বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা

সাহিত্য ডেস্ক


বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বিশিষ্ট এই বাঙালি কবি ১৮৭৩ সালের আজকের এই দিনে (২৯ জুন) আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে মারা যান।

যে বিশিষ্ট লেখকদের অবদানে বাংলা সাহিত্য ধন্য হয়েছে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলা সাহিত্যে ইউরোপীয় চিন্তা ও চেতনার সার্থক প্রতিফলন ঘটান তিনি।

মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর থানার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে কলকাতা যান। খিদিরপুর স্কুলে দুই বছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। বাংলা, ফরাসি ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন।

১৮৪৪ সাল থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার বিশব কলেজে অধ্যায়ন করেন। সেখানে মধুসূদন গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন।

তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিভক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা মাদ্রাজ স্পেক্টেটর এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৬২ সালের ৯ জুন আইন বিষয়ে পড়ার জন্য তিনি বিলেত যান।

১৮৬৬ সালে আইন পাস করেন। মাইকেল মধুসূদন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তিনি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্যেও অসামান্য অবদান রাখেন।

যদিও তার প্রথম ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘The Captive Ladie’কে ইংরেজরা তখন সাদরে গ্রহণ করেনি। পাশ্চাত্যের প্রতি মোহগ্রস্ত মধুসূদন ১৮৪৩ সালে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং ‘মাইকেল’ উপাধি ধারণ করেন। তিনি ইংরেজদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এটি রচনা করলে গ্রন্থটি তৎকালীন ইংরেজ সাহিত্যিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে।

মধুসূদন থাকলে তাদের সাহিত্যকর্ম স্থান পাবে না এই সংশয় তাদের মাঝে প্রকটভাবে দানা বাঁধতে থাকে। ইংরেজি সাহিত্যে তার কীর্তির যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তিনি মনোক্ষুণ্ন হয়ে পড়েন। তখনই বুঝতে পারেন নিজ স্বদেশ ও শেকড়ের মর্ম।

ইংরেজি সাহিত্য থেকে ছিটকে পড়ে বন্ধু মহলের পরামর্শে মধুসূদন বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে উপহার দেন শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, মেঘনাদবদ কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেক্টরবধ এর মতো বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

মধুসূদন দত্ত নাট্যকার হিসেবেই প্রথম বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে পদার্পণ করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি রচনা করেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। একটি পৌরাণিক নাটক। এটিই আধুনিক পাশ্চাত্য শৈলীতে রচিত প্রথম বাংলা নাটক।

নাটকের আখ্যানবস্তু মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত রাজা যযাতি, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনী থেকে গৃহীত। অবশ্য পাশ্চাত্য নাট্যশৈলীতে লিখলেও, মাইকেল এই নাটকে সংস্কৃত শৈলীকে সম্পূর্ণ বর্জন করেননি।

এই নাটকের কাব্য ও অলংকার-বহুল দীর্ঘ সংলাপ, ঘটনার বর্ণনাত্মক রীতি, প্রবেশক, নটী, বিদুষক প্রভৃতির ব্যবহার সংস্কৃত শৈলীর অনুরূপ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের রোম্যান্টিক ধারার প্রভাবও এই নাটকে স্পষ্ট। প্রথম রচনা হিসেবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও, সেই যুগের ইংরেজি-শিক্ষিত পাঠ কসমাজে এই নাটকটি খুবই সমাদৃত হয়। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে নাটকটি অভিনীতও হয়।

১৮৬০ সালে রচনা করেন দুটি প্রহসন, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ এবং পূর্ণাঙ্গ ‘পদ্মাবতী’ নাটক। পদ্মাবতী নাটকেই তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। একের পর এক রচনা করেন, মেঘনাদ বধ কাব্য’ (১৮৬১) নামে মহাকাব্য, ‘ব্রজাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬১), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতা (১৮৬৬)।

মেঘনাদবধ কাব্য মাইকেল মধুসূদনের এক অনন্য সৃষ্টি। মধুসূদন দত্তের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে–অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যটি। চরিত্র-চিত্র হিসেবে–রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, সীতা, সরমা, প্রমীলা প্রমূখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *