শিক্ষায় শিক্ষার অবক্ষয়

মো শাকিল আহমেদ

সকালে কোন একটা অনলাইন পোর্টালের নিউজ পড়লাম, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর পলিটেকনিক নিয়ে ভাবনা। নিউজ টা পড়ে যতটুকু বুঝেছি সরকার শিক্ষা ব্যাবস্থার আমুল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। জানিনা কতটুকু ফলপ্রসু হবে।
তবে শিক্ষা ব্যাবস্থার যে পরিবর্তন করা উচিৎ সেটা যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বুঝেছে তাতেই কিছুটা স্বস্থি পাচ্ছি। জানিনা তাদের চিন্তাভাবনা বা আমাদের নাগরিক চিন্তাভাবনা কতটুকু মিল থাকবে। তবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে যতটুকু আমরা চাই হয়তো শিক্ষা ব্যাবস্থার পরিবর্তন টা আমাদের চাওয়া মতই হবে।

শিক্ষা ব্যাবস্থা সম্পর্কে বলার আগে, নিজের সম্পর্কে ২-৪ টা কথা বলি। আমি হয়তো অযথা বিষয় নিয়ে কথা বলি। মানে আমার কাছে বিষয় গুলো কাজের কিন্তু অন্যের কাছে এগুলো শুধুই অযথা।

কারন নাগরিক জীবনে দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা থেকে সাধারণ নাগরিক কে ইচ্ছাকৃত ভাবেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। তাইতো সবকিছু দেখা সত্বেও নিজেকে চুপ করিয়ে রাখতে হয়। আর সেজন্য আমার আলোচ্য বিষয় গুলো অনেকের কাছে অযথা মনে হবে,যদিও বিষয় টা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

“শিক্ষা জাতীর মেরুদণ্ড” এটা ছোটবেলা পড়েছি। কিন্তু এই শিক্ষা দিয়েই যে একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে তাকে পঙ্গু করে নিজের অধিনস্ত করে রাখা যায় সেটা আমরা আমাদের আধুনিক সমাজে পরিলক্ষিত করছি।
আধুনিক সমাজের শিক্ষা কে ব্যাবসায় রুপান্তর করে একদিকে মুনাফা ভোগের প্রতিযোগিতা অপরদিকে ভয়ানক ছাত্র রাজনীতির অপছায়া দিয়ে জাতিকে মেরুদণ্ড হীন করে রাখার প্রচেষ্টা টা আমরা ছাত্রসমাজ খুব ভালোভাবেই গ্রহন করেছি।

ছোটবেলা থেকে আমরা পরিবার থেকে শুনেছি “বাবা, ভালো করে পড়ালেখার কর,তাহলে ভালো চাকরি পাবি,আর জীবন স্বার্থক “।
জানিনা ভালোভাবে পড়ালেখা করে কার জীবন কতটা স্বার্থক,যদিও স্বার্থক হয়েছে কিন্তু প্রকৃত মানুষ হতে পারিনি অনেকে,তাইতো দেশের বিশেষায়িত পদগুলোতে আজ শুধু ঘুষ বানিজ্য আর আত্নসাৎ করার তীব্র প্রতিযোগিতা।

ভেবে দেখুন দেশের যত বড় বড় দুর্নীতি করে সেগুলো কে নীতি বানিয়েছেন, তারা সবাই কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত। কারন দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার মূলনীতি হলো ভালো চাকরি বা ভালো জীবন। কিন্তু ভালো মানুষ যে হতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় সে শিক্ষা আছে কিনা আমি জানিনা।

শুধু ক্লাস টেন পর্যন্ত বা কয়েকটা শ্রেনীতে ভ্যালুলেস ২-৩ অধ্যায় আছে নৈতিকতার। সেটাও একজন শিক্ষিত উচ্চ শ্রেনীর কর্মকর্তার কতটুকু মনে আছে, বা তার সে শ্রেনীতে তিনি কতটুকু নিজের উপর প্রয়োগ করেছে, সে ব্যাপারে আছে বিস্তর সমস্যা। তাইতো নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা আপোষহীন হলেও বাস্তবিক সমাজে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তবে আছে দু চারটা সমাজের কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত অববাহিকায়।

দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার অন্যতম বড় লক্ষ্য হলো সরকারী চাকুরি। অথচ এখানে যে কতভুলভাল আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে,বা প্রতিনিয়ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে হয়তো আমরা কখনোই চিন্তা করিনি,কারন আমাকে সেভাবে শিক্ষা দেয়া হয়নি। কিছু ভুল বা অপ্রয়োজনীয় বিশদ ভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে টা দমিয়ে রাখতে পারলাম না, কি বলেন করেই ফেলি নাকি??

১. ২০০৯ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটির মৃত্তিকা অনুষদ থেকে অনার্স ও মাষ্টার্স করা গোল্ড মেডেলিষ্ট একজন বিজ্ঞানি জার্মানির University Of Hehenhiem থেকে পিএইচডি করা একজনকে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি৷ গাজিপুরে অবস্থিত কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এর একটা নিয়োগ পরীক্ষা তে নাকি তিনি পাশ করতে পারেনি। না করার কারন হিসেবে তিনি জানান,সাধারনজ্ঞান বিষয়ে ফেল করেছেন।

কারন তিনি মৃত্তিকা অনুষদে পড়ে কতসালে কার বিয়ে হয়েছে,বা সন্তান হয়েছে,বা কতসালে কে প্রথম ক্রিকেটে হেট্রিক করেছে সেটা সে জানেনা। সে জন্য তার চাকরি হয়নি। পরে তিনি সেই ইউনিভার্সিটিতে তার ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর হিসেবে জয়েন করে, আজ তিনি সে ইউনিভার্সিটির অন্যতম একজন রিসার্চার হিসেবে কর্মরত আছেন।

পিএইচডি করে তিনি দেশে ফেরত এসেছিলেন জনগনের টাকায় ভার্সিটিতে পড়ে দেশকে কিছু দেয়ার জন্য। কিন্তু আমার শিক্ষা ব্যাবস্থা বা পরীক্ষা পদ্ধতি তাকে সুযোগ দেয় নি,এমন হাজার হাজার উদাহরণ আমাদের সমাজে অহরহ।

২. আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৫ পাশ করা গুগলের প্রথম বাংলাদেশী প্রিন্সিপাল সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হওয়া “জাহিদ সবুর” কিন্তু বেসিস বা বাংলাদেশী কোন সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি পাননি পাশকরার দীর্ঘ ২ বছর৷ অনেক কোম্পানিতে ঘুরে শেষে কোন এক বন্ধুর পরামর্শে গুগলে আবেদন করেন এবং ২০০৭ সালে তিনি গুগলে জয়েন করেন, এবং বর্তমানে তিনি ব্যাঙ্গালোর ইন্ডিয়া তে গুগলের অফিসে কর্মরত আছেন।

তার একটা আর্টিকেল পড়ে জেনেছিলাম, তিনি বাংলা বা সাধারনজ্ঞান খুব একটা পারতো না,কারন তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্জিনিয়ারের পোষ্টে অলরাউন্ডার চাওয়া হয়। বলেন তো একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারের বাংলা,মেথ বা সাধারণজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কি?

৩. বর্তমান সমাজের সবচেয়ে মানে তরুন সমাজের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় সরকারী জব,চাহিদার শীর্ষে থাকা ” বিসিএস ক্যাডার”। এখানেও অনকে বড় একটা গলদ রয়েছে। বিসিএসের পরীক্ষা দেয়ার নূন্যতম যোগ্যতা স্নাতক বা সমমান। কিন্তু প্রিলি থেকে লিখিত দুটো পরীক্ষাতেই পরীক্ষার বিষয়বস্তু বা প্রশ্নের ধরন হলো, ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে দশম শ্রেনীর পাঠ্যপুস্থকের পঠিত বিষয় বস্তু। যদি আমার পরীক্ষার প্রশ্ন দশম শ্রেনী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়,তাহলে স্নাতক পর্যন্ত জনগনের টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বা ইন্জিনিয়ারিং এ পাশ করিয়ে প্রশাসন ক্যাডার বানানোর উপকার টা কি? প্রতিবছর বুয়েটের অনেক ইন্জিনিয়ার প্রশাষন ক্যাডারে বিসিএসে জয়েন করেন। এখান চিন্তা করুন,একজন মেডিকেলের ছাত্র বা ইন্জিনিয়ারিং এর ছাত্র বা ছাত্রীকে প্রশাষন ক্যাডার বানিয়ে জাতির কতটাকা নষ্ট করা হলো?

লেখক 
মো শাকিল আহমেদ
শিক্ষার্থী
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Scroll to Top