কবির কল্পনায় কাল্পনিক সাকি (ছবি-সম্পাদিত)

সাকি: সাহিত্য ও সুফিবাদের আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ


হোসাইন কামাল


কবিতার একটি ঐশ্বরিক আবেদন রয়েছে।কবিদের চিন্তা-চেতনায়, মননে, মগজে এ ঐশ্বরিক শক্তি বারবার খোঁচা দেয়।কখনো স্বপ্নে,কখনো বা বাস্তবে। অনেক ভক্তবৃন্দ তো আবার কবিতাকে ওহীর কাতারেও নিয়ে গেছেন। কবি ইকবালকে বলা হয় “লিসানুল গায়েব” তথা অদৃশ্য সুর, যে সুর কবির নিজের নয়।

কবি নজরুল তার রাজবন্দির জবানবন্দিতে তার বিদ্রোহ বাণীকে উদ্ধৃত করেন এভাবে “এই সুর আমারও নয়,বীণারও নয়। সুর তার যিনি আমার কন্ঠে তার বীণা বাজান। কাজের রাজবন্দী যদি হতে হয়,তবে আমি নই;স্বয়ং ভগবান”।মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গবাণী’র মূল সুর তার স্বপ্নের কুললক্ষ্মী। যিনি স্বপ্নে কবিকে মাতৃভাষায় ফিরে আসার আজ্ঞা দিয়েছেন।

সকল কবিরই একটা কাব্য সৌন্দর্য লক্ষ্মী আছে।যার কাছ থেকে কবি তার কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পান। কবির কল্পনায় কাল্পনিক সাকি (ছবি-সম্পাদিত)বাস্তব জীবনেও বেঁচে থাকার আশা পান। কালিদাসের সরস্বতী, হোমারের আফ্রোদিতি, ভার্জিলের ভেনাস, দান্তের বিয়াত্রিসে, রবীন্দ্রনাথের মানসী,পেত্রার্কের লরা,.কীটসের ফেনিব্রাউন, হাফিজের শাখ ই নাবাত, বোদলেয়ারের সাবাতিয়ের, জীবনানন্দের বনলতাসেন। এদের মধ্যে অনেকে কবিদের বাস্তব জীবন সঙ্গীনী হিসেবেও ছিলেন।

আর্জেন্টিনার নারীবাদী নেত্রী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কমতি ছিলো না। নানান গল্প কবিতায় এই প্রেয়সীর কথা টেনে এনেছেন। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমায়,ওগো বিদেশিনী’ নামে গানের সুরও বেধেছিলেন। প্রকৃতির কবি উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়ার্থ তো তার কাব্য মানসে প্রকৃতির স্বর্গীয় অনুভূতিকে কখনো নারী চরিত্ররূপে হৃদয়ে ধারন করেন।

এক কথায়,কবিদের এই নারী সূলভ চরিত্রগুলো তাদের মানসে কবিতা লেখার স্পৃহা দিয়েছেন যা প্রেম ও স্বর্গীয় আরাধনার স্তুতি যোগিয়েছে। ফলশ্রুতিতে হাজার বছর পরও পাঠকের হৃদয়ে অনুরনন হচ্ছে।

সাকি ফার্সি সাহিত্যের এক কালজয়ী চরিত্র। এই চরিত্রের সাথে ইতিহাস ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যেরও কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে। কবিতার কাব্যরসের পাশাপাশি সুফিবাদের বিশেষ জগতেও এই সাকির অবস্থান। পরবর্তীকালে তা দেশ-কালের গন্ডি পেরিয়ে যায়। লোক মুখ থেকে শুরু করে ভারতীয় বলিউডের গানেও এই সাকি’র উপস্থিতি! আক্ষরিক অর্থে সাকি আরবী শব্দ। যার অর্থ শরাব বা মদের পেয়ালা পরিবেশন কারী।

পবিত্র কোরআনে শরাব ও সাকি শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। হুর ও গেলমানকে সাকি সম্মোধন করা হয়েছে। শব্দটি দেখতে স্ত্রী লিঙ্গ হলেও মূলত উভয়লিঙ্গিক। সমগোত্রীয় কারো শারিরীক সৈন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কবিতা লেখাটা কবিদের কাছে অস্বাভাবিক কিছু না।উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অনেক সনেটে তার বন্ধুর শারিরীক গঠনের বর্ণানার কথা আছে। কিশোর বালকের প্রতি প্রেম,ইন্দ্রিয়ানুভূতি বহুপ্রাচীন এক ধারণা। আবার প্রাচীন গ্রীক কবিতায় নারীতে নারীতে আকুল কামনার(Lesbian) কথাও উঠে এসেছে।


বিখ্যাত কবি সাফোর ভাষায়

“Stand up and gaze on me
As friend to friend,love to love.
Reveal open by to me,
The beauty in your eyes”.


যাহোক,ফার্সি ও উর্দূ ভাষাভাষী জগৎবিখ্যাত কবি হাফিজ, খৈয়াম, শেখ সাদী, গালিবের কবিতায়ও সাকিরা এসেছেন। কখনো সরাসরি কখনো বা সুফি অঙ্গনে খোদার দিদারে কল্পনাব্যাঞ্জক রূপক অর্থের ভেতর দিয়ে। ওমর খৈয়াম তার ইয়ামেনী হুরসত প্রেয়সীকে লক্ষ্য করে সাকি’কে এনেছেন তার বিখ্যাত রুবাইয়াতয়ে। তার ভাষায়-


“সাকিকে হালাম যে গাম হেযার নাত
হার জাকে রুযি দাস্ত মান ব’দামানাত
রাফতী ব’হেযার দিল হালাক আযগাম তুস্ত,
বায আনকে সদ হেযার জান কুরবানাত”
অর্থঃ
সাকি! তোমার অভাবে আমার মৃত্যু হাজার বার।
কারণ তোমার আচল আমার হাতে হৃদয় বেধে রাখবার।
তাই তোমার বিদায়ে হাজার প্রাণবধ, আগমনে শত হাজার প্রাণ কুরবানী!


পরবর্তীকালে সুফি ঘরানার স্পর্শে এসে সাকি একটি বিশেষ অর্থে রূপান্তরিত হয়।ইসলামে সুফিবাদের প্রথম ধারনা দেন হাসান বসরী। পরবর্তীতে, ইমাম গাজ্জলী, জালালুদ্দিন রুমি, শেখ সাদী প্রমুখ এই সুফিবাদের ধারাকে কবিতার ছন্দ ও পঙক্তি তে রূপক ভাবে তুলে ধরেন। সুফিবাদ জগতের ভোগ, বিলাসকে বর্জন করে বিশেষ তপস্যা ও আত্মার কলুষতা দূর করে স্রষ্টার প্রেমময় সত্ত্বাকে কাছে পেতে চায়।

স্রষ্টার আযাবের ভয় দূর করে প্রেমের,ভালোবাসার দ্বারা নৈকট্য(দীদার) চায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে ইসলামের বাস্তব অনুশীলন ও আদর্শ থেকে দূরে মনে করা হয়। সুফিবাদের ভাষায় সাকি তথা পানপাত্রদাতা হলেন প্রেমময় ঈশ্বর বা প্রেমদীক্ষা দাতা।শরাব হলো প্রেম/ইশক। পেয়ালা হলো হৃদয়। সুফির মদপানকে রূপক অর্থে নেয়।তাই সাকিকে কখনোই নারী মূর্তি হিসেবে নেয় না।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার লেখায় সুফি ধারনাকে তুলে ধরেন সাকি’র মূর্তিতে।’এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরবি সাকি’,’খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই’ কবির অমর গজল হিসেবে আজও প্রসিদ্ধ।

পারস্যে সুফিবাদের প্রকৃত আদর্শকে সাধনার মাধ্যমে আদর্শিকভাবে রূপান্তরিত করেন বিখ্যাত দার্শনিক, সুফি কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি। তার পাশাপাশি হাফিজ, শেখ শাদি প্রমুখ কবিরাও এই ধারার লোক ছিলেন। সুফিরা গ্রীক তত্ত্বজ্ঞানকে ইসলামের নবধারায় এনে একটি নবযাত্রা সৃষ্টি করেছিলেন, ফলে হেলেনিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে সুফি দার্শনিক ভিত্তি রচিত হয়।আর গ্রীক শব্দ Soph (বোধি) থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি।

যার কারণে অতীতে যিনি সুফি ছিলেন,তাকেই দার্শনিক হিসেবে মান্য করা হতো।সুফিদের নিকট তাদের বোধিচিন্তার মিশেল ঘটেছে গজল, মারেফতি গান, কবিতা ও দার্শনিক তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। পরমাত্মা/মুরশিদকে সাকির মাধ্যমে কল্পনা করে তার মধ্যে বিলিন (ফানাফিল্লাহ) হওয়ার মাধ্যমে জীবনের পরমানন্দকে খুঁজে ফেরে।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *