রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাখি

প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা


যারা কবিতা শোনে, যারা ফুলকে ভালোবাসে, গান ভালোবাসে নিশ্চয় তারা পাখিও ভালোবাসে। ক্যাম্পাসে কত ধরনের পাখি আছে হয়ত অনেকের জানা নেই। জানা না থাকারই কথা, সবাইতো আর পাখি নিয়ে গবেষণা করে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর শীতের সময় অতিথি পাখি (Migratory bird)
যেভাবে আসে, দেখতে বেশ ভালো লাগে। এ বছরও বেশ কয়েক হাজার অতিথি পাখি এসেছিলো। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি একটি আলাদা গর্বের বিষয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১০ প্রকার জলজ অতিথি পাখি দেখা যায়। এরমধ্যে ৯৮ ভাগই ছোট সরালি। পরিযায়ী পাখি ২৫০০ থেকে ১০,০০০ মাইল দূরত্ব থেকে বাংলাদেশে আসে। হিমালয়ের পাদদেশ, সাইবেরিয়া এবং মঙ্গোলিয়া থেকে এই পরিযায়ী পাখি এসে থাকে। এরা একটানা ১১ ঘন্টা উড়তে সক্ষম। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও কম নয়। এবার প্রায় পাঁচশত অতিথি পাখি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন মাস অবকাশ যাপন করলো।

যখন পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে পুকুর থেকে উড়ে যায় দেখতে বেশ ভালো লাগে। আবার যখন বিকেলে ফিরে আসে, বেশ সুন্দর দেখায়। আগের মতো পাখি শিকারীরা তৎপর নয়। কয়েকবছর পূর্বেও পদ্মার চর থেকে পাখি শিকার করে সাহেব বাজার হয়ে নিজেদের বাসায় যেত শিকারীরা। কেউ তাদেরকে নিষেধ করতো না। এমনকি রাজশাহী শহরে যখন অতিথি পাখি বিক্রি করতো, কেউ তাদের ধরিয়ে দিতো না বা প্রশাসনও তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতো না। বর্তমানে পাখি শিকার বন্ধ এবং বাজারেও কেউ বিক্রি করতে পারে না।

১৯৭৬ সালে ক্যাম্পাসে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ছিলো ৭৬। জানামতে ২০০৮ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো। তখন ক্যাম্পাসে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ছিলো ৮৫। পরবর্তীতে আরও একটি গবেষণা হয়েছে (আমিনুজ্জামান, ২০১২) সেখানে পাখির প্রজাতির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১৫৯।

১৫৯ প্রজাতির পাখির মধ্যে অতিথি পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৩৮। দেশীয় পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১২১। তবে বাংলাদেশে ৮০৬ ধরনের প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। প্রফেসর আমিনুজ্জামানের প্রবন্ধে উল্লেখ আছে ৩০ প্রজাতির পাখি খুবই চোখে পড়ে এবং ৩২ প্রজাতির পাখির সংখ্যা খুবই কম, সব সময় দেখা যায় না। সচরাচর যাদের দেখা পাওয়া যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় পাখি দোয়েল, ঘুঘু, শালিক, বক, কাঠ ঠোকরা, মাছরাঙ্গা, সাতভাই, কোকিল, কাক, চিল, বাজ, পেঁচা ইত্যাদি।


কাক ও শালিক


ক্যাম্পাসে যাদের সবচেয়ে বেশী দেখা যায় তাদের মধ্যে কাক অন্যতম। রাজশাহী শহরে প্রায় ২০,০০০ মতো কাক দেখা যায়। ৪ বছর পূর্বে কাকের উপর একটি ছোট্ট গবেষণা করেছিলাম। ক্যাম্পাসের পাশে মেহেরচণ্ডী গ্রামে একটি জায়গা ছিলো, সেখানে প্রায় ২-৩ হাজার কাক দেখা যেতো। এক সময় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে এবং আশেপাশের গাছে প্রায় হাজার দেড়েক কাক দেখা যেতো।

এমনিভাবে কাঁটাখালী, শাহ্ মখদুম দরগার পাশে, পদ্মার টি বাঁধের শেষ প্রান্তে এবং কোর্টের শেষ প্রান্তে ছিলো এদের আবাসস্থল। যেহেতু কাকের মাংস কেউ খায় না। তাই তাদের সংখ্যা অনেক। সংখ্যা বেশী দেখা যায় শালিকেরও। বেশ কয়েক ধরনের শালিক দেখা যায় যেমন বামন শালিক, চিত্রা শালিক, ঝুন্টি শালিক, ভাত শালিক, গোবরে শালিক ইত্যাদি। বলা যেতে পারে এদের উপর কম অত্যাচার হয়, তাই তারা সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশী। ঢাকা যাওয়ার সময় সিরাজগঞ্জে হানিফ হাইওয়ে বাস টার্মিনালে প্রচুর লাল ঠোঁটবিশিষ্ট শালিক দেখতে পাওয়া যায়।

শালিক

এই প্রজাতির শালিক ক্যাম্পাসে কম তবে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে। প্রতিদিন সকালে চা খাওয়ার সময় যখন টোস্ট বিস্কুট গুড়া করে ছিটিয়ে দেয়া হয়- টোস্ট বিস্কুটের ৫-৬ টুকরা ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে উড়ে যায়, বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। এটাকে বলা হয় Parental Care.


ঘুঘু


ইংরেজি নাম: Dove , বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia chinensis । ঘুঘু অত্যন্ত ভিতু ও লাজুক প্রকৃতির পাখি। ঘুঘু প্রতিবার একজোড়া করে বছরে তিনবার ডিম দেয়।

দেখতে ভাল লাগে ঘুঘু, বর্তমানে খোলা প্যারিসরোডে বিচরণ করছে ঘুঘুগুলো। প্রতিদিন একজোড়া ঘুঘু আনুমানিক সকাল সাড়ে ছ’টায় আমার বাসার আঙ্গিনায় উপস্থিত হয়। আমি তাদের জন্য সরিষা রেখেছি। তারা খুব যত্ন করে তা খায়। তবে ঘুঘু একটু ভীতু প্রকৃতির। দু’জাতের ঘুঘুই ক্যাম্পাসে দেখতে পাওয়া যায়।

ঘুঘু

তবে Spotted ঘুঘু বা তিলা ঘুঘুর বিচরণ বেশী মনে হয়। একজোড়া ঘুঘু ঘুম থেকে উঠে বাহিরে লোহার রডের উপর বসে। একজন অপরজনকে ঠোঁট দিয়ে গা চুলকিয়ে দারুণ আদর করে। এরা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। ঘুঘু পাখিগুলো দেখতে বেশ সুন্দর এবং মায়াবী। বর্তমান সময়ে এদের আধিক্য লক্ষণীয়। কিন্তু তাদের দেখবে কে? জানিনা তারা কোথায় কেমন আছে?


বক


সবার পরিচিত একটি পাখি বক। জলাশয়ের মরা মাছ ও ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। এক একটি কলোনিতে শত শত বক একসাথে বাসা তৈরী করে।

প্রফেসর আমিনুজ্জামানের (২০১২) প্রবন্ধে উল্লেখ আছে, ১১ প্রজাতির বক ক্যাম্পাসে দেখতে পাওয়া যায়। যদিও আমি প্রাণিবিদ্যার ছাত্র তথাপি আমার পক্ষেও সহজে ওদের আলাদাভাবে চেনা মুশকিল। তবে তাপসী রাবেয়া হলের গাছে এবার বাসা বেঁধেছিলো নিশিবক। রাতের বেলায় শিকার করতো আর দিনের বেলায় ঘুমাতো। কেউ যদি খুব সকালে খালেদা জিয়া হল থেকে তাপসীর দিকে যান, দেখতে পাবেন অন্ততঃ ১০০টি নিশিবক কিভাবে শব্দ করছে। দারুণ উপভোগ্য।

বক

ক’দিন আগেই দেখতে পেলাম জোহা হলের পূর্বদিকের পুকুর থেকে বেশ বড় লম্বা সাদা বক একটি ২৫০ গ্রাম ওজনেরও বেশী একটি মাছ দুই ঠোঁটের মধ্য রেখে দাঁড়িয়ে আছে পুকুরের বাঁধে। আমাদের দেখামাত্র মাছটি রেখে সাদা বড় বকটি উড়ে গেল। মাছটি তখনও লাফাচ্ছিলো।


গো-বক


ইংরেজি নাম : Cattle Egret, , বৈজ্ঞানিক নাম Bubulcus ibis | এদের মূল খাদ্য পোকামাকড়, গিরকিটি, ব্যাঙ, গরু-মহিষ-ছাগলের শরীরের পরজীবী পোকা ও ডাঁশ মাছি। এরা জোঁক খায় না। গবাদিপশুর নাকের ভেতরে জোঁক লাগলে গো-বক টেনে বের করে ফেলে দেয়।

জোক অতি বুদ্ধিমান, গবাদিপশুর এমন সব জায়গায় লাগে যেখানে পশুটি জিভ দিয়ে চাটতে পারবে না। চাটা দিতে পারলে জোঁক লেগে থাকতে পারে না। গো-বক তাই গবাদিপশুর পরম বন্ধু। গবাদিপশু হাঁটছে, নড়ছে ঝোপঝাড়, উড়ছে পোকামাকড়, খাচ্ছে গো-বকেরা।

কৃষি প্রকল্পের গরুগুলো যখন তাদের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মাঠের দিকে ঘাস খেতে বের হয়, তাদের সঙ্গেও এই বক দেখা যায়। গরু হাঁটতে থাকে আর বকও পিছন পিছন হঁাটতে থাকে। গরু রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটে- জঙ্গলের মধ্যে যে পোকাগুলো থাকে, বক সেই পোকাগুলো আহার করে। অনেক সময় জমিতে লাঙ্গল দেয়া হয়। আর সেখানে দলবেঁধে বকগুলো আনাগোনা করে। কারণ মাটির ভিতর থেকে পোকা বের হয়। বক সেগুলো খেয়ে থাকে। এভাবেই তারা জীবনযাপন করে।

গো বকের রং বরফ সাদা কিন্তু এ সময় দেখছি ঠোঁট-মাথা-ঘাড়-বুক সোনালি-হলুদ। দেখে মনে হচ্ছিলো ভিন্ন প্রজাতির। আসলে প্রজনন মৌসুমে এদের রং কিছুটা পরিবর্তিত হয়।

ক্যাম্পাসে আপনি যখন খালেদা জিয়া হল থেকে তৃতীয় বিজ্ঞানভবনের দিকে হাঁটবেন বামদিকে তাকালে দেখা যাবে সাদাবকগুলো মাছ শিকারের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ধূসর রঙের বকগুলো ডোবার কিনারে ওত পেতে বসে থাকে। আমরা হয়তো সময়ের কারণে ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারি না। কানি বকগুলো পুকুরের একপাশে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কখন একটা শিকার পাবে। এভাবেই পক্ষীকূল ক্যাম্পাসকে সমৃদ্ধ করেছে।


ডাহুক


ইংরেজি নাম: White-breasted Waterhen, বৈজ্ঞানিক নাম: Amaurornis phoenicurus | জলাভূমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা এই পাখিটি মাঝারি আকৃতির।

রবীন্দ্রভবনের দক্ষিণ পাশে যে ডোবাটি আছে সেখানে বিচরণ করে ডাহুক। তবে রোকেয়া হলের পিছনের ড্রেনেও তাদের বিচরণ করতে দেখা যায়। মা সামনে, বাচ্চা ৩টি মাঝে বাবা পেছনে হাঁটছে, কি-না চমৎকার! লকডাউনের কারণে এ রকম অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারা যাচ্ছে। কি অদ্ভূত! ডাহুকের বুকের অংশটি সাদা, দেহের বাকি অংশ কালো। দেখতে বেশি বড় নয় বা ওজনও বেশি মনে হয় না। হালকা-পাতলা গড়নের। এতই হালকা শাপলার পাতার উপর কিংবা কচুরীপানার উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে পারে।

প্রজননের সময় প্রথম বৃষ্টিতেই রাতের বেলায় ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই চিনতে পারা যায়। দেখতে আকর্ষণীয়। একটু বেশি ভীতু। কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই নিজেদের আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে যায়। ডাহুক পাখি বলছে খড়পশফড়হি-এ আমরা নিরাপদে আছি। ভাল আছি কিন্তু যাদের জন্য এ ক্যাম্পাস তারা না থাকলে আমাদেরও ভালো লাগে না। তোমরা কবে আসবে গো!


শামুকখোল


ইংরেজি নাম : Asian Openbill, বৈজ্ঞানিক নাম: Anastomus oscitans | রাজশাহী অঞ্চলে শামুকখোলের বেশ দেখা মেলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ক্যাম্পাস, জেলখানার পাশ্ববর্তী অঞ্চলে এদের দেখা মেলে। কয়েক বছর পূর্বে কলোনি করেছিলো জেলখানার পূর্বদিকে এবং পুরাতন জিপিও’র পশ্চিম পাশের্ব। সুবিধাজনক অবস্থা ছাড়া এরা প্রজনন করে না।

কয়েকটি গাছে প্রায় শ’পাঁচেক শামুকখোল বাসা বেঁধেছিল। প্রচণ্ড শব্দ করে ডাকাডাকি করে। দুই বছর আগে দেখা গেল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা এবং তাপসী রাবেয়া হলের আম এবং মেহগুনি গাছে কলোনী করেছে। তারপরে দেখা মিললো রুয়েট ক্যাম্পাসে। সচরাচর যে সকল পাখি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমরা দেখতে পাই তারমধ্যে শামুকখোল ভীষণ বড়।

এদের প্রধান খাবার শামুক, ঝিনুক। তৃতীয় বিজ্ঞানভবনের পশ্চিমদিকে যে পুকুর বা ডোবাটি আছে সেখানে এক সময় অজস্র শামুক-ঝিনুক পাওয়া যেতো। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য এই ডোবা থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু তখন যে পরিমাণে শামুক-ঝিনুক পাওয়া যেত এখন আর পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ সে কারণে শামুকখোল পাখিগুলো স্থান পরিবর্তন করেছে।

শামুক খোল

এদের যদি খাবারের অভাব না ঘটে তাহলে এরা স্থান পরিবর্তন করে না। কয়েকদিন আগে বৃষ্টির পরে দেখা মিললো জোহা হলের পূর্বদিকে। তবে সংখ্যায় বেশী নয়, ১০-১৫ টি। বর্তমানে ক্যাম্পাসে কোন কলোনি নেই। হয়তো এদের মনে দুঃখ থাকতে পারে, রোকেয়া, রহমতুন্নেসা এবং তাপসী রাবেয়া হল থেকে যখন ক্লাসে যেত তাদের সঙ্গে পক্ষীকূলের দেখা হতো।

তারা এখন ক্যাম্পাসে নেই, তাই এই পাখিরা অভিমান করে অন্যত্র চলে গিয়েছে। হয়তো আবার ফিরে আসবে। ফিরে আসবে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের সেই মতিহার সবুজ চত্ত্বরে। চলবে……


লেখকঃ উপ-উপাচার্য ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *