‘হোটেল মেরমাইড বিচ রিসোর্ট’ ইয়েস!!! এই রিসোর্ট টাই বুকিং দিতে হবে । অপূর্ব সুন্দর জায়গা। ভাবতেই আনন্দ লাগছে,আমার এতদিনের অপেক্ষার দিন শেষ হবে।আমরাও একান্তই আমাদের নিজেদের সময় অতিবাহিত করবো।
যেখানে কেউ আমাদেরকে খুঁজে পাবেনা । ল্যাপটপ সামনে বসে গুগলে এই সি সাইড রিসোর্টের রিভিউ চেক করতে করতে নাঈম এইভাবেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
তার সামনে বসে থাকা রিহান অনেকটা চমকে উঠেই বলল,
–>কীরে ব্যাটা? ভয় পাইছি আমি , এইভাবে কেউ চিৎকার করে! আর কী সব বকছিস?কাকে নিয়ে কোথায় যাবি তুই? লপ্রেম টেম করছিস নাকি?আমাকে জানালি অবধি না..”
-তোকে বলার সময় আসেনি দোস্ত , সময় হলে বলবো।এইটুকু জেনে রাখ অনেক মারাত্মক একটা প্ল্যান করছি।সব কিছু যেনো ঠিকঠাক মত সম্পূর্ণ করতে পারি।
–>তোর ব্যাপারটা কি বল তো? বড় মাপের মানুষ হয়ে কি নিজের চরিত্র টাকে নিয়ে এইবার ছিনিমিনি খেলবি নাকি ? আন্টি শুনলে কিন্তু অনেক কষ্ট পাবে, দোস্ত।
-আরে ওইসব ভাবিস না।বাদ দে,আমাকে কাজ করতে দে।ঘুমিয়ে পড় ।
–>দোস্ত, তুই একটা সফল মানুষ তার পাশাপাশি একজন চরিত্রবান পুরুষও। তাই বন্ধু হিসাবে এইটুকু বলতে পারি , যাই করিস খুব চিন্তাভাবনা করে করবি আশা করি।
নাঈমের বেড়ে উঠা মফস্বল এলাকায় । বুদ্ধির পর থেকে বাবা নামক ব্যাক্তিটির সাথে কখনো তার দেখা হয়নি।মায়ের এক হাতে মানুষ হওয়া একমাত্র ছেলে সে।তার মা তাকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে।বাবার অপূর্ণতা কখনো তাকে অনুভব করতে দেননি।
নাঈম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছে।ফলাফল খুব ভালো হওয়ার সুবাদে বিদেশঅ যাত্রার সুযোগ পায়।সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রনিক্সের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে এসেছে।
বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় অনেক ভালোমানের চাকরির প্রস্তাব পেয়েও সে দেশে ফিরে এসে বিসিএস টেকনিক্যাল ক্যাডার সার্ভিসে জয়েন করে।প্রবল মনোবল আর লেগে থেকে সে যথাসময়েই নিজেকে সফলতার শীর্ষে আহরণ করছে। সর্ব গুনে গুনি মানুষটাকে আজ বড়ই বিচিত্র লাগছে রিহানের কাছে।ভাবনায় পরে যায় রিহান,”তাহলে পজিশন কী সত্যিই তার আদবের দ্বারা গড়ে তোলা জগৎটাতে ফাটলের সৃষ্টি করেছে?”
ইদানিং রাতের ঘুম টাও হারাম হয়ে গেছে নাঈমের। দিনের আলো থেকে শুরু করে গভীর অন্ধকারেও সে নীলিমার চিন্তায় মগ্ন থাকে।এই মানুষটা তাকে এতটা ভালো কিভাবে বাসতে পারে?এই কথাটাই তার বোধগম্য হয় না।তার উপর নীলিমার নিঃসার্থ ভালোবাসার বিশালতা ভাবতেই প্রতিটা সময় তার চোখ ভিজে আসে ।
এক গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ফুলে ফেঁপে বের হয়ে আসতে চায় , কিন্তু তার কোনোটাই সে করতে পারেনা। নীলিমার সামনে দাঁড়িয়ে কখনো ভালোবাসি কথাটাও বলা হয়নি । অনেক ভালো বাসতে হবে , নিজের শেষ নিঃশ্বাস টাও তাকেই সমর্পণ করতে হবে । এইসব ভাবতে ভাবতে কখন সকাল হয়ে গেলো , নাঈম বুঝতেও পারেনি । দ্রুত অফিসের জন্য রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো ।
-স্যার , কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি ?
–>হ্যাঁ , রবিউল বলো?কি সমস্যা ? ( নাঈম)
-স্যার আপনাকে আজকে একটু উদাসীন লাগছে।শরীর খারাপ নাকি ? আমি চা করে আনবো?
–>না লাগবে না। আমি বের হবো এখনি । আর তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না । এমনিতেই একটু কাজে আটকে গেছি তাই আর কি ।
রবিউল কিছুটা অবাক হয়েছে কারণ সে আজকে চা দিতে এসে অনেকবার খেঁয়াল করেছে , নাঈম ল্যাপটপে বিভিন্ন অর্নামেন্টস সার্চ করছে ।
নাঈম দ্রুত অফিস শেষ করে বের হয়ে গেলো । জব পেয়েই সবার আগে সে নিজের একটি গাড়ি কিনেছে। অফিসিয়াল গাড়ি থাকতেও সে নিজের গাড়িতেই অফিসে আসা যাওয়া করে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে সে জুয়েলারীর দোকানে যেতে বললো , তার মন আজকে অনেক উৎফুল্ল , তার সবথেকে প্রিয় মানুষটির জন্য উপহার কিনবে ।
হোয়াইট গোল্ডের চেইনের সাথে সুন্দর ডিজাইনের একটি ডায়মন্ডের লকেট নিল এবং ডায়মন্ডের একটি রিং কিনলো।জুয়েলারী প্যাক করতে করতে দোকানের ম্যানেজার বললো , “স্যার!! মনে হচ্ছে কাউকে অনেক বড়ো সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছেন ?
–>হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন । দোয়া করবেন ভাই , যেনো তাকে আমি আপনার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এইভাবেই ভালোবেসে যেতে পারি ।
-ইনশাল্লাহ ভাইয়া । আপনার পছন্দ অনেক সুন্দর , আশা করি উনি খুব পছন্দ করবেন ।
রাতে বাড়িতে ফিরেই সে নীলিমাকে ফোন করলো।সারাদিন পর এই একটা সময়েই সে তাকে ফোন করে এবং নীলিমাও সারাটা দিন এই ফোনের অপেক্ষায় থাকে । রাতে খাওয়া শেষ হয়নি শুনে নীলিমা তার উপর অতিমাত্রায় রেগে গেলো । এই রাগটাই নাঈমের প্রিয় , নীলিমার বকা না শোনা অব্দি সে রাতের খাবার খায় না । মোটামুটি টুকটাক কথা শেষ করে নাঈম জানালো , সে আজ রাতেই তার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হবে । কালকে তাকে সাথে নিয়ে খুব একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজে বের হতে হবে । সকালে সে যেনো সব কাজ গুছিয়ে রাখে আর যেনো কোনো এক্সকিউজ না দেখায়।
নীলিমা কথাটা শুনে তাৎক্ষণিক হকচকিয়ে গেল। তার হাজারটা আপত্তি সত্ত্বেও নাঈমকে সে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারলো না । নাঈম তাকে কঠোর ভাবে জানালো , কালকে যদি সে বের না হয় তাহলে আর কখনোই সে তার কথা শুনবে না । এবং কথাও আর বলবে না। অবশেষে সে রাজি হতে বাধ্য হলো । কারণ নাঈমকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই ।
ভোরের মিটিমিটি আলো হাসতে শুরু করেছে , সে মুহূর্তে নাঈম নীলিমার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলো,নীলিমা অনেক ধরনের অজুহাত দেখালো, বাড়ির লোকজন কে কি ভাববে , নীলিমাকে কোনো ধরনের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে তাকে নিয়ে রওনা হলো । তারা কোথায় যাচ্ছে কথাটা শুনতে নাঈম তাকে রুড ভাবেই বললো , চুপচাপ বসে থাকো । বললাম একটু কাজ আছে ।
-নাঈম ড্রাইভ করছে । হঠাৎ নীলিমা বলল , কিছু খাবার করে এনেছি , আগে খেয়ে নিয়ে গাড়ি চালাও।
নাঈম ভাবলো,এই মানুষটা এমন কেনো? এত কিছু রান্না কখন করলো!তার ভালো মন্দ দেখা ছাড়া কি আর কোনো কাজ এই বেচারি করতে পারে না । নীলিমার জোরাজুরিতে অবশেষে এইটা তেলের পাম্পে গাড়ি থামিয়ে তারা খাওয়া দাওয়া করলো । নাঈম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো নীলিমা গভীর আগ্রহে তার অপেক্ষাই দাঁড়িয়ে আছে। নাঈম কাছে আসতেই তার অচল দিয়ে নাঈমের হাত মুখ মুছে দিলো ।
নাঈমের নিজেকে আবারো ব্যার্থ মনে হচ্ছে । কেনো সে তার ভালোবাসাটা নীলিমার প্রতি প্রকাশ করতে পারেনা ? কিসের এত সংকোচ ? নীলিমা ছাড়া তার কেই বা আছে।মানুষের ব্যর্থতা হলো , সে নিঃসার্থ ভালোবাসার মূল্য না বুঝে অনাজা পরিবর্তনীয় ভালোবাসার পেছনে ছুটে যায় অনন্ত কাল।কিন্তু, নাঈম সে বাঁধায় নিজেকে বাঁধবে না, সে এই সর্গীয় ভালোবাসার যথাযথ মূল্য দিতেই প্রস্তুত ।
তারা আবার রওনা হলো।এর মাঝে হাজার বার নাঈমকে নীলিমা বলেছে, এত ক্ষণ ধরে গাড়ি চালাচ্ছে,তার কষ্ট হচ্ছে না। একটু থেমে থেমে রেস্ট নিতে,তার ফ্লাক্স ভরা চা ফুরিয়ে গেছে । এখন আবার চা খাওয়ানোর জন্য জোর করতে লাগলো । কারণ সে জানে নাঈম প্রচন্ড পরিমানের চা খোড় । নীলিমার জোড়াজুরতে আবার থামতে হলো চা খাওয়ার জন্য । কিন্তু বিষয় গুলো খারাপ লাগছে না নাঈমের। কারণ তার প্রতি নীলিমার এই প্রবল ভালোবাসা তাকে প্রতিটা সময় এক স্বর্গীয় অনুভুতি উপভোগ করায়।
একটা পর্যায়ে নাঈম দেখলো নীলিমা মাথাটা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । কি নিষ্পাপ চেহারা , পুরো চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ , হাজারো দুঃখ ভরা মুখের ভঙ্গি দেখলেই বুকের মধ্যখানটা মোচড় দিয়ে উঠে নাঈমের। নাঈমের মনে হচ্ছে তার মাথাটা হালকা সরিয়ে তার কাঁধে দিয়ে দিতে , যেনো নীলিমা প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হতে পারে কিন্তু সে অপারক থাকলো , কিন্তু সে এইটাও ভালোভাবেই জানে , যদি এইখানে সে থাকতো তাহলে নীলিমা অবশ্যই এই কাজ টাই করতো।
কাছাকাছি দুইজন মানুষ কিন্তু ভেতরে বিশাল আকারের এক প্রাচীর নির্মিত নাঈমের সামনে , সে এই প্রাচীর ভাঙতে চাই , প্রবল আঘাত হেনে সারাজীবনের জন্য সব বাধা সংকোচ অতিক্রম করতে চাই। তারা মোটামুটি গন্তব্যের নিকট এসে পৌঁছলো। হঠাৎ এক স্নিগ্ধ আবছা আলো এবং সমুদ্রের হালকা কোলাহলে ঘুম ভেংগে গেল নীলিমার !! এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যের মোহ তাকে ক্ষনিকেই বিচলিত করে তুললো !
” গুড ইভনিং স্যার ,গুড ইভনিং ম্যাম।”গাড়ি থেকে নামতেই দু’জন ওয়েটার তাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো । তারা নীলিমার হাত থেকে চায়ের ফ্লাক্স আর খাবারের খালি বাটির ব্যাগটা সসম্মানে হাতে নিল ।
তাদের এইভাবে শুভেচ্ছা জানানোর ভঙ্গিমা নীলিমাকে স্তম্ভিত করে তুললো । সে নাঈমের দিকে ফিরে বললো,”আমরা কোথায় এসেছি ? এইটা তো বড় কোনো হোটেল মনে হচ্ছে ।”
-হ্যাঁ ঠিকই ধরেছো । এখন রুমে চলো , ফ্রেশ হয়ে কথা বলছি ।
বাধ্য শিশুর মত নীলিমা তার জন্য নির্ধারিত ঘরের দিকে রওনা হলো । রুমে প্রবেশ করে সে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো । অপরূপ সুন্দর ঘরের ডেকোরেশন । এইধরনের হোটেলের রুম সে টিভিতেই দেখেছে । কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও এইসব সৌন্দর্য্য তাকে খারাপ লাগাচ্ছে না।
ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে এসে সে বিছানার উপর একটি গিফট বক্স দেখতে পেলো । রঙিন কাগজে মোড়ানো বক্সের উপরে একটি চিরকুটের উপর লেখা , গিফটটা খোলো এবং ভেতরের জিনিসটা যথাযথ ব্যবহার করে বাইরে রিসোর্টের পেছন দিকের খোলা জায়গাটায় আসো । আমি ওয়েট করছি ।
– নীলিমা গিফট বক্সটা খুলে দেখতে পেলো হালকা বেগুনি রঙের একটি সিল্কের শাড়ি । নীলিমা মনে মনে অনেক খুশি হলো কারণ এই রংটা তার অনেক প্রিয় । শাড়িটা পরে মোটামুটি ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সে নির্ধারিত জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
ঘর থেকে বের হতেই সে অপূর্ব এক কল্পিত শব্দ শুনতে পেলো । সমুদ্রের ঢেউয়ের কোলাহল এবং তার সাথে স্নিগ্ধ মিষ্টি হাওয়া তার মনটাকে প্রশান্তির চাদরে মুড়িয়ে নিলো ।
নীলিমা রিসোর্টের ডেকের পথে চলছে আর মনে হচ্ছে গোধূলি ভরা আবছা আলোয় সমুদ্র তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে । রিসোর্টের পাটাতন যেনো সমুদ্রের কোলেই বসে আছে । ডেকের নিচে ঢেউয়ের দুষ্টু মিষ্টি খেলা চলছে তার উপরে এক চমৎকার চিত্র একে বসে আছে এক সুপুরুষ ( নাঈম ) ।
নীলিমা সেখানে পৌঁছে দেখলো চারিদিকে বিভিন্ন ধরনের লাল নীল আলোর সমাহার , জায়গায় জায়গায় কাঠগোলাপ আর গোলাপ ফুল স্থান করে নিয়েছে। তার মাঝে গোল টেবিলে বসে আছে নাঈম।
নীলিমাকে আসতে দেখেই সে এগিয়ে এলো , অচিরেই তার হাতটা ধরে নিয়ে খুব যত্নের সহিত তাকে ডেকের মাঝে নিয়ে এসে দাঁড়ালো।
-এইসব কি হচ্ছে বাবু ? তুমি বললে আমরা একটা কাজে যাচ্ছি কিন্তু আমরা তো কক্সবাজার এসেছি ।
–>কেন ? তুমি খুশি হওনি?
-না সেটা বলি নি ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । এইখানে কেন নিয়ে এলে আমাকে ?
-কথা শেষ না হতেই নাঈম নীলিমার সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পরলো ।
এক গুচ্ছ সাদা গোলাপের মাঝে একটি রিং নিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ,”জন্মদিন আম্মু “।
ফুল গুলো সে তার মায়ের হাতে দিল এবং আংটিটা হাতে পরিয়ে দিল । তখনই ভায়োলিন বাজিয়ে চারজন বাদক প্রতিয়মান হলো । হঠাৎ করেই পুরো পরিবেশটাই মনে হচ্ছে প্রাণ খুলে অভিবাদন জানতে লাগলো নীলিমাকে ।
” অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি তোমাকে । আমার জীবনের সব থেকে স্পেশাল মানুষ শুধু তুমিই। আমার অস্তিত্ব তুমি , আমার বেঁচে থাকার এক মাত্র অস্ত্র তুমি , আমার পথ চলার শক্তি তুমি । অনেক ভালোবাসি তোমাকে , কিন্তু বলতে পারিনা , কারণ বলার মত যোগ্যতা আমি অর্জন করছিলাম না , আজকে আমার সামনে সব কিছুই উন্মুক্ত , আমার মায়ের যোগ্য সন্তান আমি , তোমার গর্ব আমি !! কোনোদিন তোমাকে একা হতে দিব না । ছায়ার মতো পাশে লেপ্টে থাকবো আম্মু ।
নীলিমা পুরোটা হকচকিয়ে ছল ছল চোখে কাপা কাপা কণ্ঠে নাঈমকে বললো, “এইসব কি হচ্ছে বাবু ? মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা সে কি আবার মুখে বলা লাগে নাকি ? পাগল ছেলে আমার । ভালোবাসা দেখানোর মাধ্যমে বুঝানো লাগেনা । আমি তো তোমারই আর তুমিও আমার , এইসব সারপ্রাইজের প্রয়োজন আছে বলো ? “
-আম্মু, তোমার প্রতি ভালোবাসা বুঝানোর ক্ষমতা তো আমার নেই । কিভাবে তোমার ভালোবাসার প্রতিদান দিবো বলো ? কিন্তু এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করতে দোষের কী ?
নিঃসার্থ ভালোবাসা যেখানে আছে , আমার পৃথিবীর জান্নাত যেখানে আছে ,আমার সব থেকে অমূল্য ধন যেখানে আছে, তার জন্য এই সামান্য জিনিসটা করতে পারবো না এতবড়ো অকৃতজ্ঞ আমি না । আমি ভালোবাসা নামক এই পবিত্র জায়গাটার সঠিক দেখাশোনা করবো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ্ !!
নীলিমা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । এর থেকে বড় পাওয়া তার জীবনে আর কিছুই হতে পারেনা । বাবু , তুমি আমার!! তুমি আমার সাথে আছো আমার থেকে সুখি পৃথিবীতে আর কেও নেই । মহান সৃষ্টি কর্তা কতৃক এক শ্রেষ্ট উপহার তুমি।
–> হ্যাঁ আম্মু , তুমি এইটার প্রাপ্য । ধৈর্য্যশীল , নিষ্ঠাবান , চরিত্রসম্পূর্ণ ব্যাক্তিকে আল্লাহ্ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট প্রদান করে থাকে । বাবা আমাদের ছেড়ে তার প্রিয় মানুষটির কাছে চলে গিয়েছিল। একদিকে ঠিকই করেছিল । কারণ আমার মায়ের স্বামী হওয়ার যোগ্যতা তার ছিলনা ।
– এইসব কি বলছ বাবু ?
–>থাক আম্মু । আর লোকানোর দরকার নেই । অনেক বড় হয়েছি । বাবা সম্পর্কে সবটাই আমি জানি । কিছুদিন আগেও বাবা আমার অফিসে এসেছিল। ফিরিয়ে দেয়নি আর ফিরিয়ে দেবোই বা কেন আমার মা তো আমাকে সেই শিক্ষা দেয় নি । সে চলে যাওয়ার পর তুমি ইচ্ছা করলেই পারতে নিজে একটা বিয়ে করে সুখের জীবন সাজাতে , কিন্তু সেইটাও করনি , দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে আগলে ধরে , আধ পেটে থেকে একহাতে আমাকে মানুষ করছো ,পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসাবে তৈরি করছো । তার পুরস্কার তো তুমি প্রাকৃতিক ভাবেই পাবে ।
নীলিমার দু চোখ আনন্দ ভরা অশ্রু সিক্ত হয়ে গেলো । তার আনন্দের সাথে তাল মিলিয়ে পুরো পরিবেশ যেন বিজয়ের হাসি হেসে উঠলো ।
-আমি সত্যিই আজকে সার্থক আব্বু , আমি সত্যিই সার্থক । দোয়া করি পৃথিবীতে প্রতিটা ঘরে তোমার মত সন্তানের জন্ম হোক ।
–>কথাটা একটু ভুল আম্মু , দোয়া করি প্রতিটা ঘরে তোমার মত মহিয়সী মায়ের জন্ম হোক । তুমি আমার মা , আমি পৃথিবীর সব থেকে ধনী লোক ।
পৃথিবীতে যার মা আছে সে, কখনো গরীব নই , এই পৃথিবীতে আমার মায়ের দুটি পা আমার কাছেই আছে । আমার পৃথিবীর জান্নাত আমার কাছে আছে , সেই মানুষটাকে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবো , কারণে অকারণে ভালোবাসবো , মনের মাধুরী মিশিয়ে ভালোবাসো।
নাঈম এইবার সেই ডায়মন্ডের চেইন-লকেট তার মায়ের গলায় পরিয়ে দিলো।নীলিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ।
–>আম্মু ,অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেদিন আমার ফর্মফিলআপের জন্য তোমার একটি চেইন শরীফ কাকুর দোকানে বিক্রি করে দিয়েছিলে , সেইদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , তোমার এই গলায় আমি হীরার চেইন উঠাবো। সব মেয়েদের হাতেই আমি আংটি দেখতাম শুধু আমার মায়ের হাতে দেখিনি । তাই ছোটকালেই পণ করেছিলাম তোমার হাতে আমি নিজে একদিন হীরার আংটি পরিয়ে দিবো ।
নীলিমার বিস্ময়ের সীমা শেষ না হতেই দুজন ওয়েট্যার বড় একটি কেক নিয়ে উপস্থিত হলো । চারিদিক থেকে মানুষের শুভেচ্ছা ধ্বনি ভেসে আসছে , নীলিমা দেখতে পেলো রিসোর্টে আসা সব মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়েছে । কেক কাটা শেষ হলো , চারিদিকে সবাই ফোন , ক্যামেরা নিয়ে মা ছেলের আনন্দ মাখা মুহূর্তের ছবি তুলছে। অনেক সুনিপুণ ভাবে এক পবিত্র উৎসব মুখর সন্ধ্যার পরিসমাপ্তি ঘটলো । নাঈম তার চেপে রাখা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটালো , তার মাকে জড়িয়ে ধরে তার ভালোবাসার চুম্বন বর্ষণ করলো , তার আত্মার পূর্ণতা এবং পরিতৃপ্তি সম্পূর্ণ হলো । !!!!
–>আম্মু ?
-হ্যাঁ বাবু । বলো ?
–>ছোটোবেলায় যখন শুনতাম , পৃথিবীতে সব থেকে সুন্দর জায়গা কোথায় ? তুমি আমাকে বলতে সব থেকে সুন্দর হলো রাতের আবছা আলোয় মাখা সমুদ্র । আমি বলতাম তাহলে চলো না আম্মু , আমরা যাই । তুমি বলতে আমি একা কিভাবে নিয়ে যাব তোমাকে ? তুমি লেখা পড়া করে মানুষের মত মানুষ হও তারপর আমাকে সমুদ্র দেখতে নিয়ে যেও ।
-হ্যাঁ , বাবু মনে আছে । আর তুমি সেইটাই করে দেখিয়েছ , মনে রেখেছ কথা গুলো।
–>হ্যাঁ আম্মু । আরো অনেক কিছুই মনে আছে আমার। যেগুলার বাস্তবায়িত রূপ আমি প্রদান করব ইনশাআল্লাহ। -তাহলে আমার বৌমাকেও দ্রুত নিয়ে এসো । নীলিমা হাসছে ।
নাঈম লজ্জা ভরা মুখে জবাব দিলো , মেয়ে দেখো তোমার পছন্দ মত। এখন ওগুলো কথা থাক । চলো আমরা সমুদ্রে যাই। দুজন মিলে এক সাথে পা ভেজায়।দুটি মানুষ হেঁটে চলছে সাগরের পানে । এক নতুন রকমের ভালোবাসা নিয়ে , যে ভালোবাসা গুলো পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণ থাকে আমাদের অন্তরে , এ ভালোবাসা স্বর্গীয় ভালোবাসা । পৃথিবীর সব থেকে উৎকৃষ্ট, এক অন্তহীন ভালোবাসা । মা সন্তানের ভালোবাসা ।
লিখেছেন: তাসনিয়া আলী
শিক্ষার্থী, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ,
মাগুর সরকারী কলেজ।