সৃজনশীল শিক্ষকই পারেন সৃজনশীল জাতি গড়তে

মুহম্মদ সজীব প্রধান


ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় একজন মহান শিক্ষক সক্রেটিস থেকে প্লেটো, এরিস্টটল এবং আলেকজান্ডারের মতো অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত ছাত্রের নাম যাদের আবিষ্কার ও সৃষ্টিকর্ম পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। আর এজন্যই নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।

সত্যি বলতে, শৈশবে অ আ ক খ শেখা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনে শিক্ষকদের অবদান আমাদের জীবনে অদ্বিতীয়। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো মানুষ হয়ে দেশ ও দশের সেবায় নিজেদেরকে বিলিয়ে দেওয়া। ভালো মানুষ গড়ার মূল দায়িত্ব শিক্ষকগণের উপরই ন্যস্ত। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ, পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সমাজ গঠনে, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান একজন রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ বা সমাজনেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই বলা যায়, একজন আদর্শ শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষের অন্যতম।

বস্তুত, পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয় তবে বাংলাদেশে শিক্ষকদের সম্মানের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং উচ্চ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। কেননা, শিক্ষক যত দক্ষ ও সৃজনশীল হবেন শিক্ষার্থীরাও ততোটাই সৃজনশীল হবে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং কর্মদক্ষতা দেশের জন্য অগ্রগতি বয়ে আনবে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের তথ্য প্রযুক্তি ও নিজ নিজ বিষয়ে প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই তাই শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের মাঝে গভীর জ্ঞান বিতরণ করতে পারেন না।

ফলে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে যা দেশের অগ্রগতিতে বাঁধা সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো যখন গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ব দরকারে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করছে তখন বাংলাদেশে গবেষণার বীজও রোপণ করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে শিক্ষকরাই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত নয় ফলে শিক্ষার্থীরাও গবেষণা থেকে অনেক দূরে রয়েছে।

গবেষণার প্রতি শিক্ষকদের অনীহার কারণও স্পষ্ট, বাংলাদেশের স্কুল, কলেজে গবেষণার মতো পরিবেশ তো নেই এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই গবেষণা করার জন্য নেই পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং আধুনিক ল্যাব। বাংলাদেশে অন্যান্য খাতের চেয়ে শিক্ষাখাতে বাজেট তুলনামূলক কম তন্মেধ্যে গবেষণার জন্যও বরাদ্দ সীমিত। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষক গবেষণা করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করতে পারেন না।

এছাড়া, অসংখ্য প্রতিভাবান শিক্ষক রয়েছেন যারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হয়েও অভাব অনটনে মানবেতর জীবন যাপন করেন। তাই তাঁরা জীবিকার টানে ব্যস্ত থাকেন ফলে গবেষণার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারেন না। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর রাখবেন এমনটাই প্রত্যাশা। বস্তুত শিক্ষা ও গবেষণা হচ্ছে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ তাই গবেষণা ছাড়া শিক্ষা নিতান্তই মূলহীন ও মূল্যহীন। কারণ গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে রাষ্ট্র-উন্নয়নে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

আর এজন্য প্রথমেই শিক্ষকদের কে গবেষণামুখী করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে তাদেরকে গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানসম্মত ল্যাব স্থাপন করতে হবে, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, ভালো গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশে ও স্বীকৃতি পেতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশের নতুন প্রজন্ম যদি শিক্ষকগণের সান্নিধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নিজেদেরকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তা হলেই দেশের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি হবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment