মুন্সিগঞ্জে প্রাইমারী স্কুল থেকে কলেজ পর্যায়ে ধ্বংসের আওয়াজ শুনি: অশিক্ষিত ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পেশি শক্তি ও অনিয়মের দাপটে অসহায় সকল পক্ষ

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


মুন্সিগঞ্জে জেলার ওয়েবসাইট অনুযায়ী সরকারি-বেসিরকারি মিলিয়ে সর্বমোট প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৪৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৯৯টি, কলেজ ১৩টি, ও মাদ্রাসা রয়েছে ২৯টি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পূর্ণ হয়ে গেলেও মুন্সিগঞ্জ জেলার ৬টি উপজেলায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সমর্থনপুষ্ট প্রভাবশালীব্যক্তিরা।

ব্যবস্থাপনা কমিটি বা গভর্নিং কমিটির নির্বাচনে প্রার্থীরা এখন লাখ লাখ টাকা খরচ করেন ৷ পোস্টার ছাপানা অনেক টাকা খরচ করে চালান প্রচারণা, কারণ, নির্বাচিত হতে পারলে অনেক লাভ ৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, এর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ আর্থিক বিষয়ে নেতারা সম্পৃক্ত হওয়ায় বড় বা সচ্ছল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

এসব কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, “প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী নিয়োগ দিয়ে যারা টাকা নেয়, তেমন নেতার প্রয়োজন নেই তাদের।”

আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকদের অনেকেই প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছেন। শিক্ষকগণ চাকুরি যাওয়ার ভয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির লেজুড়বৃত্তি করে আর নাহলে স্থানীয়দের তোপের মধ্যে থাকতে হয় ।

এজন্য গত বছর ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ইং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, ”ম্যানেজিং কমিটির অশিক্ষিতরা শিক্ষকদের ওপর বেশি কর্তৃত্ব ফলান।”

বিষয়টি এতদিন পর আমাদের শিক্ষা উপমন্ত্রী অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে ব্যক্তিগতভাবে খুশি। তিনি বিষয়টি শুধু অনুধাবনই করেননি, বরং আরও বলেছেন, শিক্ষকদের সম্মান দেওয়ার মতো শিক্ষিত লোক ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে “ শিক্ষা উপমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা আশাবাদী। বহুদিন পর আমরা একজন ভালো, উচ্চশিক্ষিত মন্ত্রী পেয়েছি এবং তার হাত ধরেই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

সরকারি নিয়ম অুনসারে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সভাপতি হওয়ার ন্যূণতম যোগ্যতা স্নাতক পাশ থাকলেও জেলায়প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা মানা হচ্ছে না। জেলা শিক্ষা অফিস এর ওয়েবসাইটে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও বোর্ডের ফলাফল সম্পর্কে কোন আপডেট তথ্য নাই যা ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে সাংঘর্ষিক। উপজেলা লেভেলে শিক্ষার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট অফিসার নিয়মের কথা বললে স্থানীয়দের তোপের মধ্যে পড়তে হয় বলে অনিয়মটা বছরের পর বছর তারা মেনে নেন।

স্থানীয় প্রশাসন, সরকারের মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য উদাসীন, তারা প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ দ্বারা এখন পর্যন্ত কোন কমিটি গঠিত হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন যার ফলে সাম্প্রতিককালে জেলায় এসএসসি ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে।

কেউ কিছু প্রতিষ্ঠানের মান বাড়ানোর চেষ্টা করলে ম্যানেজিং কমিটি সমালোচনাকে আমলে নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নিজেই অনেক সময় তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হন, তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য তার অনুগত শিক্ষক এমনকি স্কুল ত্যাগী শিক্ষকদেরও কাজে লাগান এবং এলাকার গণ্যমান্য প্রাক্তন ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলেন এ অভিযোগ স্বয়ং স্থানীয় এলাকার সচেতন নাগরিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুস্পষ্ট কিছু অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে স্বয়ং জেলার শতবর্ষী স্যার জেসি বোস ইনস্টিটিউশন, ভাগ্যকুল হরেন্দ্রলাল উচ্চ বিদ্যালয়, রায় বাহাদুর শ্রীনাথ ইনস্টিটিউশন, ব্রাহ্মণগাঁও বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, স্বর্ণগ্রাম আরএন উচ্চ বিদ্যালয় এবং সোনারং বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। যার ফলে শতবর্ষী স্কুলগুলোর ইতিহাস ও এতিহ্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে। ধস নেমেছে শিক্ষার্থীদের পাসের হার ও শিক্ষার মানে।

অভিভাবকগনের দায় বেশি, তার কারন ছাএ-ছাএীরা খারাপ রেজাল্ট করার পরও কতিপয় অভিভাবকগন তদবির করে দুই তিন বিষয় ফেল করা শিক্ষার্থীদের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির মাধ্যমে বোর্ড পরিক্ষার অনুমোদনের চাপ দিলে শিক্ষক বাধ্য হয়ে অনুমোদন দেন।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কামিটিতে এখন আর শিক্ষানুরাগী পাওয়া যাবে না, কারণ, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি বাণিজ্য আর উন্নয়নমূলক কাজে এখন অনেক টাকা৷ সেই টাকার লোভে কমিটিগুলো দখল করেছে রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা৷” তাঁর মতে, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এবং শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার নেতৃত্বে আসা উচিত। প্রবিধানে এই সুযোগ থাকলেও রাজনৈতিক চাপে তাঁরা হারিয়ে যান।”

অনেকেই টাকায় পরিমাপ করে ম্যানেজিং কমিটিতে অশিক্ষিত প্রভাবশালী নেতা বা ব্যবসায়ীকে সভাপতি করেন নিজেদের সুবিধার জন্য। যার ফলে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কোন শিক্ষা পরিকল্পনা না থাকায় মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রম তদারকি প্রয়োজন অর্থাৎ জবাব দিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আর নাহলে মুন্সিগঞ্জের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস অবস্থায় চলে যাবে।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর এই মেরুদন্ড সোজা রাখতে হলে প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ পর্যায়ে ম্যানেজিং কমিটিতে স্থানীয়দের অপরাজনীতি প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। যারা রাজনীতি করতে চান তাদের প্লাটফর্ম আলাদা। এখানে ম্যানেজিং কমিটিতে দরকার উচ্চ শিক্ষিত, সৎ ও নিবেদিত লোক যারা শিক্ষা বুঝে ও এটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের সন্তানদের আমরা অশিক্ষিতদের ব্যবস্থাপনায় শিক্ষিত করতে চাই না। প্রত্যাশা করি, সরকার কর্তৃপক্ষ দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আমরা চাই, আমাদের সন্তান কোনো অশিক্ষিত ও অসৎ মানুষের ব্যবস্থাপনায় নয়; বরং সুশিক্ষিত ও ভালো মানুষের ব্যবস্থাপনায় বড় হোক। আশা করি, মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় প্রশাসনের অচিরেই ঘুম ভাঙ্গবে।

  • লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *