বাংলার আকাশে নক্ষত্রের পতন

আবু জাফর সালেহ


মাত্র সতেরো দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ হারাল তার পরম দুই রত্ন কে। জাতীয় অধ্যপক ড. জামিলুর রেজার পর বিদায় নিলো ড. আনিসুজ্জামান। স্বাধীনতা বাংলার সমস্ত বড় ভৌত কাঠামোর মধ্যে যেমন অমর রবেন জামিলুর রেজা স্যার তেমনি আনিসুজ্জামান স্যারও বাঙ্গালীর অভ্যান্তরীণ সাহিত্যআত্মায় বেঁচে রবেন চিরকাল।

জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। লেখালেখির হাত ছিল মা সৈয়দা খাতুনের পরবর্তী জীবনে আনিসুজ্জামানের উপর এর প্রভাব পরে।

স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, মেয়ে রুচিতা জামান ও শুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামান নিয়েই ছিল তার স্বর্গ।

“রাষ্ট্র ভাষা কি ও কেন” লিখলেন ভাষা আন্দোলনের সময়ে। করলেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অংশগ্রহণ , ১৯৭১ সালে করলেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনোত্তর বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বক্তৃতা গুলো অনেকটি হাত হাতেই লিখা। চষে বেড়িয়েছেন কলকাতা থেকে শিকাগো পর্যন্ত নিজের জ্ঞানের ঝুড়ি সমৃদ্ধ করতে।

কলকাতার পার্ক সার্কাসে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ৪৭ দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে ও ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে পড়েন।১৯৫১ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতকে ও ১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পিএইচডি ডিগ্রি করেন ‘ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা’ নিয়ে। ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্র জীবনের মত তার পেশাগত জীবনেও তিনি সাফল্য। মাত্র ২২ বছর বয়সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু। এরপর ১৯৬৯ জুনিয়র রিডার হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে শিক্ষা কমিশনের সদস্য পদে কাজ করেন। কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন ৭৪ সালে।

১৯৮৫- ২০০৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। এরপর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে স্বরূপের সন্ধানে, পুরোনো বাংলা গদ্য, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, ইত্যাদি।

তিনি ১৯৮৫ সালে ‘একুশে পদক’, ২০১৫ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী’ পদক পান।

৮৩ বছরের বর্ণিল জীবনের ইতি টানে ১৪ মে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি যেমন শহীদুল্লাহ্, মুনীরের মত শিক্ষাগুরু পেয়েছিলেন তেমনি রেখেও গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ শত যোগ্য শিক্ষার্থীদের। দেশ-বিদেশে তার এই গুণগ্রাহীরাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment