রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাখি

আনন্দ কুমার সাহা


(পূর্ব প্রকাশের পর) [রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাখি]


দোয়েল

ইংরেজি নাম : Magpie Robin বৈজ্ঞানিক নাম: Copsychus saularis | বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল। ফরাসী ও ওলন্দাজ পাখিদের নামের সঙ্গে এর মিল আছে। ফরাসী ভাষায় বলা হয় Shama dayal এবং ওলন্দাজ ভাষায় বলা হয় Dayallijster | বাংলাদেশে মূলত গ্রামীণ অঞ্চলে এদেরকে বেশি দেখা যায়। জনবসতিতে মানুষের কাছাকাছি এদের দেখতে পাওয়া যায়। দোয়েল দেখতে বেশ মায়াবী। এরা একটু ছটফটে ধরনের।

প্রজননের সময় পুরুষ দোয়েলের শরীরের রঙ উজ্জ্বলতর হয়। গাছের ডালে বসে স্ত্রী দোয়েলকে আকৃষ্ট করার জন্য হরেক রকম সুরে ডাকাডাকি করে।

দোয়েলের খাবার তালিকায় আছে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ, কেঁচো, ধান, ভাত ইত্যাদি। ধান, পাট, শাক-সবজির ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে সমাজের উপকারী পাখি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে দোয়েল। এই পাখির নামে বাংলাদেশের রাজধানীতে দোয়েল চত্ত্বর আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাঝে অবস্থিত। দোয়েলের আয়ুষ্কাল পনের বছর।

দোয়েল

সুইডেন-নরওয়েতে দোয়েল পাখি দেখা যায়। সুইডেন কিংবা নরওয়ে মানুষগুলো যেমন লম্বা, স্বাস্থ্যবান ঠিক দোয়েল পাখিগুলোও ঐ রকম বড় এবং স্বাস্থ্যবান। বাংলাদেশের ৪টি দোয়েলের সমান এক একটি দোয়েল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এদের বিচরণ আছে। তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়।


মাছরাঙা

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী। এই নদীমাতৃক দেশের অতি পরিচিত একটি প্রজাতির পাখি হচ্ছে মাছরাঙা। আমাদের দেশে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা পাখির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। পৃথিবী ব্যাপী ৯৪ প্রজাতির মাছরাঙা রয়েছে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৪ প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায় (আমিনুজ্জামান, ২০১২)।

১। পাতি মাছরাঙা, Common Kingfisher, Alcedo althis
২। ধলাগলা মাছরাঙা, White-throated Kingfisher, Halcyon smyrnensis
৩। মেঘহও মাছরাঙা, Stork-billed Kingfisher, Pelargopsis capensis
৪। পাকড়া মাছরাঙা, Pied Kingfisher, Ceryle rudis

মাছরাঙা অনেক ধরনের প্রাণী শিকার করে, তবে তার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে মাছ। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরীসৃপ ইত্যাদি। সাধারণত জলাজয়ের পাশে গর্তে এরা বাসা তৈরি করে।

মাছরাঙা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় ৪০টি পুকুর, জলাশয় আছে। মাছও পাওয়া যায়। বসবাসের জন্য পরিবেশও আছে। তাই মাছরাঙা পাখিগুলোকে প্রায়ই বিভিন্ন জলাশয়ের আশেপাশে দেখা যায়। ৩৮,০০০ শিক্ষার্থী বর্তমানে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত। পাখিগুলো তাই স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারছে। তবে শিক্ষার্থীরা থাকলে তাদের প্রতিরক্ষার জন্য ভালো, যদিও তারা একটু ভয়ও পায়। আশা করছি, অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসবে আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা তাদের মতিহার সবুজ চত্ত্বরে। আমরা তাদের আগমনের অপেক্ষায়।


বাজপাখি

ইংরেজি নাম : Common Kestrel, বৈজ্ঞানিক নাম: Falco tinnunculus | ঈগলের মতো শিকারি হিংস্র পাখি। দিনের আলোতে শিকার করে। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর। দৃষ্টিশক্তি প্রখর হওয়ার পিছনে বড় কারণ হচ্ছে Photoreceptors । মানুষের চেয়ে এ ধরনের পাখির রেটিনাতে প্রায় ৫ গুণ বেশি Photoreceptors থাকে।

মেয়ে বাজপাখি পুরুষ বাজপাখির চেয়ে আকৃতিতে বড় হয়। বাজপাখি সাধারণত নিজের থেকে ছোট আকৃতির জীবজন্তু যেমন মাছ, কাঠবিড়ালী, খরগোশ, ইঁদুর খেয়ে জীবনধারণ করে।

ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জাতীয় পাখি বাজ। ১৯৮৯ সালে ১৫ই মার্চ অন্য একটি পাখির পরিবর্তে বাজপাখিকে ‘স্টেট বার্ড অব পাঞ্জাব’ বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় পরিবেশের কারণে বাজপাখিকে এখন আর পাঞ্জাব প্রদেশে দেখা যায় না।

বাজপাখি

বাজপাখি নিয়ে অনেক গল্প আছে। বয়স ৪০-এ আসার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাজপাখিকে নিতে হয়। সিদ্ধান্ত সঠিক নিতে পারলে প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত এরা বেঁচে থাকতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত কোন এক সময় উল্লেখ করবো।

এই পাখিগুলোকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মধ্যে বিচরণ করতে দেখা যায়। এক জুটি বাজ প্রায়ই জিমনেশিয়ামের উপরে খোলা জায়গায় বসে থাকতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে জিমনেশিয়ামের পূর্বদিকের গাছেও তাদের বসতে দেখা যায়। স্টেডিয়ামের খোলা মাঠে উড়তে এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বেশ খোলামেলা। এ মুহূর্তে তেমন কোলাহল নেই, সবাই লকডাউনে, তাই পাখিগুলো পেয়েছে উত্তম সময়।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আরও পাখি আছে। ভবিষ্যতে বর্ণনা করার আশারাখি। ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখি আসবে- তাদের আশ্রয় এবং খাদ্যের ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ক্যাম্পাসে প্রায় ৪০টি পুকুর-জলাশয় আছে, ত্রিশ হাজারের অধিক গাছ আছে। নিঃসন্দেহে পাখিরা এই ক্যাম্পাসে বসবাস করবে। পরিবেশকে আকর্ষণীয় করে তুলবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

গত দু’তিন বছরে পাখিদের জন্য বট, কামরাঙা, ডুমুর, আমলকি, বন কাঁঠাল প্রভৃতি গাছ লাগানো হয়েছে। গত ১৭ই মার্চ ২০২০ জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য “শতবর্ষে শতপ্রাণ” শীর্ষক নামে ১০০টি বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। গোরস্থান মসজিদ এলাকায় এ বছরই ৪০০টি আমগাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী ৬ই জুলাই গৌরবের ৬৭ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি রয়েছে।

এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাখিরাও যেন মনোরম পরিবেশ পায় সেদিকেও দৃষ্টি প্রখর রয়েছে। প্রশাসন কখনও গাছ কাটতে চায় না- তবে অনেক সময় বিদ্যুতের লাইনের জন্য, নতুন ভবন তৈরি করার সময় বা ঝড়ে ভেঙে গেলে, উপড়ে গেলে তখন কিছু করার থাকে না।

৭৬ প্রজাতির পাখি থেকে বর্তমানে ১৫৯ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আশাকরি ভবিষ্যতে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার চেষ্টা আমরা সবাই মিলে করবো।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা বিজয় অর্জন করেছে, আশাকরি করোনার বিরুদ্ধে আমরা জয়ী হবো এবং ফিরে আসবো আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *