শিশুর বিকাশস্থল যখন পরিবার

উম্মে কুলসুম রিমা


“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার “


একটি শিশুর আগমনই একটি পরিবারে পূর্ণতা নিয়ে আসে৷ সন্তানের ওই হাসি মাখা মুখটি যেন হাজারো ক্লান্তির এর মাঝে এক প্রশান্তির ছায়া নিয়ে আসে। একটি শিশুর জন্মতেই যেমন একটি পরিবার পূর্ণতা লাভ করে, তেমনি শিশুটির পূর্ণতা বা বিকাশ এ পরিবারটির ভূমিকা কিন্তু অনস্বীকার্য।

একজন শিশুর শারীরিক , মানসিক , সামাজিক প্রভৃতি বিকাশগুলো ঘটতে শুরু করে পরিবারের মধ্যেই। শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো তার শারিরীক বিকাশ। অপরদিকে, মানসিক বিকাশ হলো তার চিন্তা-চেতনা, আচার-ব্যবহার, কথা বলা ও ভাবের আদান – প্রদান এর ক্ষমতা অর্জন। শারিরীক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।

একটি পরিবার যেমন একটি শিশু কে শিখাতে পারে ভালোবাসা, সহানুভূতিতা, সহযোগিতা, ভদ্রতা ইত্যাদি গুণগুলো ঠিক একই ভাবে সেই পরিবারই তাকে করে তুলতে পারে মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ। কারণ, জানেনই তো শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। চোখের সামনে যা সংগঠিত হতে দেখে তা অধিকাংশ সময়ই সে রপ্ত করে নেয়। আশেপাশের অন্যদের নানাবিধ কাজকর্ম, চলাফেরা, কথা বলার ধরন ইত্যাদি দেখে সে সেগুলো অনুকরণ করা শুরু করে।

তাই, যদি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই পূর্ণ মানসিকতার সুষম বিকাশ ঘটানো যায় তাহলে সে সকল বিপত্তি অতিক্রম করে সমাজের একজন কাঙ্ক্ষিত সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে, ভবিষ্যতের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

চলুন, জেনে নেওয়া যাক পরিবার কিভাবে একটি শিশুর মানসিক বিকাশ কে তরান্বিত করতে পারে

প্রথমত, ‘শিশুদের সাথে সময় কাটানো’। বর্তমানে অধিকাংশ মা-বাবা কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন, সন্তানদের সময় দিতে পারেন না, ফলে সন্তানরা এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। তারা ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত হতে থাকে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকার পর বাবা মা ক্লান্তিবোধ করেন, কারো কারো মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে যার প্রভাব অনেক সময় শিশুদের উপর বর্তায়, ফলে মানসিক বিকাশ হয় বাধাগ্রস্ত। তাই, প্রতিটি বাবা মায়ের উচিত সন্তানদের সাথে প্রতিনিয়ত একটি কোয়ালিটি টাইম কাটানো যাতে মানসিক বিকাশ হয় পরিপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, ‘পারিবারিক কলহ থেকে শিশুদের বিরত রাখা’ শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই। মা-বাবার মাঝে ভালোবাসা, সহযোগিতা, পরস্পরের প্রতি সম্মান ইত্যাদি বিষয় যখন শিশুর দৃষ্টিগোচর হয় তা কিন্তু সে ভালোভাবেই রপ্ত করে নেয়। কিন্তু মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী সন্তানদের মাঝে পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তারা হয় বেশ খিটখিটে, রাগী, আক্রমণাত্বক স্বভাবের। সমাজের সাথে মানিয়ে নিতে তাদের বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। মা-বাবার মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক দেখে বেড়ে ওঠা শিশুদের অন্যান্য শিশুদের তুলনায় মানসিক বিকাশ দ্রুত হয়। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত ঝগড়া-বিবাদ বা কলহ সংগঠিত হবার সময় শিশুদের এসব থেকে আড়াল রাখা যাতে তাদের দৃষ্টিগোচর না হয় ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়।

তৃতীয়ত, ‘শিশুর সামনে মাকে নির্যাতিত না করা’ একটি শিশু জন্মের পর থেকে সবথেকে কাছে পায় ‘মা’ কে। ফলে মমতাময়ী ‘মা’ হয়ে ওঠে তার কাছে এক আদর্শ, ভালোবাসার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু সেই ‘মা’ কে সে যখন তার সামনে নির্যাতিত হতে দেখে তখন সে ভোগে বিষন্নতায়, হয়ে ওঠে আক্রমণাত্বক। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত ও অসহায়। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষন্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু।’ আর সন্তানের সামনে মা কে নির্যাতিত হওয়া থেকে বিরত রাখাটা পরিবারের উপর ই বর্তায়।

চতুর্থত, ‘শিশুদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া’। আমরা অধিকাংশ সময় শিশুদের মতামতের গুরুত্বই তো দেই না বরং তাদের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শগুলো নিয়ে হাঁসি ঠাট্টা করে থাকি যা মোটেও ঠিক নয়। এতে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়ার দরুণ তারাও অন্যের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে না।

পঞ্চমত, ‘শিশুদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা’। অনেক মা-বাবা আছেন যারা সন্তানদের স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে দিতে চান না কিন্তু এ ধরনের অভ্যাস শিশুর আত্মনির্ভরশীল হবার পথে বাধার সৃষ্টি করে। একটি শিশু নিজে থেকে স্বনির্ভর হয়ে কোন কাজ করলে তার মাঝে একধরনের আত্মবিশ্বাস এর সৃষ্টি হয় যা তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করে। তাই, সন্তান তার সামর্থ্য অনুযায়ী নিজে থেকে কোন কাজ করতে উদ্ধুদ্ধ হলে তাকে না আটকিয়ে বরং অনুপ্রানিত করা উচিত।

তাছাড়াও, ভদ্রতা, নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, কৃতজ্ঞতাবোধ, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন, কনিষ্ঠদের স্নেহ-আদর করা, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, পরোপকারিতার মানসিকতা গড়ে তোলা, উদার মানবিকতাবোধ জাগ্রত করা ইত্যাদি যাবতীয় গুন গুলো একটি শিশু পরিবার থেকে আয়ত্ত করে তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত, প্রতিটি পরিবারকে একটি সুস্থ মন ও মননের বিকাশ কেন্দ্রে রুপান্তর করা কারণ।

মনে রাখতে হবে- ” আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত “।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment