মতিহারের অরণ্য বিলাস

মতিহারের অরণ্য বিলাস

অনেক দিন হল, চারিদিকে চলছে বিরুদ্ধ সময়। কম-বেশি সবাই নানাবিধ ভয়ে ভীত। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে একের সাথে অপরের মানসিক দূরত্ব। একঘেয়েমি ব্যস্ত জীবন আর গুমট ভীতি ছেয়ে ফেলছে সবাইকে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। একটু প্রশান্তি খোঁজার জন্য তাই ভাবছিলাম, ঘুরে আসি কোথাও থেকে।

কিন্তু হয়ে উঠছিল না কিছুতেই। অবশেষে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা তিন বন্ধু বেড়িয়ে পরলাম প্রাণের টানে প্রিয় মতিহার, প্রিয় ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। মনে মনে ছাত্রছাত্রীর কোলাহল বিহীন নির্জন একটি ক্যাম্পাসের কল্পচিত্র নিয়েই শুরু করলাম যাত্রা; সাথে সাম্প্রতিক সময়ে প্রিয় ক্যাম্পাস নিয়ে অনলাইনে পাওয়া কিছু বিরূপ সংবাদ।

যেমন কেটে ফেলা হয়েছে পুরনো পাম গাছ; ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি ইত্যাদি। ভেবেছিলাম চারিদিকে বোধয় শুধুই অযত্ন, অবহেলা আর ঘন আগাছার জঙ্গল । কিন্তু ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ঘোর কাটতে শুরু করলো। অভিভূত হতে থাকলাম বিস্ময়ে।

মতিহারের অরণ্য বিলাস

প্রথমেই চোখে পড়লো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা কয়েকটি পাম গাছের মৃত কঙ্কাল। কিন্তু ভালোভাবে তাকাতেই চিরচেনা এই জায়গাটিকে কেমন অচেনা মনে হলো। এতোটা প্রশস্থ সবুজ জায়গা আগে কখনো এখানে দেখেছিলাম কিনা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। সারি সারি তরুণ রয়েল বোতল পাম গাছ যেন মাথা উঁচিয়ে নতুনদের অভিবাদন জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সৌন্দর্যকে আরও পূর্ণতা দিয়েছে রক্ত লাল বিশ্ব সুন্দরি গোলাপ গাছের সারি।

মীর মোস্তাক এলাহী এবং অন্যান্য শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে নির্মিত হয়েছে সুদৃশ্য ফলক। অযত্নে অবহেলায় পরে থাকা শহীদ জোহার সমাধিক্ষেত্রটি এখন নিবিড় পরিচর্যায় ফিরে পেয়েছে এক নতুন রূপ। পূর্ণিমার রাতে মেইন গেট থেকে প্রশাসনিক ভবন কে দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম।

প্যারিস রোডের ভেঙ্গে পড়া গগন শিরিষ (Wild Tamarind) এর পাশে স্থান করে নিচ্ছে বয়সে তরুণ কাঠবাদাম গাছ। প্রতিটি গাছে খুব সুন্দর করে স্থানীয় নাম, ইংরেজি নাম এবং বৈজ্ঞানিক নামের ফলক লাগানো হয়েছে। জিমনেশিয়াম এর পাশে পরিত্যক্ত যায়গায় গড়ে উঠেছে সুবিশাল ঔষধি গাছের বাগান। যেখানে রয়েছে আমলকি, হরিতকী, বহেরা, বেল, জলপাই সহ নানাবিধ গাছ। প্রাতঃভ্রমণে ক্লান্ত পথচারীদের জন্য করা হয়েছে বসার সুব্যবস্থা।

মতিহারের অরণ্য বিলাস

এরপর সুইমিংপুলের পাশে যেতেই আমাদের চোখ আটকে গেলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৪ তম জন্মদিনে রোপণ করা শান্তি বৃক্ষের দিকে। সারি সারি গাছ যেন সকলকে শান্তির আহ্বান জানাচ্ছে এবং পাশে নতুন তৈরি ছোট্ট লেকে শোভা পাচ্ছে পদ্মফুল। জোহা হল থেকে বধ্যভূমির দিকে যেতেই নতুন স্থাপিত একটি ফলক যেন আমাদেরকে অন্য এক অরণ্যের দিকে নির্দেশ করছিলো। শতবর্ষে শতপ্রাণ, আম্রকানন, মতিহার উদ্যান, সফেদা বাগান সহ নানাবিধ গাছের সমাহার । ভাবছিলাম এটা কি আমাদের সেই পরিচিত ক্যাম্পাস নাকি অন্য কোনো জায়গা।

বধ্যভূমির রাস্তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৩ তম জন্মদিনে লাগানো ৭৩ টি গাছ যেন ছায়া দিয়ে চলেছে সকল পথচারীদেরকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে লাগানো হয়েছে ১০০ টি নানান জাতের আমের গাছ, যেটির নাম “শতবর্ষে শতপ্রাণ”। নিজেকে গর্বিত মনে হলো; জাতির পিতার প্রতি এর চেয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা আর কি হতে পারে! এর আগে এত নয়নাভিরাম সফেদার বাগান দেখিনি কখনও। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে চলছিলাম সুইপার কলোনির দিকে। এগিয়ে যেতেই পুরাতন অনেক স্মৃতি মনে পরছিলো।

মতিহারের অরণ্য বিলাস

গভীর রাতে নির্জন মাঠে শুয়ে শুয়ে চন্দ্রগ্রহণ দেখা, খুব ভোরে উঠে পাখি দেখতে যাওয়া, গভীর জঙ্গলে বনভোজন, একতারা হাতে গান গাওয়া কিংবা পাম্পের পানিতে স্নান করা। এই জায়গাটি ছিলো আমাদের খুব পছন্দের, কারণ এখানে ছাত্রছাত্রীদের পদচারণ প্রায় ছিলোনা বললেই চলে। অনেকটা প্রাইভেট প্রোপার্টির মতো ব্যবহার করতাম আমরা। কিন্তু এখানে আসতেই চোখে পড়লো এক পরিচ্ছন্ন অরণ্যের। মনে হচ্ছিলো এ যেন এক ছায়া সুনিবিড় সুবিশাল এক অক্সিজেন ব্যাংক। নামটাও চমৎকার “মতিহার উদ্যান”।

পুরো ক্যাম্পাস ঘুরতে ঘুরতে আমরা যেন এক মোহময় ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম। পরিত্যক্ত ডাস্টবিন গুলো হয়ে উঠেছে এক একটি সবুজ বাগান। কোথাও দেখছি মালীরা গাছগুলোতে পানি দিচ্ছেন পরম যত্নে, কোথাও বা আধুনিক যন্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাস কাটা চলছে। মালীদের কর্ম তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। এমন কি টিএসসি’র পাশে গাছ ভর্তি আমলকী দেখে যখন লোভ সামলাতে পারছিলাম না তখন পুরাতন অভ্যাসে ভাবলাম কয়েকটা আমলকী পাড়ি; কিন্তু গাছের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই একজন ছুটে এসে বললো ” এখন আমলকী পাড়া নিষেধ!বড় হোক, তারপর খাবেন “।

মতিহারের অরণ্য বিলাস

বিশ্ববিদ্যালয়ের কবরস্থান এর পাশেও গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল আম্র কানন। সত্যিই এ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। আরও একটা বিষয় আমাদের নজর কেড়েছিলো; সেটা হলো কৃষি প্রকল্পের সাইনবোর্ড। এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে চলছে এই মতিহার অরণ্যের নিবিড় পরিচর্যা। মনে হচ্ছিলো কেউ একজন আছেন এর পিছনে যার পরম মমতা, ভালোবাসা, সুনিপুণ দিকনির্দেশনা আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় বেড়ে উঠছে এই সাজানো অরণ্য।

পরিকল্পিত এই অরণ্যে পাখিরাও জানান দিচ্ছে তাদের আগমন বার্তা। তাদের কলকাকলিতে ক্রমেই ভরে উঠছে মতিহারের প্রাণ প্রকৃতি। এসব দেখতে দেখতে কখন যে আমাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারিনি। শেষ হয়ে গেল আমাদের মতিহারের অরণ্য বিলাস। এই বৈরী সময়েও একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ফিরে চললাম সেই কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক নগরীর উদ্দেশ্যে। ভালো থাক প্রিয় ক্যাম্পাস, ভালো থাক মতিহার অরণ্য, ভালো থাক অক্সিজেন ব্যাংক…

তপু, সায়েম , হুমায়ন
একটি ত্রিভুজ প্রয়াস
https://www.facebook.com/trivuj2020

সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment