মেয়েরা সব ক্ষমা করে, কিন্তু ভালোবাসার অপরাধীকে ক্ষমা করে না

জামান সানি


জীবন এক অস্বস্তিকর মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে রাশেদকে। যেই রিনা, তার কৈশোরের দুরন্ত এডভেঞ্চারের সঙ্গী ছিলো। তার প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেম ছিলো, সেই রিনাই আজ তার সামনে বিয়ের পাত্রী সেজে বসে আছে।

তবে তার পাত্রী না , সবচেয়ে কাছের বন্ধু তাওসীফের পাত্রী হিসেবে। আজ রিনা এবং তাওসীফের আংটি বদল অনুষ্ঠান। হাতে গোণা কিছু অতিথি, উভয়পক্ষের শুধু কাছের আত্মীয় আর খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু মাত্র। রাশেদ বসেছে তাওসীফের ঠিক পাশেই।

রিনাকে দেখে রাশেদ স্তম্ভ হয়ে গেলেও, রিনা খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। এমনকি বেশ কয়েকবার “ভাইয়া” সম্বোধন করে কুশলও বিনিময় করেছে। রাশেদ বোকার মতো তাকিয়ে ছিলো শুধু, কোন উত্তর দেয়নি।

সাধারণত প্রথম যৌবনে ছেলেদের যে প্রধান দুটি সমস্যা সেগুলো হলো , খুব বেশি পজেসিভনেস এবং ন্যুনতম দায়িত্বশীলতার অভাব। দুটো জিনিসই অতি মাত্রায় বেশি ছিলো রাশেদের। সে তুলনায় রিনা ছিলো তুলনামূলকভাবে ম্যাচিউরড চিন্তাভাবনার এবং সহিষ্ণু।

খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছিলো সে রাশেদকে। বলা যায় একা সেই সম্পর্কটা টেনে নিয়ে চলেছিলো পুরো চারটি বছর। কিন্তু স্কুল কলেজ পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিতেই রাশেদ তার নাগালের বাইরে চলে যায়। তার চোখে তখন রঙ্গিন চশমা। ডিজুস মোবাইলের সারারাত অফারে জুটিয়ে ফেলে বেশ কয়েকজন মেয়ে বন্ধুও।

শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কটি টিকেনি। কারণ রাশেদ চায়নি টিকুক। চারুকলার মোড়ে বসে আড্ডারত চে গুয়েভারার ছবি সম্বলিত টিশার্ট পরা মেয়েটির মাঝে রাশেদ যেই আবেদনটি পেতো, সেই আবেদন তো মফস্বলে বেড়ে উঠা রিনার মাঝে সে পেতো না।

আর হটাৎ এতো বড় শহর, ছেলে মেয়ে অবাধ বন্ধুত্ব, হাই থট, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বিনোদনের পর্যাপ্তটা.. এতো সব জিনিস একসাথে পেয়ে রাশেদ ঠিক সামলে উঠতে পারছিলো না। সে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে পারছিলো না। তবে এতটুকু বুঝেছিলো যে রিনার সাথে তার সম্পর্কে জড়ালে পোষাবেনা।

রাশেদের জীবনের এরপরের কয়েকটি বছর কেটেছে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো। পড়ালেখায় অমনোযোগিতা, রাতভর মোবাইলে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা , ইন্টারনেট , চ্যাটিং, লাল নীল সিনেমা, ধোঁয়া এবং আসরে।

তবে ঠিক সময় মতো নিজেকে ঠিকই শুধরে নিয়েছিলো রাশেদ। হাজার হোক , যেই ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে আসছিলো , মাত্র দুই তিন বছরের বখে যাওয়ায় সব মিথ্যা হয়ে যাবে না অনার্সে চমৎকার রেজাল্টসহ বেশ কয়েকটি ইভেন্ট চ্যাম্পিয়ন। মাস্টার্সে গোল্ড মেডালিস্ট।

কিন্তু সম্পর্কের ব্যপারে রাশেদ সবসময়ই ক্যাজুয়াল, no commitment type. রিনার পর ডজনখানেক সম্পর্ক হয়েছে তার , প্রতিটি সম্পর্কে বহু ধরনের এটাচমেন্ট হলেও , এক মুহূর্তের জন্য সে কারও প্রতি মেন্টাল এটাচমেন্ট অনুভব করেনি।

মাঝে মাঝেই রাশেদের রিনার কথা মনে পড়তো। ভাবতো খোজ খবর রাখবে , কোন কারণে না , প্রাক্তন প্রেমিকা ভেবেও না , শুধু ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে। কিন্তু অনেকটা অপরাধবোধ থেকেই কখনোই যোগাযোগ করার মতো সাহস যোগাতে পারেনি রাশেদ। তবে মনে মনে রাশেদ চাইতো রিনার সাথে একদিন হুট করে দেখা হয়ে গেলে ভালো হবে।

তবে তাই বলে এভাবে দেখা হতে হবে? জীবন এতোটা প্রহসনমূলক হবার তো কথা না!

আজ রিনাকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে। প্রিয় কোন উপন্যাসের খুজে না পাওয়া অধরা নায়িকার মতো। তার কথাবার্তাও আর সেরকম টেনে বলা আঞ্চলিক উচ্চারণের নেই। রাশেদের এই ভেবে তাজ্জব লাগছে যে এরকম নিখুঁত পরিপূর্ণ নারী তাকে জীবনে কখনও ভালবেসেছিলো…

সেই ক্লাস সিক্সের পর আজ আবার রাশেদের খুব কান্না পাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে রিনা তার সাথে কিছুক্ষণ আগের মতো কথা বলুক। রাশেদের খুব ইচ্ছে করছে শুধু একটিবার রিনার হাতটি ছুঁয়ে দেখতে , একটিবার নিজের ভালবাসার কথা ব্যক্ত করতে। এরপর যেই শাস্তি আসুক সে মাথা পেতে নিবে। ফিনিক্স পাখির মতো আগুন ছুঁয়ে মরে যাবে , পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাবে।

এদিকে রিনা “ভাইয়া ভাইয়া ” করেই চলেছে।

বাঙ্গালী নারী সব ক্ষমা করতে পারলেও ভালোবাসার অপরাধীকে ক্ষমা করতে জানে না। সে রাশেদকে একদিনে মারবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে মারবে। রাশেদ তাকে যতটা কষ্ট দিয়েছে সে তাওসীফকে তারচেয়েও অনেক বেশি ভালবাসবে আজীবন। তাদের সফল সুখী দাম্পত্য জীবনকে খুব কাছ থেকে রাশেদকে দেখাবে।

অসহায়ত্বে ভোগাবে, শূন্যতায় ভোগাবে, আমরণ অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বালাবে। তার প্রতিটি অশ্রু বিন্দুর হিসেব নেয়ার সুযোগ জীবনই তাকে করে দিয়েছে , সে এই সুযোগ কোনভাবেই হারাতে চায় না।

মনে মনে আজও রিনা চায় , কষ্ট পেয়ে রাশেদ নষ্ট হয়ে যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *