষেত্রে দেয়া হয় বিশেষ গুরুত্ব। ভুটান থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক।

এ রাষ্ট্রগুলো দায়িত্ব নিয়ে তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করেছে। অথচ এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে। ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, মিয়ানমারে যেখানে ৮০-৯০ শতাংশেরও বেশি প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে বাংলাদেশে এ হার মাত্র ৫০।

একটি বিষয় স্পষ্ট, একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার গলদই যথেষ্ট। শিক্ষা ব্যবস্থা তখনই ভালো হবে যখন দেশের নীতি নির্ধারকের সন্তান থেকে শুরু করে দিন মজুরের সন্তান সরকারি স্কুল, সরকারি কলেজ ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যবস্থায় পড়বে।

আর এখন এই ব্যবস্থার প্রতি কেউ সিরিয়াস না হলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো ভঙ্গুর হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি করবে।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *