রাজনৈতিক ব্যবহার থেকে ধর্ম মুক্ত হোক

অনুপ চক্রবর্তী


ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত এক গভীর বিশ্বাসের নাম। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের ব্যক্তিগত দর্শন নির্ধারিত হয় তাদের পালনকৃত ধর্মীয় নির্দেশনা দ্বারা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার পাশাপাশি দেশগুলোর মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে ভিন্নতা। এর মধ্যে বাংলাদেশ এবং ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিলেমিশে বাস করার ইতিহাস শত বছরের।

ধর্মীয় পরিচয়ে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বহুবছর ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য নিয়ে এক সাথে রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষেরা। এই ধর্মীয় সহাবস্থান পৃথিবীর অন্য অংশের মানুষের কাছে সম্প্রীতির এক উপযুক্ত দৃষ্টান্ত ছিল। কিন্তু সময় এবং হীন রাজনৈতিক চর্চায় এখানকার ধর্মীয় বিভেদে এখন সারা পৃথিবীর শান্তিকামীরা আতঙ্কিত।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে একেকটি দেশ ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় বিশ্বাসের দেশ হিসেবে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সরকারের বিভিন্ন নীতি এবং নেতাদের কর্মকান্ড দ্বারা। এ ধরনের ঘটনার একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ হল ইন্ডিয়া।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এ অঞ্চলে মোটেও নতুন কোন ঘটনা নয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সনে ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের জন্মের ভিতর দিয়ে। আরো পিছনে গেলে দেখা যাবে এই ধর্মীয় বিভাজনের বীজ বপন হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তাদের ভাগ কর, শাসন কর- নীতির বাস্তবায়নে।

ব্রিটিশরা খুব সূক্ষ্মভাবে এ অঞ্চলের প্রধান দুটি ধর্ম হিন্দু এবং মুসলমানদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফাঁয়দা লুটে গেছে যা রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের এক বাস্তব উদাহরণ। ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী সময় হতে অসংখ্যবার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের এক মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে এখানকার রাজনীতিবিদেরা। আর প্রতিবারই এর সরাসরি বলির স্বীকার হতে হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদেরকে।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশ ভিন্ন ভিন্ন হলেও সংখ্যালঘুদের বেদনা, তাদের অসহায়ত্ব, তাদের আর্তচিৎকারের ভাষা একই। যে ধর্মের মানুষ যে দেশে সংখ্যায় কম তারাই সেদেশে এই রাজনীতির ধর্মীয় প্রণোদনায় অত্যাচারের স্বীকার হয়। ধর্মের প্রতি এক গভীর বিশ্বাসের শ্রদ্ধা রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের। সংখ্যাগুরুর সেই বিশ্বাসকে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চাওয়াটাই রাজনীতিতে ধর্মের কৌশলগত ব্যবহার।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাজনৈতিক দলকে ইসলাম-বান্ধব এবং হিন্দু প্রধান দেশে হিন্দু-বান্ধব হিসেবে প্রমাণ করাটাই যেন এখানের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশের সকল ধর্মের, বর্ণের, মতের নাগরিকদের সামগ্রিক উন্নয়নে সরকারের কাজ করা উচিত। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করতে আসা প্রতিটি দলের উচিত সকল নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা। পৃথিবীর সভ্য-উন্নত দেশগুলো যেখানে সমতা, ন্যায্যতা, বিজ্ঞান, দর্শনে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে এই আধুনিক যুগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতির চর্চায় সকল ব্যবস্থার ধর্মীয়করণই যে মূল কাজ হয়ে রয়েছে এখনও।

ধর্মনিরপেক্ষতা- শব্দটির লোক দেখানো ব্যবহারের ফলে এটিকে হালকা মনে হলেও বিষয়টি সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান ধাপ এবং বহুধর্মের দেশে প্রথমও বটে। গণতন্ত্র যদি সকল জনগণের জন্য, জগণের দ্বারা এবং সকল জনগণের শাসন ব্যবস্থা হয়ে থাকে তাহলে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র সুযোগই থাকে না। বরং এটি নিশ্চিত করতে না পারাটাই গণতন্ত্রের বড় ধরনের পতন এবং সেটা সংখ্যাগুরুতন্ত্র; গণতন্ত্র নয়।

ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কোনোদিনই সুফল বয়ে আনেনি। প্রতিবারই কারণ হয়েছে রক্তক্ষয়ী ঘটনার। তাই ধর্ম এবং রাজনীতিকে আলাদা করেই দেখতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পরবর্তীতে আবার ক্ষমতায় আসার চিন্তায় ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের সন্তুষ্টি বিধানে বিভাজন সৃষ্টি না করে সকল নাগরিকের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করে যাওয়া উচিত। রাজনীতির মঞ্চে ধর্মকে এবং ধর্মীয় মঞ্চে রাজনীতিকে ব্যবহার করার চলমান সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া দরকার।

আর এটা হচ্ছে না বলেই দক্ষিণ এশিয়ায় একেক সময় একেক দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, খুন হচ্ছে, ঘটছে উপাসনালয়ে হামলার মত ঘটনা যা কোনো ধর্মীয় দৃষ্টিতেই সঠিক নয়। গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠা এবং অঞ্চল ভিত্তিক সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কূট রাজনীতির মোড়ক হতে মুক্ত হোক ধর্ম, সম্প্রীতি নিয়ে পৃথিবী এগিয়ে যাক নতুন নতুন সফলতার দিগন্তে; সংখ্যালঘুর উপাসনালয়ের চূঁড়ায় সংখ্যাগুরুর পতাকা নয়, সবার হৃদয়ে উড়ুক মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা।


লেখক: থিসিস শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *