এইচএসসি বিনা পরীক্ষায় পাশের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা : একটি মূল্যায়ন

এইচএসসি বিনা পরীক্ষায় পাশের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা : একটি মূল্যায়ন

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম


এইচএসসি পরীক্ষার সিদ্ধান্তটি বেশ আলোচিত এখন এবং সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।সিদ্ধান্তটির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সবাই মতামত দিচ্ছে।আমি চেষ্টা করবো সিদ্ধান্তটির সামগ্রিক দিক তুলে ধরার জন্য।যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে সব পক্ষের Win-win অবস্থা বজায় রাখা শুধু কষ্টসাধ্য নয় প্রায় অসম্ভব। আমরা মজা করে কিংবা সমালোচনা (বাস্তবে সমালোচনা আছেও) করতেই পারি,কিন্তু সার্বিক দিক চিন্তা করলে এই সিদ্ধান্তের বাইরে খুব বেশি কিছু কি করার ছিলো?

আমার দৃষ্টিতে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্তটা সঠিকই,যদিও বিকল্প মূল্যায়নে দুই পরীক্ষার গড়ের বাইরে আরো গুনগত পন্থা রয়েছে।যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে না সেই বিকল্প উপায়গুলো বিবেচনায় রেজাল্ট প্রস্তুত করলে হয়তোবা যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে সেটা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।কিন্তু মন্ত্রণালয় মনে হয় না সেদিকে এগুবে!!

এখন বলি কেন যুক্তিযুক্ত মনে করছি সিদ্ধান্তটিকে। আমি জানি লেখার বিপরীতে অনেক যুক্তি অবশ্যই আসবে,তবে সেই যুক্তিগুলি আবেগ বিবর্জিত হবে বলে আশা করি।

সরকার কিন্তু কালক্ষেপন করেছে যথেষ্ট শুধুমাত্র সঠিক সুযোগের অপেক্ষায়,কিন্তু বাস্তবে এটা পায় নি।সামনে এপ্রিলে আরেকটি ব্যাচ পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ। আবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে যে কেন্দ্র-আসন লাগবে তা অপ্রতুল।সাথে সমপরিমান পরীক্ষক,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য লজিস্টিকস ব্যবস্থা করা আসলেই কঠিন।সর্বোপরি,বিপুল শিক্ষার্থী সমাগমে সামাজিক দূরুত্ব নিশ্চিত করাও প্রায় অসম্ভব!

এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন,দেশের সব কার্যক্রম চলে এখানেই শুধু সংক্রমণ ঝুঁকি কেন সরকার দেখে! দেখুন অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান বা সেক্টর খোলা তার প্রকৃতি আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি এক নয়।অন্যান্য সেক্টরে জীবিকার তাগিতে ও প্রায় ব্যক্তিগত ঝুঁকি এবং ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।সেক্ষেত্রে সরকারের দায় সেই অর্থে একক কিংবা বহুলাংশে নয়।কিন্তু শিক্ষাখাতে জিম্মাদারি বা সিদ্ধান্ত অনেকটা সরকারের ইচ্ছে ও সক্ষমতার উপর নির্ভর করে।কাজেই এখানে সরকারের দায় ও দায়িত্ব বেশি।এখানে একটা শিক্ষার্থী যদি করোনা আক্রান্ত হয়,আপনি নিশ্চয়ই তার আশেপাশে আপনার সন্তানকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দিবেন না। তাছাড়া সংক্রমণ হলে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা বঞ্চিতও হতে পারে,এখন কোন অধিকারে বা দায়িত্বে আপনি তাদেরকে বঞ্চিত করবেন?

তাছাড়া,শিক্ষাব্যবস্থার একটা Ecosystem আছে।এই সিস্টেমটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়,একেকটা স্তর অন্যটির সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে। সেই ব্যবস্থার ভারসাম্যের কথাও কিন্তু সরকারকে ভাবতে হয়।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কিন্তু নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য অপেক্ষমান,সেই ব্যবস্থায়ও একটা ধাক্কা লাগছে।দেশে প্রায় শ’খানেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে,নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না হলে যেগুলো ব্যাপক ছাত্রসংকটে পরবে।ইতিমধ্যেই করোনার থাবায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সক্ষমতার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।তাই,এই পরীক্ষা আরো দীর্ঘায়িত হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দারুণভাবে ভেঙ্গে পরবে।

এই সিদ্ধান্তের একটা খারাপ দিক হবে, একটা বড় অংশ প্রায় বিনা মূল্যায়নে ও অযোগ্যতা নিয়েই পরবর্তী ধাপে যাবে, এটা নিশ্চিত। গতবছর প্রায় ৩.৫ লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছিলো যারা এবারো পরীক্ষার্থী,এর কাছাকাছি বোধ হয় এবারও অকৃতকার্য হতো,তাতেও সংখ্যাটা একবার ভেবে দেখুন!আবার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রামে বা মফস্বলের পরিবেশে পড়াশোনা করে,ফলে অপেক্ষাকৃত কম রেজাল্ট থাকে এসএসসি বা জেএসসিতে।তাদের একটা বড় অংশ ভবিষ্যতের কথা ভেবে শহরে ভালো কলেজে পড়াশোনা করে ও ভালো রেজাল্টও করে আর সেই রেজাল্ট পাল্টে দেয় অনেকের জীবন,তাদের জন্য এই সিদ্ধান্তটি একটা ধাক্কাই। যারা পূর্বে ভালো করে নাই তারা ভুগবে,তাদের ভালো করার সুযোগ আছে,এখানে তারা বঞ্চিত হবে।এখানে বলার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু We don’t have any option right now which doesn’t harm everyone.

প্রসঙ্গত,আরেকটা বিষয় আনি যদিও এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে তবুও।বিগত বছরগুলোতে যে পাবলিক পরীক্ষাগুলো হয়েছে সে পরীক্ষাগুলো যে আহামরি উল্টানো(মান) কিছু ছিলো তা কিন্তু নয়।পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ছিলো প্রায় স্বাভাবিক । পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরিতেও ভুলভ্রান্তি ছিলো অহরহ। পরীক্ষার হলে দেখাদেখি, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উত্তর বলে দেওয়া এবং পরীক্ষার আগমুহূর্তে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো কিন্তু দেয়ালের মধ্যে ঘটে আসছিল না,সেগুলো সামাজিক গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে পরিচিত দৃশ্য ছিলো। তাই আকাশ-পাতাল ফাঁরাক হয়েছে তা বলা যাবে কি?

তাছাড়া ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ডামাডোলে বন্ধ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্ধশতক পর আবারো সংকটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। যুদ্ধের পর পরীক্ষা ছাড়াই অটো প্রমোশনে শিক্ষার্থীরা শুরু করেন থেমে যাওয়া শিক্ষা জীবন।

জীবনে দূর্যোগ আসে,সেটা প্রত্যাশিত অবশ্যই নয় কিন্তু এর ফলাফল বয়ে বেরাতে হয় আর এটা মেনে নেয়াটাই ম্যাচুরিটি। শিক্ষার্থীদের যেটা বলবো, যে বিষয়ে আপনার হাত নেই সেখানে মাথা ব্যাথা করে লাভ নেই,যেখানে আপনার হাত আছে(ভর্তি প্রস্তুতি) সেখানেই মনযোগ দিন।ভর্তি পরীক্ষা হবে না বা বাতিল করে রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে এইরকম মনোভাব নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা মোটেও উচিত নয়(যদিও পরবর্তীতে এইরকমটাও হয় তবুও না)।

সিদ্ধান্তটা মন থেকে বিবেচনা করলে আমি ব্যথিত কিন্তু মাথা দিয়ে চিন্তা করলে অবধারিত!তবু মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আরেকটু সুক্ষ্ম বিবেচনা করা যেতেই পারে!

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম
শিক্ষক, লেখক ও গবেষক ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *