রাজশাহী: ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ইসরাত জাহান ইতি


বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে দক্ষিণ পশ্চিমে রাজশাহী একটি বিস্মৃত জেলা।এই জেলা ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত । মোট আয়তন ২৪০৭.০১ বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিকভাবে রাজশাহী জেলার উত্তরে নওগাঁ জেলা, দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, কুষ্টিয়া জেলা ও পদ্মার বিশালতা হাতছানি দেয়, পূর্বে নাটোর জেলা, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা এবং শহরের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তরে আম্রকানন দিয়ে পরিবেষ্টিত।

এই পদ্মা নদীই রাজশাহীকে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে পৃথক করে রেখেছে। পদ্মানদীর তীরে যে শহরগুলো অবস্থিত তাদের মধ্যে রাজশাহী শহর সবচেয়ে বড়। এ শহরের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে দেশের প্রধানতম নদী পদ্মার প্রাণলীলা।

এটি হিমালয়ে উৎপন্ন গঙ্গানদীর প্রধান শাখা এবং বাংলাদেশের ২য় দীর্ঘতম নদী। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিলোমিটার। এখানে প্রধান নদী পদ্মা ছাড়াও রয়েছে মাথাভাঙা,পুনর্ভবা, বারনই নদী, রাণী নদী, কম্পো নদী ইত্যাদি।

এ শহরের প্রাচীন নাম ছিল মহাকাল গড়। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ রাজশাহীর জনবসতি হাজার বছরের পুরনো প্রথা ও ঐতিহ্য বহন করছে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, মোগল, ইংরেজরা এ অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তাই অনেকে মনে করেন, এ অঞ্চলে রাজা রাজড়াদের অবাসস্থলকে কেন্দ্র করে নামকরন হয়েছে রাজশাহী। আবার অনেকে মনে করেন, পঞ্চদশ শতকে ভাতুরিয়া দিনাজপুরের জমিদার রাজা গনেশ, এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তিনি রাজা শাহ নামে পরিচিতি ছিলেন।

তাই মনে করা হয় ‘রাজা’ আর ‘শাহ’ মিলে রাজশাহী নামকরণ কর্ হয়েছে। রাজাশাহী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটি ভিন্ন ভাষার একই অর্থবোধক দুটি শব্দ পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহ’ এর বিশেষণ ‘শাহী’ শব্দযোগে ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ রাজা-রাজকীয় বা বাদশাহ-বাদশাহী।

বাংলার নবাবী আমল ১৭০০-১৭২৫ সালে নবাব মুশির্দকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩টি চাকলায় ভাগ করেন। যার মধ্যে ‘চারুলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ এলাকা নির্ধারিত হয়। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুর্শিদ কুলির খুব বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধী দিয়েছিলেন ।

পদ্মার উত্তরাঞ্চল বিস্তীর্ন এলাকা নিয়ে পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এমনকি নদীয়া, যশোর, বর্ধমান, বীরভূম নিয়ে এই এলাকা রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত হয়, পরে তা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবন কে প্রদান করেন। রামজীবন ১৭৩০ সালে মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন।

১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী রাণীভবানী নামে উত্তরাধীকারী লাভ করেন। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাণী ভবানীর দেয়া নামই রাজশাহী । অবশ্য মিঃ গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সমৃদ্ধ এই রাজশাহী শহরে রয়েছে বিখ্যাত মসজিদ, মন্দির ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। পদ্মার তীরের এই শহরের পর্যটকদের জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থানের মধ্যে রয়েছে বাঘা মসজিদ, পুঠিয়া রাজবাড়ি, পদ্মার পাড়, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শিশু পার্ক, হাওয়াখানা, পদ্মা গার্ডেন, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি।।

ঐতিহ্যবাহী এই জেলাটির রয়েছে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বাংলা সংস্কৃতির সাথে ধর্ম প্রচারকদের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই অঞ্চল একেক সময় একেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শাসনে ছিল। সর্বশেষ ছিল মুসলিম শাসন। তুর্কি, পার্সি, তুঘলকিসহ নানান অঞ্চল থেকে মুসলিমরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে আসে, পরে এখানে গড়ে তোলে তাদের সাম্রাজ্য। রাজশাহীর তেমনই প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম কিসমত মারিয়া মসজিদ ও অতুলনীয় নকশার ষাটগম্বু মসজিদ ।

বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য আর নিদর্শনে ভরপুর রাজশাহী জেলাতে রয়েছে আরও অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। জেলার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বিখ্যাত মসজিদ, মন্দির ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। তাদেরই চমৎকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো পুঠিয়া বড় শিব মন্দির ও বড় কুঠি। প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণে ভরপুর নিদর্শনগুলো আমাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোই আমাদের অতীতের চিহ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ।

প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ বাংলাদেশ, এই দেশটির সংস্কৃতি মিশে আছে প্রতিটি মানুষের রন্দ্রে। এই দেশের ইতিহাসের সন্ধান মেলে স্থাপত্যে। ঐতিহাসিক সব স্থাপনায় মিশে আছে অতীতের ইতিহাস। তেমনি, এ অঞ্চলের আরেকটি ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ক শাড়ী । রাজশাহী রেশম সুতা ও রেশমবস্ত্র তৈরির জন্য বিখ্যাত। ১৯৭৭ সালে রাজশাহীতে রেশম বোর্ড স্থাপিত হয়। এখানকার জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি। অন্যান্য কুটিরশিল্পের মধ্যে তাঁত, বাঁশ ও বেত, স্বর্ণকার, কামার, কুমার, কাঠের কাজ, কাঁসা, সেলাই, বিড়ি উল্লেখযোগ্য।

পদ্মার তীরের এই প্রাচীন জেলা শুধু আম ও রেশমি বস্ত্রের জন্যই বিখ্যাতনয়। পদ্মার অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই জেলাটি ইতিহাস, সংস্কৃতি যেমন সমৃদ্ধ ও তেমন শিক্ষার দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ। রাজশাহী শিক্ষানগরী হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি একটি শহর।

এখানে দেশের প্রায় সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, শারীরিক শিক্ষা কলেজ, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, সার্ভে ইন্সটিটিউট, পিটিআই, নার্সিং ইন্সটিটিউট, ভোকেশনাল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, পুলিশ একাডেমী, পোস্টাল একাডেমী, রেশম গবেষণা কেন্দ্র, আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হোমিওপ্যাথি কলেজ, ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি।

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশেও রাজশাহী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা এ অঞ্চলের সংস্কৃতির বিশেষ দিক। পাশাপাশি আদিবাসী দিবস ও তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা এখনে আয়োজন করা হয় ।

প্রতিদিন সান্ধ্য প্রদীপ নেভার মতোই পদ্মার পশ্চিমাকাশে রক্তিম সূর্য ডোবে ।কখনও বা দিগন্ত ছেয়ে সবুজের সমারোহ, কখনও বা ধূ-ধূ বালুচর, আবার কখন পদ্মা ঢাকা পড়ে শরতের সাদা কাশ ফুলে । পাখ-পাখালীর কলোরব আর সবুজের সমারোহ এই অপরুপ রাজশাহী শহরটি ।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি এই নদীর তীরের মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করেই লেখা। শহর থেকে দূরে এ নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে , মাঝিদের জীবনচিত্র ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-অভাব-অভিযোগ – এতে অঙ্কিত হয়েছে।

আবার এই নদীর রূপ দেখেই কবি তালহা আজিজ বলেছেন,


“পদ্মার তীরেতে বসবাস আমার,

মুগ্ধ আমি রূপ দেখে তার।

এর তীরেই আছে কত শত স্মৃতি।

রাতে জোনাকিরা দেয় জ্যোতি;

মনে হয়, যেন স্বর্গের ছায়া!

কি অপরূপ তার মায়া! “


লেখকঃ তরুণ নারী উদ্যোক্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *