দ্যা ক্যাম্পাস টুডেঃ রাবিতে বার্ষিক ব্যয় গত ১০ বছরে বেড়েছে অন্তত ২৭৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় বড় আকারের নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অতি আগ্রহ এই ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ।
একদিকে অনুপোযুক্ত জনবল যেমন কোনো কাজে আসছে না, অন্যদিকে জাতীয় কোষাগারের ওপর চাপ ফেলছে।
দাপ্তরিক নথি ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট ছিল ১৫৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরে এই বাজেটের পরিমাণ বেড়ে ৪৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এই বাজেটের ২৮ কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের বিভিন্ন উৎস, যেমন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া ফি, সান্ধ্যকালীন কোর্স, কৃষি প্রকল্প, সম্পত্তি ভাড়া, পরিবহন ফি এবং চিকিৎসা সেবা থেকে যোগান দেওয়া হয়।
বাকি ৪০৪ কোটি ৯৭ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদনক্রমে জাতীয় কোষাগার থেকে সরবরাহ করা হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।
আইন কী বলে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কেবলমাত্র শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দিয়েছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংক্রান্ত এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার অর্থাৎ জনগণের টাকার প্রয়োজন পড়ে, সেসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে এই আইন।
আইনের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, যেসব ক্ষেত্রে জনগণের অর্থ জড়িত, যেমন নিয়োগ প্রক্রিয়া, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির কাছ থেকে পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে, যা এই আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০০১ সাল থেকে শুধুমাত্র নিজেদের ইচ্ছায় কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে চলেছে।
তবে এই নিয়োগের বেশির ভাগই সাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহানের আমলে হয়েছে। যেখানে ইউজিসির কোনো অনুমোদনই নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। উপাচার্য হিসেবে তিনি ২০০৯-১৩ এবং ২০১৭-২১ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গত ৬ মে অধ্যাপক সোবহান উপাচার্য হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নয় জন শিক্ষকসহ অতিরিক্ত মোট ১৩৭ কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন।
‘অবৈধ’ নিয়োগের ফলে কী ঘটছে?
‘অবৈধভাবে’ নিয়োগ পাওয়া কর্মীদেরকে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা বিভিন্ন শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ দেখিয়ে বৈধ করা হয়, বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট এবং অর্থনৈতিক কমিটির সভায় কর্তৃপক্ষ এসব নিয়োগ অনুমোদনের ব্যবস্থা করে। এরপরে এসব নিয়োগ বৈধ করতে তারা ইউজিসির ওপর নিয়মিত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এভাবে এক পর্যায়ে এই উদ্দেশ্য সফল হয়।’
রাবির একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং দপ্তরের চাহিদা না থাকলেও এসব নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা এসব নিয়োগে যোগদানকারীদের সাধারণত অপসারণ করতে পারে না। তাদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি থাকে। ফলে তাদের যোগদানও ঠেকানো যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমনও আছে যে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজনের যোগদান ঠেকানোর চেষ্টা করায় এক বিভাগের সভাপতিকে তার পদ ছাড়তে হয়েছিল।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই অবৈধ নিয়োগ চলমান, কেউ এটা থামাতে পারেনি। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে পরবর্তীতে, কারণ অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের কাজের মান ও যোগ্যতা নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক কম থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব নিয়োগের বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় এবং এগুলো কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেক বিভাগে দেখা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষক কাজ না করে অলস সময় কাটান বা একটি কোর্স অন্যান্য একাধিক শিক্ষকদের সঙ্গে ভাগ করে পড়ান।
আবার অন্যদিকে দেখা যায়, কিছু বিভাগের একজন শিক্ষকই একাধিক কোর্স নেন। এটি পুরোপুরি অপরিকল্পিত নিয়োগের ফলাফল। এমন অনেক নিয়োগ হয়েছে যারা তাদের পদের যোগ্যই নন— একজন কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজনকে পাওয়া গিয়েছিল, যিনি যোগদানের আগে কখনো কম্পিউটার স্পর্শই করেননি।’
আইন বিভাগের অধ্যাপক আবু নাসের মো. ওয়াহিদ বলেন, অ্যাডহক নিয়োগ প্রক্রিয়া সাধারণত জরুরি নিয়োগের আওতায় পড়ে। তবে এর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন কমিটির চাহিদা থাকা প্রয়োজন।
অননুমোদিত পদে এসব নিয়োগ বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। আর এই চাপ কমাতে কর্তৃপক্ষকে অনেক সময় অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ খরচ করতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বাজেটের এই ঘটতি পূরণে কর্তৃপক্ষ অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের তহবিল স্থানান্তর করে। বিল ও ভাতা বিলম্বিত করে এবং মেয়াদের আগেই ব্যাংক থেকে মেয়াদি আমানত তুলে নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. আফসার আলী জানিয়েছেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের বার্ষিক বৃদ্ধির পরিমাণ ৩১ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
অষ্টম জাতীয় পে স্কেল ঘোষণার পরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে সর্বোচ্চ ৭১ কোটিতে পৌঁছে। পরের বছরে দাঁড়ায় ৬২ কোটিতে। আশঙ্কাজনক হারে এই ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলাও বড় কারণ।