শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার
প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা
১৪ এপ্রিল বা পহেলা বৈশাখ বাঙালির কাছে সর্বজনীন একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নববর্ষের এই দিনে অনেকে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কাপড় পরিধান করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ১লা বৈশাখ ভীষণ আনন্দে ভরপুর একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সরকারও চাকুরীজীবীদের নববর্ষ ভাতা দিয়ে থাকেন।
কিন্তু ১৯৭১ সালে সারাদেশের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনটিতে নেমে আসে এক অন্ধকার সময়। এদিনে আমরা আমাদের একজন প্রিয় সহকর্মীকে হারাই। তিনি হচ্ছেন ভাষা বিভাগের (বর্তমানে সংস্কৃত বিভাগ) শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি, বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার, মায়ের নাম প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সুখরঞ্জন ছিলেন সবার বড়। কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ও খ্যাতিমান অধ্যাপক।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের খ্যাতি ছিল। স্থানীয় বাইশারী স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ (বি. এম. কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাস করেন। বাবা কার্তিকচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরের। ১৯৫৮ সালে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিষয়ে ১৯৬০ সালে এম.এ. পাশ করেন।
অনার্স পাসের পর সুখরঞ্জন প্রথমে কিছুদিন গোপালগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতচর্চা করতেন।
১৯৬৩ সালে তিনি চম্পা সমাদ্দারের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁদের। একাত্তরের ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাড়ার ৭১/বি নম্বর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের জুবেরী ভবন তখন মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে প্রথমে জুবেরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেনারা তাঁকে হত্যা করে বিনোদপুরের এক দিঘির পাড়ে ফেলে রাখে।
অসহায় চম্পা সমাদ্দার ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসেনের কাছে তাঁর স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। ড. সাজ্জাদ হোসেন তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। নানা জায়গায় ছুটাছুটি করে চম্পা সমাদ্দার স্বামীর প্রকৃত অবস্থান জানার চেষ্টা করেন, কিন্তু খবর মেলেনি। তবুও তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন। জুলাইয়ের গোড়ার দিকে চম্পা সমাদ্দারের সমস্ত আশা-ভরসার করুণ পরিণতি ঘটে। একজন প্রতিবেশী সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্যান্ডেল, ভাঙা চশমা চম্পা সমাদ্দারের হাতে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে পৌঁছে দেন। চম্পা সমাদ্দার নিশ্চিত হন, তাঁর স্বামী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন : “১৩ই এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি ই.পি.আর সেনা (মুক্তিযোদ্ধা) অন্ধকারে চুপি চুপি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার পেছনে এসে পানি চাচ্ছিল। আমার স্বামী তাঁকে নিজ হাতে পানি খাওয়ান। ওই ই.পি.আর সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাঁকে আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার স্বামী নিজ হাতে সে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তাঁর সেবা করেন। রাত ৪ টার পর ওই যোদ্ধা চলে যান।
পরদিন ১৪ই এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯ টার দিকে হানাদার সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমানের ইঙ্গিতেই আমার স্বামী গ্রেফতার হন। উর্দু ভাষায় “ইনি হিন্দু” বলে স্বামীকে ধরিয়ে দেওয়া হয়।
হানাদার বাহিনীর ঘাতকেরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে বিনোদপুরে ফেলে রেখে যায়। এটা তখন আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুধ দিতেন এক ঘোষ। তিনি বিনোদপুরে এক দিঘির পাড়ে আমার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আমার স্বামীর মৃতদেহ তাঁর কাজলার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠোনে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। তিনি সেদিনই পরিবারসহ ভারতে চলে যান। ফলে আমাকে খবর দিতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে তিনি ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁর দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে শহীদের মর্যাদায় পুনঃসমাহিত করে”।
সুখরঞ্জন সমাদ্দারের চাকরির মেয়াদ ১০ বছর পূর্ণ না হওয়ায় চম্পা সমাদ্দার তাঁর স্বামীর পেনশন বা এককালীন কোনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এমনকি সরকারি কোনো অনুদানও পাননি তিনি। চম্পা সমাদ্দার ম্যাট্রিক পাস ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ মিসেস সমাদ্দারকে পড়াশোনা করতে অনুপ্রেরণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ৯০০ টাকা করে ভাতা বরাদ্দ করে। এভাবেই চম্পা সমাদ্দার এম.এ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে সহকারী হাউস টিউটর হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করে অবসর নেন।
শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের একমাত্র ছেলে সলিল রঞ্জন সমাদ্দার পেশায় চিকিৎসক। বাবার আদর্শের ন্যায় তিনিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপিত। দুই মেয়ে মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার কলেজ ও স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাবার মতো তারাও সঙ্গীত চর্চা করেন।
লেখকঃ উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।