শুভ জন্মদিন নড়াইল এক্সপ্রেস

মো মিনহাজুল ইসলাম


আজ বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক ও নড়াইল ২ আসনের মাননীয় সাংসদ মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্মদিন। আজ ৫ অঅক্টোবর, ১৯৮৩ সালের আজকের এই দিনে বাংলাদেশের দক্ষিণ – পশ্চিমের জেলা নড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

ক্রিকেটের প্রতি যে মানুষটার এতো ভালোবাসা, যেই মানুষটা তার ১৬ বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে ১১ বার ছুরি-কাঁচির নিচে বসেছেন শুধুমাত্র ক্রিকেটের জন্য, সেই মাশরাফির উত্তান পতন নিয়ে কয় জনেই ব জানেন?নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্মদিন উপলক্ষে ম্যাশের পুরো ক্যারিয়ারের সারাংশ জানানোর চেষ্টা করব আজকের আয়োজনে :

ক্রিকেট প্রিয় মাশরাফির ছোট বেলা কেটেছে ব্যাডমিন্টন আর ফুটবল খেলে, পাশাপাশি বাধাঁধরা পড়াশোনার পরিবর্তে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন চিত্রা নদীতে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ১৪০ কি.মি. এর বেশি বেগে বল করে যে মাশরাফি প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইন আপে ধস নামিয়েছেন, নড়াইল এক্সপ্রেস নাম পেয়েছেন, সেই মাশরাফির ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মে তারুণ্যের প্রথম দিকে, তাও আবার ব্যাটিংয়ে! পরে অবশ্য নাম করেছেন বোলিংয়েই।

শুধু নড়াইল এক্সপ্রেস নয়, এ নাম বাদেও তার অন্য একটা নাম আছে! সেই নামই বা কয়জন ক্রিকেট প্রেমী জানেন?
মাশরাফি বাইক চালাতে পছন্দ করেন, এমনকি তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণার অধিকাংশ সময়ই প্রচারণা চালিয়েছেন বাইকের পেছনে বসেই। নিজ এলাকায় গেলে সুযোগ পেলেই মাশরাফি প্রতিদিন নিজের এলাকার স্থানীয় ব্রীজের এপার থেকে ওপারে ঘুরে আসেন। স্থানীয়দের খোজ খবর নেন। মাশরাফি ব্যবহার, মানবিকতায় তার এলাকার মানুষ মুগ্ধ, তাই মাশরাফির এলাকার মানুষ তার অন্য এক নাম দিয়েছে ‘প্রিন্স অব হার্টস’।

মাশরাফি ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগে নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় মাশরাফির পরিচয় হয়েছিল সুমনা হক সুমির সাথে। মন দেওয়া নেওয়ার পর ২০০৬ সালে দুইজনে ঘর বেঁধেছেন। তাদের ঘর আলোকিত করে এসেছে দুই সন্তান।

সব সময় হাসি-খুশি মাশরাফির ব্যক্তিগত জীবনে কোনো দাগ না থাকলেও ক্রিকেটীয় জীবনে বার বার ইঞ্জুরিতে পড়ে ক্ষত হয়েছে তার ক্যারিয়ার। তবে তিনি যে মাশরাফি,আর আট/দশ জন সাধারণ খেলোয়াড়ের মতন নন তিনি। তাই যত বার ইঞ্জুরিতে পড়েছেন, ঠিক তত বারই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

মাশরাফি যখন মাত্র অনূর্ধ্ব ১৯ দলের খেলোয়াড়, তখনই তিনি মন জয় করেছিলেন তৎকালীন অনূর্ধ্ব ১৯ দলের বোলিং কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার এন্ডি রবার্টসনের। গতি ও আক্রমণাত্মক খেলা দেখিয়ে মাশরাফি সুযোগ পান বাংলাদেশ ‘এ’ দলে। আর ‘এ’ দলের হয়ে মাত্র ১ ম্যাচ খেলেই তিনি ডাক পান জাতীয় দলে। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাননি নড়াইল এক্সপ্রেস।

৮ নভেম্বর ২০০১, এই তারিখ টা মাশরাফির কাছে তার জন্মদিনের মতই প্রিয়। কেননা এদিনেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল তরুণ মাশরাফির। বৃষ্টি বাধায় ম্যাচটা পন্ড হলেও মাশরাফি ১০৬ রানে ৪ উইকেট নিয়ে তার জাত চিনিয়ে দেন। উল্লেখ্য, এর আগে মাশরাফি কোনো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেননি। তাই ১৮৯৯ সালের পর এটা তৃতীয় রের্কড কোনো খেলোয়াড়ের জন্য, আর খেলোয়াড় হিসেবে ৩১ তম।

একই বছরের ২৩ নভেম্বর ওয়ানডেতেও অভিষেক হয় বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কের। সেদিনও তিনি ছিলেন সফল। মাত্র ৮.২ ওভার বোলিং করে ২৬ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট।

তবে মাশরাফির ক্যারিয়ারে প্রথম বাধা আসে তার ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্টেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্ট ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে মাশরাফি হারিয়েছেন তার ক্যারিয়ারের প্রায় দুই বছর। এর পর আবারো হাটুতে আঘাত পেয়ে মাঠের বাহিরে থাকেন আরো ১ বছর।

সাল ২০০৪, ভারতের বিরুদ্ধে সেই সময়ে এক সিরিজে বাংলাদেশের দুর্দান্ত এক জয়ের নামক ছিলেন এই মাশরাফি। ২০০৬ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র জয়েও তার অবদান ছিলো অসামান্য।

সেই ম্যাচে তিনি দশ ওভার বোলিং করে ছিলেন খুব মিতব্যয়ী, খরচ করেছেন মাত্র ৩৩ রান। সব মিলিয়ে ২০০৬ সালটা ছিলো শুধুই মাশরাফির, কেননা ২০০৬ সালের ক্রিকেটীয় ক্যালেন্ডারে ৪৯ উইকেট নিয়ে সেরাদের সেরা ছিলেন বাংলার মাশরাফি। ২০০৪ সালের পর ২০০৭ এর বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোর দ্বিতীয় স্বাদ নেয় বাংলাদেশ, ওই জয়েও অবদান ছিল বোলার মাশরাফির। সে দিন ৩৮ রানে মাশরাফি নেন ৪ টি উইকেট।

বাংলাদেশী কোনো ব্যাটসম্যানের ১ ওভারে সর্বোচ্চ রান কত? সেই রেকর্ডটি কার অধীনে?
অনেকেই হয়তো তামিম, সাকিব বা মুশফিকের কথা বলবেন, অর্থাৎ ঢিল ছুড়বেন। কিন্তু ১ ওভারে পর পর চার বলে চার ছয় মেরে সর্বোচ্চ ২৬ রান করার রেকর্ড সেই মাশরাফির দখলে।

ইনজুরি মাশরাফিকে এতই ভুগিয়েছে যে, মাশরাফির চোটের কারণে খেলতে পারেননি ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপটিও। এই স্মৃতি হয়তো মাশরাফিকে পোড়াবে আজীবন।

তবে মাশরাফিও দমে যাননি, ফিরে এসেছেন। কেননা তিনি ক্রিকেটের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ডাক্তার যখন বলেছেন অপারেশন আবার করলে পা কেটে ফেলতে হবে! তবু্ও তিনি পিছু হটেন নি। ইনজুরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাঙিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারকে।

বাংলাদেশকে দিয়েছেন অনেকগুলো জয়ের স্বাদ। তার নেতৃত্বের কারণেই ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের মতো দল গুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে। ২০১৬ সালে তিনি গড়েন অনন্য এক রেকর্ড, বাংলাদেশী বোলার হিসেবে ২১৬ উইকেট নেওয়ার কৃত্বিত গড়েন তিনি। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল অধিনায়ক থাকাকালীন তিনি টি২০ খেলা থেকে অবসরে যান।

খেলোয়াড়ী জীবনের পাশাপাশি মাশরাফি সফল তার রাজনৈতিক জীবনেও। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি নড়াইল ২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন।

এর আগে ২০০৯ সালেই ম্যাশ বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব পান, ছোটের কারণে বাহিরে থাকলেও ২০১৪ সালে পুনরান তিনি অধিনায়কের পদ পান। ২০১৫ ও ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ মার্চ জিম্বাবুয়ের সাথে সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচের পর তিনি অধিনায়কের পদ থেকে সরে গেলেও, কথা দিয়েছেন ক্রিকেটকে এখনো ছাড়বেন না।

তার নেতৃত্ব গুণে বাংলাদেশ প্রথম ত্রি দেশীয় সিরিজ জয়ের স্বাদ পায়, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনালে খেলে, এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলে। বিশ্বকাপে বাঘা-বাঘা দল গুলোর জন্য গলার কাটা হয়ে উঠেছিল যেই দামাল ছেলেরা, তাদের সাহস জুগিয়েছিলেন এই মাশরাফিই।

কাপ্তান মাশরাফি ৮৮ টি ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন, যেখানে জিতিয়েছেন ৫০ টি ম্যাচ। শতকরা হিসেবে জয়ের হার ৫৬.৮ % অধিনায়ক হিসেবে সম্প্রতি তিনি গড়েছেন আরো একটি রেকর্ড, অধিনায়ক হিসেবে নিয়েছেন প্রতিপক্ষের ১০০ টি উইকেট। যেখানে অন্য সবাই ম্লান এক মাশরাফির কাছে।

সবশেষে একটাই চাওয়া, মাশরাফি যেনো আবারো খেলায় ফিরে আসেন। কেননা তিনি মাঠে থাকলেই যে বাংলাদেশ দল আলাদা এক প্রেরণা পায়, জয়ের ক্ষিধা যেন আরো বেশি লাগে বাংলার বাঘদের। আবারও জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা মাশরাফিকে। শুভ জন্মদিন ভদ্রলোক মাশরাফি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment