বাঙালি, বাংলা, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা

মোঃ মেজবাহুল ইসলাম


১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করার পর মাত্র ২২দিনের মাথায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে একাধারে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দেন।

একই ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণ আইয়ুবীয় স্টাইলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ করিয়ে নিজে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক,এবং নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বি.এন.পি প্রতিষ্ঠা করেন।

একইভাবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় পার্টি।আরবের ক্যানসার হিসেবে খ্যাত ইসরাইলের মতো আমেরিকা তৈরি করে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলাম। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দলটি এর বিরোধিতা করলেও হালে পানি পায়নি।

১৯৪৭ সাল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের তাবেদারি করার ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঘৃণ্যভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেও জিয়াউর রহমানের বদ্যনতায় দলটি আজও বাংলাদেশে মোটামুটি সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে টিকে আছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে যে সকল ক্রিয়াশীল দল টিকে আছে তার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই একক এবং একমাত্র দল যেই দলটি জনগণের মাধ্যমে গড়ে উঠে এবং ৭১ বছর জনসাধারণকে নিয়ে দলটি উপমহাদেশের রাজনীতিতে সগৌরবে টিকে আছে।

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক আলাদা দুটি রাষ্টের অভ্যুদয় হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। জনসাধারণের মতামত না নিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ এর বিরোধিতা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি দাওয়া পূরণের জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইয়ার মুহম্মদ খানের রোজ গার্ডেনে ২০০/৩০০ কর্মী নিয়ে গঠন করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।মওলানা হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদকে যুগ্ম সাধারণ করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। ১৯৫০ সালের দুর্ভিক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ খাদ্য বিতরণ করে ও ভুখা মিছিল বের করেছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের জন্য ৩দিন টানা অনশন করেন।১৯৫২ সালের ২৬শে এপ্রিল দীর্ঘ বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের জন্য সারাদেশ চষে বেরাতে শুরু করেন।এসময় জনাব শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিব ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।

১৯৫৩ সালের ১৬ই নভেম্বরের কাউন্সিলে শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এককভাবে ১৪৩ আসনে জয় লাভ করে। ১৯৫৫ সালের ২১শে অক্টোবর বিশেষ অধিবেশনে ধর্মনিরপেক্ষতা অংশ হিসেবে “মুসলিম” শব্দটি প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।এর প্রতিবাদে খন্দকার মোশতাক আহমেদ দল থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের বিদেশ নীতি নিয়ে দ্বন্দ্বে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে এবং তাঁর সাথে অনেকেই দল ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করে।সে সময় মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করা হয়।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে ও সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।১৯৫৮ সাল থেকে ৬ দফার দেয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জনগণের ও ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছিল।১৯৬৬ সালে বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ৬ দফা শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেকেই আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৬৬ সালের ১৮ই মার্চ কাউন্সিলে শেখ মুজিব সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।৬ দফাকে আওয়ামী লীগের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ৬ দফার ব্যাখ্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ৩০দিনে ৩২ টি জনসভা করে।৬ দফায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পড়ে ফলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ৬ দফা নিয়ে কাজ করতেই থাকে।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থাতেই তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয় এবং ক্যান্টনমেন্টে তাঁর বিচার কার্য শুরু করলে সারাদেশে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পরে ফলে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ২২শে ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। ২৩শে ফেব্রুয়ারি জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎকালীন ডাকসু ভি.পি তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন।১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা নিয়ে সারাদেশে প্রচারণা শুরু।

৭০ সালের ৪ জুন আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে এককভাবে নির্বাচন অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ও ঝড়ে ১০/১২ লাখ মানুষ মারা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ত্রাণ কার্যে ঝাপিয়ে পড়ে।৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে একক সংখ্যাগটিষ্ঠতা পায়। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের এ বিশাল জয় মেনে নিতে পারেনি ফলে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারা নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৯ মাসে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা- বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সরকার পরিচালনা করতে থাকেন।১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে জেলের ভিতরে নির্মম ভাবে হত্যা করার ফলে আওয়ামী লীগে দলটির উপর ঘোর অমানিশা নেমে আসে।দলটি চরম নেতৃত্ব সংকটে পড়ে।

সেসময় সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে জিয়া প্রশাসনের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সারাদেশ চষে বেড়ান।১৯৮১ সালের ১৫-১৬ ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সংহতি ও আওয়ামী লীগ রক্ষার জন্য শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং সে বছরের ১৭ই মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে পিতার মত সারাদেশে চষে বেড়াতে শুরু করেন।

সেসময় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বেশ কয়েকটি সশস্ত্র হামলা করে স্বাধীনতা বিরোধীরা।১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল এবং ৯১ সালে নির্বাচনে ৮৫টি আসন নিয়ে বিরোধী দল হয়।নির্বাচনে ব্যর্থতার জন্য শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন কিন্তু জনতার ক্রমাগত চাপে পুনরায় স্বপদে বহাল থাকে। ৯১ সালেই প্রলংয়কারী ঝড়ে উপকূলীয় মানুষের পাশে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ান।

বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলে এর প্রতিবাদে আবার রাজপথে গণ আন্দোলন গড়ে তুলেন আওয়ামী লীগ। ফলে ৯৬ এর ১২ই জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬ টি আসন পেয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে।সে সরকারের সময়ই বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোটবদ্ধ ভাবে নির্বাচন করে পুনরায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের উপর নজীরবিহীন নির্যাতন করে।

পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১/১১ সরকার গঠন করে এবং ২০০৮ সালে ২৯শে ডিসেম্বর নির্বাচন দেয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পায়।২০০৮ সালের পর থেকে আজও আওয়ামী লীগের সরকার প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যার নেতৃত্ব বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও দেশের বড় বড় মেগা প্রকল্প আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে। মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

লেখকঃ মোঃ মেজবাহুল ইসলাম
সহ-সভাপতি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *