মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় এসএসসি পরীক্ষা-২০২০: অপ্রতুল কেন্দ্র ও অনিয়মের অভিযোগ
আবু জাফর আহমেদ মুকুল
স্থানীয় অভিভাবক, সচেতন প্রতিনিধি, প্রশাসন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের সাথে কথা বলে বুঝলাম। বাংলাদেশের অন্য জায়গার মতো গজারিয়ায় এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধির জন্য চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকবৃন্দ নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি গজারিয়া উপজেলায় শিক্ষকগণের সাথে কথা বলে জানা গেছে পাসের হার ও মান সম্মত শিক্ষার বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।
গজারিয়ায় সর্বমোট ১৮টি হাই স্কুল ও ৫টি মাদ্রাসা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলায় প্রায় ২ হাজার ৮’শত শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র ২টি কেন্দ্রে একটি গজারিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং অপরটি ভরেরচর ওয়াজীর আলী উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গজারিয়া পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রায় ৮ ‘শত জন শিক্ষার্থী এবং ভরেরচর ওয়াজীর আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। পরীক্ষার দুইটি কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনা, কতিপয় স্কুলগুলোর যোগসাজসে ভাল ফলাফল ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে অভিভাবক ও সচেতন মহলে। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, এমপিও ভুক্ত টিকে রাখার জন্য কেন্দ্র নিয়ন্ত্রক হাই স্কুলগুলো অন্য স্কুলের সাথে যোগসাজশে ভিজিলেন্স টিমকে আড়ালে রেখে স্ব স্ব স্কুলের পাশের হার ৯০ এর উর্ধে রাখার জন্য অনেকে কাজ করেছেন।
বাস্তবে ঘটনার কিছুটা সত্যতাও মিলেছে। ঢাকা বোর্ডে পাসের হারের তুলনায় গজারিয়ায় এসএসসিতে পাশের হার বেশি হলেও স্থানীয় অভিভাবক, সচেতন প্রতিনিধি, সাবেক ও বর্তমান ছাত্ররা নানা কারনে এই ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এমনকি মুন্সিগঞ্জের অন্য উপজেলায় থেকেও পাসের হার বেশি। সচেতনমহলের বিশ্বাস, কেন্দ্রের স্কুলগুলোতে শিক্ষকগণ ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে পাসের হার কখনোই ৮০% এর বেশি হতো না। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্কুল জীবনে এগুলো পর্যবেক্ষণ করে অনিয়মের মধ্যে বড় হচ্ছে।
বিনয়ের স্বরে বলছি, কতিপয় শিক্ষক বা অভিভাবক যারা আজকে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে বা নিচ্ছে তাদেরও কী কোন বিবেক, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। আর উপজেলার স্থানীয় প্রশাসন অনেক বছর একই উপজেলায় কাজ করছেন তারা সব কিছু জেনেও চুপ এটাও এলাকাবাসীর পক্ষে বোধগম্য নয়।
গজারিয়া ৫টি হাই স্কুল প্রায় কুমিল্লার দাউদকান্দির পাশে অবস্থিত। তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও পরীক্ষার কেন্দ্র বাড়ানোর জন্য কোন ব্যবস্থা নেননি স্থানীয় প্রশাসন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্গম এলাকা ও নদী পার হয়ে কষ্ট করে পরীক্ষার কেন্দ্রে আসা লাগে। হাই স্কুলগুলো হলোঃ গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, বসুরচর পাঁচ গাও উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল উচ্চ বিদ্যালয়, বাউশিয়া এম.এ আজহার আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও পোড়াচক বাউশিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
পরবর্তীতে আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব হাসান সাদী এবং উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আমিরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিলাম। উপজেলা চেয়ারম্যান কেন্দ্র বাড়ানোর জন্য স্কুলগুলোতে আবেদন করেলে তিনি বাউশিয়ায় কেন্দ্র করার জন্য ব্যবস্থা নিবেন বলে আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন।
সচেতন মহলের অনেকেই স্বীকার করেছেন, উপজেলায় অধিকাংশ স্কুলগুলোতে টেস্ট পরীক্ষায় পাস না করলেও গভর্নিং বডি টাকার বিনিময়ে এসএসসি পরীক্ষার সুযোগ দিচ্ছেন এবং স্কুলগুলোর সভাপতি ক্ষমতার দাপটে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন। এ বিষয়ে গত জানুয়ারী ৮, ২০১৭ইং তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজতে এবার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তবে আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই গজারিয়া হাই স্কুলের সমস্যা ও সমাধানগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন এবং সমাধানগুলো বাস্তবায়ন করে হাই স্কুলগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
গজারিয়া উপজেলায় হাই স্কুলসমূহে সমস্যাগুলোর সমাধানগুলো- স্থানীয় অভিভাবক, সচেতন প্রতিনিধি, প্রশাসন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের সাথে কথা বলে গজারিয়া উপজেলার হাই স্কুলসমূহে নানা সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই উপরোক্ত বিষয়গুলো সকলের প্রচেষ্টায় নিম্নোক্তভাবে সমাধান করা যেতে পারেঃ
১) স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি সংস্কার করে সৎ ও শিক্ষিত এবং নিবেদিত প্রানের লোককে হাই স্কুলের সভাপতি করা।
২) শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম রোধ করার জন্য আগামি বছর এসএসসি পরীক্ষায় ভেন্যু স্কুলের কেন্দ্রসমূহ পরিবর্তন করে অন্য কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ভিজিলেন্স টিমকে শক্তিশালী করা। কোন স্কুল শিক্ষক অসুদুপায় কাজে সাহায্য করলে তাকে বহিস্কারের ব্যবস্থা করা।
৩) এসএসসি পরীক্ষায় পরীক্ষা হলে সিসিটিভি লাগিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উর্ধতন সকল স্তরের শিক্ষা কর্মকর্তাগণ তদারকি করতে পারেন এবং ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে স্কুলের একইভাবে উপরোক্ত কর্মকর্তাগণ সার্বিক কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করা।
৪) উপজেলায় ২টি কেন্দ্রের পরিবর্তে কমপক্ষে ৫টি কেন্দ্রে এসএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৫) শিক্ষক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, ক্লাস ও শিক্ষার মান মনিটরিং এবং স্কুলের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল হাজিরা ও শিক্ষা অফিসারদের সাথে অনলাইনে মনিটরিং ব্যবস্থা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ।
৬) স্থানীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা। খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগে নিবন্ধনকারীকে নিয়োগ দেওয়া। নিয়োগ বোর্ডে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে অর্ন্তভুক্ত করা।
৭) সরকারের ইশতেহারে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্যে স্থানীয় স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ বা অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবি সমন্বয়ে প্রত্যেকটি স্কুলে আলাদা উপ-কমিটি, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা নির্ধারনের জন্য স্থানীয় সৎ ও শিক্ষিত লোক দ্বারা উপ-কমিটি এবং সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য সামাজিক সচেতনা কমিটি করা যেতে পারে।
৮) কতিপয় শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানের চাইতে টিউশন বা কোচিংয়ের জন্য বেশী মনোযোগী থাকেন এবং গাইড বইয়ের প্রতি গুরুত্ব বেশি দেয় বলে দৃষ্টি গোচর হয়েছে। এ প্রবনতা দূর করা প্রয়োজন।
৯) দুর্বল ছাত্রদের জন্য স্কুলে বিশেষ ক্লাস চালু করা প্রয়োজন এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে ক্লাসে পাঠদানের মান নিশ্চিত করা।
১০) যে শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন, সে ওই ক্লাসের শিক্ষককে খাতা দেখার সুযোগ না দেওয়া, প্রয়োজনে স্কুলে শিক্ষার মানের জন্য বহিঃস্থ শিক্ষক কর্তৃক খাতা মূল্যায়ন এবং পরীক্ষায় মডারেশন করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে প্রশ্নপত্র সংরক্ষন করা। সর্বোপরি, প্রত্যেক ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষায় খাতায় শিক্ষার্থীদের নামের পরিবর্তে কোডিং ব্যবহার করা।
১১) কোন শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত হলে অভিভাবককে সাথে সাথে অবগত করা এবং ক্লাস থেকে ড্রপ আউট হলে সরাসরি তার বাসায় গিয়ে শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করানো।
১২) বিজ্ঞানে ও আইটি বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া অথবা, যারা আছেন তাদেরকে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্পেশাল ট্রেনিং দিয়ে শুধু দক্ষ করে তোলা। প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়া যায়।
১৩) বিষয়ভিত্তিক এমপিওভুক্ত শিক্ষক অপ্রতুল। সুতরাং অধিক সংখ্যক চাহিদা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রদান করা।
১৪) উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজারকে নিয়মিত একাডেমি সুপারভাইজ করার অনুরোধ করা এবং তার নিকট হতে শিক্ষকদের সম্পর্কে ফিডব্যাক নেওয়া।
১৫) প্রাক্তন শিক্ষার্থী যারা বিজ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এবং সমাজের সুশীল সমাজ বা অবসরপ্রাপ্ত চাকুরিজীবি বা স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ তাদের থেকে দক্ষ ও যোগ্যদের নিয়ে তাদের সুবিধামত সময়ে স্বেচ্ছায় দিনব্যাপী ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
১৬) টেস্টে ফেল করা শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষা দিতে অনুমতি না দেওয়া এবং অন্য স্কুলের ফেল-কৃত শিক্ষার্থীদের সুযোগ না দেওয়া।
১৭)শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের বাইরে নিতে হবে, তাদের জ্ঞানমুখী করতে হবে যেমন- ক্রীড়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, জাতীয় দিবস উদযাপন, বইপড়া প্রতিযোগিতা, মা দিবস, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বিদ্যালয়ে খুদে লাইব্রেরি বা বুক কর্নার স্থাপন করতে হবে। এতে ছাত্রদের মানবিক বিকাশ বাড়ে। মাস শেষে বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ পাঠককে পুরস্কার দিতে হবে।
১৮) উপজেলায় কয়েকটি হাই স্কুলে কারিগরি ইউনিট চালু করা।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক, ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণায় প্রধানমন্ত্রীর স্কলারশীপ প্রাপ্ত।