শুভ জন্মদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

ভিসির শেষ কামড়ের বলি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক, দুই ছাত্র!

আল মামুন সরদার, খুবি প্রতিনিধি: দক্ষিণবঙ্গের জ্ঞান অর্জনের তীর্থক্ষেত্র ও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হৃদয়ের আলিঙ্গনে সিক্ত শ্রেষ্ঠ একটি বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি খুলনা মহানগরী থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে গল্লামারীতে অবস্থিত।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর ৪টি পাঠ্য বিষয়ের ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে । আজ ২৫শে নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সাফল্য ও সুনাম অক্ষত রেখে তিন দশকের কোঠা স্পর্শ করলো।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বধ্যভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাতিঘর হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রথম ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র সেশনজটমুক্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সকলের কাছে সমাধিক পরিচিত।

তিলে তিলে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টির সৃষ্টির পেছনে আছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিকামীদের বেতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত একতলা ভবনটি দোতলা করণের মাধ্যমে শুভ যাত্রার সৃষ্টি হয় খুবির। যেটি আজ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবন।

ইতিহাসের কালো অধ্যায় আর একাত্তরের নির্মমতার সাক্ষ্য বহনকারী বধ্যভূমির উপর দাঁড়িয়ে আজকের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের শিক্ষার প্রসারের জন্য ও তাদের দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফলস্বরূপ এই প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭৪ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে খুলনা বিভাগে উচ্চ শিক্ষার্থে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সরকারী সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদে ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯০’ পাশ হয়।

প্রথমে ২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্যপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এরপর থেকেই প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়ে আসছে। আজ তিন দশকের কোঠা পেরিয়েছে দেশের দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৬ টি স্কুল ও ২ টি ইনস্টিটিউডের অধীনে ২৯ টি ডিসিপ্লিনে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে সাফল্যের সাথে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। শিক্ষাদানে রয়েছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক, যাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আবাসিক সুবিধার জন্য আছে ৩ টি ছাত্র ও ২ টি ছাত্রী হল। ছাত্ররাজনীতিমুক্ত থাকার কারনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থাকে সর্বদা স্লোগানমুক্ত। দলীয় ব্যানার ও পোস্টারের নেই কোনো ছড়াছড়ি। মুক্তচিন্তার বিকাশে শিক্ষার্থীরা জীবন গড়ার প্রত্যয়ে প্রতিনিয়ত সাফল্যের সংগ্রামে লিপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক দাঙ্গায় খালি হয়নি কোনো মায়ের কোল। সন্ত্রাসের কালো থাবায় কখনো রক্তে রঞ্জিত হয়নি নীল-হলুদ বাসের এই ক্যাম্পাস।

বাংলার রূপের সাথে মিশে আছে সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় ভরা খুবির ক্যাম্পাস দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় দর্শনার্থীদের। সুন্দরবনের সৃত্মি রক্ষাত্মে একটা অংশ জুড়ে রয়েছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজী। হরেক রকমের পাখির আনাগোনায় ক্যাম্পাসের পূর্ণতা ফিরে আসে। সামাজিক ও সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আছে ৩০ টির বেশি সংগঠন। নৈয়ায়িক (বিতর্ক সংগঠন),বাঁধন (রক্তদান ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন), খুবিসাস, রোটারেক্ট ক্লাব, পোডিয়াম (স্পিকিং), কৃষ্টি (সংগীত), ভৈরবী (সংগীত), স্পার্ক (নৃত্য), নৃ-নাট্য, ছায়াবৃত্ত, নয়েজ ফ্যাক্টরি, খুলনা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফি সোসাইটির মতো সংগঠন। এসব সংগঠন তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উপহার দিচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মেধাবীদের আর তুলে ধরছে শিক্ষিত তরুণদের সমাজের প্রতি মানবতার চিত্র।

“বারো মাসে তেরো পার্বণ” আবহমান বাংলাদেশের এই প্রবাদ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও লক্ষ্য করা যায়। পিঠা উৎসব, বাউল উৎসব, পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখের আয়োজন ক্যাম্পাসে গ্রাম বাংলার এই আবহকে জানান দেয় প্রতিবছর। তিনদিন ব্যাপী শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান ‘র্যাগ ডে’ ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠানে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক অনুষ্ঠানে ক্যাম্পাস থাকে সর্বদা মুখরিত।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র শিক্ষাদানকে প্রসারিত করছে না, বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও দিকনির্দেশনা প্রদানে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মনুষ্যসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা ঝুঁকি মোকাবেলার পন্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাস-উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে ক্যাম্পাসটি রাখছে নানামুখী অবদান।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মধ্যে উদ্ভাবনীতে শীর্ষস্থান, গবেষণায় দ্বিতীয় এবং সামাজিক গবেষণায় ৬ষ্ঠ স্থান অর্জন করে। ২০২০ সালে উদ্ভাবনীতে শীর্ষস্থান ধরে রেখে ধারাবাহিতা বজায় রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সুনাম কুঁড়িয়ে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পরথেকে যেমন সফল্যের জয়গান আছে তেমনি এখানে রয়েছে আবাসন সংকটসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে ১০৬ একর জমির সাথে নতুন করে ২০৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবে একটু হলেও স্বস্তির নিশ্বাস হবে বলে আশা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্প্রসারিত এই নতুন ক্যাম্পাস করা হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। নাম হবে—খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাস।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে বেশ কিছু নির্মাণাধীন কাজ। চলতি উন্নয়ন পরিকল্পনায় আরও একটি দশতলা একাডেমিক ভবন (জয়বাংলা ভবন), লালন সাঁই মিলনায়তন (টিএসসি) সুলতানা কামাল জিমনেসিয়াম ভবন, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী মেডিকেল সেন্টারসহ বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব ভবনের কাজ আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে শেষ হলে ক্যাম্পাসে যোগ হবে নতুন মাত্রা। যার মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও আশাজাগানিয়া গল্পের সৃষ্টি হবে।

নতুন এই ক্যাম্পাসে আগামী দিনের চাহিদার আলোকে যুগোপযোগী শিক্ষা, গবেষণাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বিষয় খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সামুদ্রিক সম্পদ বিকাশ, আহরণ, সংরক্ষণের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির বিকাশ, জলবায়ু ও উপকূলীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সুন্দরবন নিয়ে অধিকতর গবেষণা, মহাকাশ বিজ্ঞানসহ নতুন নতুন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত বিষয়, সামাজিক ও মানবিক বিদ্যার নতুন নতুন শাখায় উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার ওপর আগামী দিনে জোর দেওয়া হবে। যার মধ্যে দিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব পরিমণ্ডলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তার সাফল্য জানান দিবে।

এবছরে করোনা মহামারীর কারণে ব্যাপক আয়োজন সম্ভব না হলেও সীমিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি এবং একই সাথে তিনদশক পূর্তি উদযাপনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ১০-৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, বেলা ১১টায় ওয়েবিনারে আলোচনা সভা, বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে দোয়া মাহফিল ও মন্দিরে প্রার্থনা। এছাড়া ক্যাম্পাসের মেইন গেট, রাস্তা, শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন ভবনে আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়েছে।

নীল-হলুদ বাসের এই ক্যাম্পাসটি প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করার মধ্য দিয়ে তাদের ভিতরে একবুক স্বপ্নের আশা জাগায়। নতুন করে বাঁচতে শেখায়। ছাত্ররাজনীতির করাল গ্রাসো তাদের স্বাধীনভাবে মুক্তচিন্তার কুঁড়েঘরে জ্ঞান ভাণ্ডার সংগ্রহের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে না। তপনদা কিংবা সাইদুল ভাইয়ের দোকানে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গল্পে মেতে থাকা প্রতিটি শিক্ষার্থীর রয়ে যায় হাজারো জীবনগল্প। ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের এমনি হাজারো আশাজাগানিয়া গল্প শোনার প্রতিক্ষায়। হাজার বছর বেঁচে থাকুক ভালোবাসার ক্যাম্পাস। চিরযৌবনা থাকুক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। শুভ জন্মদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment