সাদা-কালো দ্য মিউজিক ক্লাবের পথচলা

শীতের পড়ন্ত বিকেলে টং দোকানে চায়ের আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল। চাদর মুড়ি দিয়ে গিটারের টুং টাং শব্দে সুরেলা কোন এক গানের লাইন গেয়ে বন্ধুদের শোনাচ্ছিলেন দীপংকর সাহা।

এরপর টং দোকানে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতিনিয়ত জমে উঠতো গানের আড্ডা। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জমে উঠা গানের আড্ডা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) জন্ম নেয় ‘সাদাকালো দ্য মিউজিক ক্লাব’।

‘সাদাকালো’ নামের পেছনেও রয়েছে একটি অসাধারণ চিন্তাধারা। সাদা ও কালো রং এর ভেতরেই সবগুলো রং নিহিত, তাই ‘সাদাকালো’ নামের ভেতর দিয়েই আমরা সব রং গুলোকেই বোঝাতে পারি। এখানে ‘রংথ শব্দটাকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরে দীপংকর, রিয়াদ এবং মেহরাবের হাত ধরেই ক্যাম্পাসে ‘সাদাকালো দ্য মিউজিক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও একটি মুক্ত সংগীতচর্চা বিষয়ক সংগঠন। এছাড়া সংগঠনটি সম্পূর্ণভাবে মাদক, অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক, র‍্যাগিং এবং ইভটিজিং মুক্ত।

ক্লাবটি প্রথম যাত্রা শুরু করে ২০১৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বসন্তবরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। পরেরদিন বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে স্ট্রিট শো’র মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে তরুণ-তরুণীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেয়। ধীরে ধীরে সকলের মুখে ছড়িয়ে যেতে থাকে ‘সাদাকালো’র নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও সংগঠনের নবীনবরণ বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের ডাক পড়তে শুরু করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় দুই দিনব্যাপী গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি অনুষ্ঠানে মাতিয়ে রাখে পুরো ক্যাম্পাস। ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, বাঙালিসুলভ ভাবধারার সৃষ্টি হয়, এমন সব গান ছড়িয়ে দিচ্ছে ৫৫ একর ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

তাঁরা সকল ধরেন গান গেয়ে থাকে যেমন আধুনিক, দেশাত্মবোধক, লোকসংগীত, র‍্যাপ এবং ইংলিশ ইত্যাদি। এছাড়া নিজেদের লিখা গানে সুর করে তা উপস্থাপন করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান তারা সবসময় কন্সার্টে গেয়ে থাকেন গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুর সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে; বোহিমিয়ান রকগুরু নগর বাউল জেমসের বাংলাদেশ, বাবা, লেইস ফিতা লেইজ এবং ফকির লালনের খাচার ভিতর অচিন পাখি। তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোর মাঝে আছে বিভিন্ন ধরনের গিটার, পিয়ানো, কাহন, ইউকেলেলে, ম্যান্ডোলিন, বাঁশি এবং ব্যাঞ্জো। এ ছাড়াও, তাদের হাতে তৈরি কিছু বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন।

‘সাদাকালো’ বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক সংগঠন হলেও তাঁরা মানবিক সাহায্য করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে স্ট্রিট শো করে। ইতোমধ্যে তারা মানবিক সাহায্যের জন্য গোপালগঞ্জের লঞ্চঘাট, শেখ ফজলুল হক মণি স্টেডিয়াম; মাদারীপুর এবং খুলনায় কন্সার্ট করেছে। সেখান থেকে যা অর্থ পেয়েছে, সম্পূর্ণ অর্থ অসুস্থ ও মানবেতর জীবনযাপন করা মানুষদের জন্য ব্যয় করেছে। মানুষের কাছ থেকে যে উৎসাহ ও ভালোবাসা পায় সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা না পেলেও তবে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী শিক্ষক আছেন যারা ‘সাদাকালো’র সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতা করছেন। তাদের কর্মকাণ্ডকে আরো এগিয়ে নিতে মিউজিকের জন্য প্রয়োজন একটি রুম ও মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট ড্রামস, প্যাড ইত্যাদি।

নিয়মিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ‘সাদাকালো’ এর ভোকালিস্ট এহ্তেশামুল হক জানান, ‘সংগীতচর্চা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সঙ্গীত অনুরাগীদের কে একত্রিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বচ্ছ বিনোদন প্রদান করা। প্রতি মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আমরা মুক্ত গানের আসরের আয়োজন করি। নিজেদের উদ্যোগে প্রতি সেমিষ্টারে একটি করে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পোগ্রামে আমরা অংশগ্রহণ করি।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আরেক ভোকালিস্ট শাহরুখ ইয়ামিন তামিম জানান, ‘সঙ্গীত অনুরাগীদের সকল ধরনের সংগীতের চর্চা ও বিকাশ। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মনোরম ও সাংস্কৃতিক মনা মনোভাব গড়ে তোলা। অসহায় মানুষেদের কল্যাণে ‘সাদা কালো’ সবসময় পাশে আছে, পাশে থাকবে।

ক্যাম্পাসের সকলের মনে সাদাকালো দ্য মিউজিক ক্লাবের প্রতি এক ভালোবাসা কাজ করে। সাবেক শিক্ষার্থীরা এখনো ক্লাবটিকে স্মরণ করে। ক্লাবটির সদস্য জনি, নাহিদ, শোভন, রিদয়, ফারাবী, শরীফ, আকাশ, সুমন। তাঁরা সকলে ক্যাম্পাসে ‘সাদাকালো’র নামেই পরিচিত।


লেখকঃ শাফিউল কায়েস।


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *