রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা

উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার গড়ে ওঠে রাজশাহী কলেজ হোস্টেলে। ২১ ফেব্রুয়ারির ১৯৫২ সন্ধ্যাতে আন্দোলনকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে গড়ে তোলেন ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নামে দেশের প্রথম শহীদ মিনার।

প্রাণের আবেগ দিয়ে গড়া এই শহীদ মিনার পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি সকালে উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটি ভেঙ্গে ফেলে পাকিস্তান সরকারের পুলিশ।

২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররাও ভাষা শহীদের স্মরণে এক রাতের শ্রমে নির্মাণ করেন ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’, যেটি ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সহসভাপতি গোলাম মাওলা ও সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিনের অনুরোধে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নামের এই শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন ডা. বদরুল আলম।

২৪শে ফেব্রুয়ারি এই স্মৃতিস্তম্ভ প্রথম উদ্বোধন করেন ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের বাবা মাহবুবুর রহমান। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগকারী প্রথম সদস্য ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কিন্তু ভীত পাকিস্তান সরকার সেদিনই পুলিশ দিয়ে রাজশাহীতে নির্মিত পূর্ব বাংলার প্রথমটির মতো ঢাকার প্রথম শহীদ মিনারও ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়।

১৯৬৭ সালে রাকসুর উদ্যোগে শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে নির্মিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিস্ফোরকের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেয়।

১৯৭৫ সালের ২৩শে এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার দেশের অন্যান্য শহীদ মিনারের গড়নের দিক থেকে আলাদা। এ মিনারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো এর ম্যুরাল চিত্র, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, উন্মুক্ত মঞ্চ, সুবিস্তৃত খোলা প্রান্তর ও ফুলের বাগান- এসব কিছুর সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার চত্বর।

শহীদ মিনারটি কৃত্রিমভাবে তৈরি মাটির টিলার উপর অবস্থিত। অনেকগুলি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মিনারের ভিত্তিমূলে। মিনারের পশ্চাতে রয়েছে দীর্ঘ একটি ম্যুরাল চিত্র। ‘অক্ষয়বট’ শীর্ষক ম্যুরালটি নানা বর্ণের পোড়া ইট, পাথর ইত্যাদি নানা অক্ষয় মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে। এ চিত্রটিতে রূপ দেওয়া হয়েছে এক স্নেহময়ী মা ও তাঁর বীর সন্তানদের অবয়ব।

ম্যুরালটিতে সূর্যের উপস্থিতিতে শহীদ সন্তানদের বীরত্ব ও তেজস্বিতাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে মায়ের অঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গঠনশৈলী ও উপাদানের বৈচিত্র্যে অনন্য এ ম্যুরালটি নির্মাণ করেন শিল্পী মুর্তজা বশীর।

শহীদ মিনারের পাদদেশে পূর্বদিকে যেদিক থেকে উদিহ হয় নতুন দিনের সূর্য, সেদিকে রয়েছে একটি শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। এ সংগ্রহশালার ডিজাইন করেন স্থপতি মাহবুবুল হক। এই সংগ্রহশালায় রয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নানা রাজনৈতিক ঘটনাবলির আলোকচিত্র, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নানা শিল্পকর্ম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের আলোকচিত্র, তাঁদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্নসহ অনেক কিছু। মোটকথা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে এ সংগ্রহশালা- শুধু ধারণ নয় মুক্তিসংগ্রামের চেতনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মাঝে।

১৯৮৯ সালের ২১শে মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার প্রদর্শনী কক্ষের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রফেসর আমানূল্লাহ আহমদ, মাননীয় উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সংগ্রহশালার কোল ঘেঁষে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। এর পিছনের দেয়ালে রয়েছে গ্রাম বাংলার আবহমান দৃশ্য যা রিলিফ ওয়ার্কে নানা রঙের মাধ্যমে রূপ দেওয়া হয়েছে। এটি নির্মাণ করেন শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়। এ মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- যার মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণের ধারা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশা করেন স্থপতি খায়রুল এনাম। ১৯৭২ সালের ৯ই মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এই শহীদ মিনারে রয়েছে চারটি বাহু যা উল্লম্বভাবে উঠে গেছে উপরের দিকে। বাহু চারটি উপরের দিকে বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ। এখানে চারটি বাহু দ্বারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। সুউচ্চ এ শহীদ মিনার চত্বর বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার করে সর্বপ্রাণে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরটি বর্তমানে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। এ মুহূর্তে তেমন কোলাহল নেই। নীলাভ সবুজ ঘাসকে কেউ পদদলিত করছে না। অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন আসবে আত্মার আত্মীয়। বন্ধুরা যখনই ফিরে আসবে তোমাদের নিজস্ব মতিহার ক্যাম্পাসে- ভুল করবে না একবার শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রদর্শন করতে। নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’। বঙ্গবন্ধুর উপর রচিত প্রায় ৯৫০ খানা বই সংগ্রহ করা হয়েছে। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা প্রদর্শন করলে নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে।

সূত্র:
১. মো. বনি আদম, ‘বাংলাদেশের চারুশিল্পে মুক্তিসংগ্রাম ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন’ পি-এইচ.ডি. অভিসন্দর্ভ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৫।
২. দৈনিক পত্রিকা সমকাল, ২০২০।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *