১৬ বছরে লালমাটির ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

চৌধুরী মাসাবি: লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে ময়নামতির কোলঘেষে লালমাটির ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা চট্টগ্রামের মাঝামাঝি কুমিল্লা শহর থেকে ১১ কি.মি. দক্ষিণে সদর দক্ষিণ থানায় অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সবুজ গাছ গাছালি, ছোট বড় টিলা আর উঁচু নিচু লাল মাটির ঢিবি দিয়ে ঘেরা ক্যাম্পাস এ্যারিয়া।

আজ ২৮ মে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৫ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। হাটি হাটি পা পা করে পার করে ১৬ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

১৬ বছরে পদার্পণের এ গল্পটা এতটাও সহজ ছিলোনা। এককালে সমৃদ্ধ জনপদ সমতট রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র লালমাই-ময়নামতি এলাকা। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেবের হাতে শালবন (আনন্দ) বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। শালবন বিহার ছিল এশিয় জ্ঞান অর্জনের অন্যতম বিদ্যাপীঠ। ওই বিহারকে তৎকালীন পণ্ডিতেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় অভিহিত করেন। তখন পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ এ বিহারে জ্ঞান অন্বেষণে আসতেন।

৬৩৮ সালে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং শালবন বিহারে আসেন। তখন বিহারে চার হাজার ভিক্ষু (ছাত্র) দেখতে পান তিনি। হিউয়েন সাং ময়নামতি অঞ্চলে ৩৫টি বিহার (শিক্ষাকেন্দ্র) দেখেছেন বলে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি তৎকালীন সমতটবাসীকে (বর্তমানে কুমিল্লাবাসী) শিক্ষানুরাগী হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশকে কুমিল্লা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে কুমিল্লা জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি ওঠে। সে প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বঞ্চিত রয়ে যায় কুমিল্লা অঞ্চলের জনগণ।

পরবর্তী সময়ে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২০০৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।

একই বছরের ৮ মে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০০৭ সালের ২৮ মে প্রথম ব্যাচে ৭টি বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১৫ জন শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদে ১৯টি বিভাগে ৭ হাজার ৫৫ জন শিক্ষার্থী ও ২৫২ জন শিক্ষক, ৯১ জন কর্মকর্তা ও ১৭৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধায় রয়েছে ৫টি আবাসিক হল।

জাতির পিতার নামানুসারে “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল”, জাতীয় কবির নামে “কাজী নজরুল ইসলাম হল”, কুমিল্লার সন্তান ও ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথের নামে “শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল”, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা জমিদার নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর নামে “নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল”, এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে “শেখ হাসিনা হল” (নির্মাণাধীন)। শিক্ষার্থীদের পরিবহন সুবিধার্তে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মালিকানাধীন ৮টি বাস এবং ১২টি ভাড়ায় চালিত বাস।

২০২০ সালের ২৭শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন এ প্রতিষ্ঠানটিকে দেয় ভিন্নমাত্রা। রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদের সভাপতিত্বে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেন ২ হাজার ৮৮৭ জন শিক্ষার্থী। ১ম ব্যাচ থেকে ৮ম ব্যাচ পর্যন্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা সকল শিক্ষার্থীর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর সম্বলিত সনদ পাওয়ার জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে এ সমাবর্তনে।

অনেক চড়াই উতরাই পার করে এতদূর আসলেও প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার জায়গা থেকে ফারাক থেকেই যায়। অডিটরয়াম, পর্যাপ্ত ক্লাস রুম, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, রিসার্চ সেন্টার, মিডিয়া ল্যাব সহ বিভিন্ন কিছুর অপ্রতুলতা রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে শিক্ষার্থীদের সকল আশা প্রত্যাশা অতি শীগ্রই বাস্তবে রূপদান হতে চলছে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পে।

আয়তনে ৫০ একরের ছোট্ট কুবিকে ২৫০ একরের বড় কুবিতে রুপান্তরের দৃশ্যমান কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ কাজ সম্পাদনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইতোমধ্যে প্রকল্পের আওতাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। গত ২৪ মে ১৯৮.৮৯০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য কুমিল্লা জেলা প্রশাসনকে ৪ শত ৭১ কোটি ১১ লক্ষ ২২ হাজার ৫৫ টাকার একটি চেক হস্তান্তর করা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সকল প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হবে আগামীর ক্যাম্পাসে। জ্ঞান চর্চার বাতিঘর হবে লালমাই পাহাড়ের কোলে দাড়িয়ে থাকা লালমাটির নান্দনিক ক্যাম্পাস।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

Scroll to Top