বেরোবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক অনিয়মের অভিযোগ
বেরোবি প্রতিনিধি: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অর্ধশতাধিক অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) অধিকার সুরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে উপাচার্যকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে এসব অভিযোগ করে ১৮ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
এসময় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. গাজী মাজহারুল আনোয়ার, ড. তুহিন ওয়াদুদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. কমলেশ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান, নীল দলের সভাপতি ড. নিত্য ঘোষ, অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফিরোজুল ইসলাম, কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলমসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহবায়ক ও বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. মতিউর রহমান স্মাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ যোগদানের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এক নৈরাজ্যকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে।
হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, ডাবল শিফটের শিক্ষা পরিচালনা, বহুতল একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ড্রোন দ্বারা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিধান, দিবা-রাত্রি লাইব্রেরি পরিসেবা, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় পরিসেবা সবই যে ছিল প্রতারণা তা বুঝে উঠতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার।
অধিকন্তু, উপাচার্যের একের পর এক দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা পরিক্রমা স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নজিরবিহীন অনুপস্থিতি, তথাকথিত বুনিয়দি প্রশিক্ষণের নামে মাসের পর মাস সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষ থেকে দূরে রাখা, ব্র্যান্ডিং- এর নামে ড্রেসকোড চালুর অজুহাতে পোশাক বাণিজ্য করা, তথাকথিত পাবলিকেশনের নামে জার্ণাল বাণিজ্য করা, বিগত উপাচার্য়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ধুয়ো তুলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বিশেষ প্রকল্পে নিজের ভাগ্নে প্রকৌশলী মনজুর কাদের- কে পুশ-ইন করে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাবের হোসেন চৌধুরীকে ব্যবহার করে ড. ওয়াজেদ রিসার্স এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের লক্ষ লক্ষ টাকা তছরুপ করা এবং সকল অন্যায়-অনিয়ম আড়াল করতে কতিপয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে আত্মস্তুতিমূলক কলাম লেখনি আপনার শিক্ষকস্বত্বাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি/আপগ্রেডেশন/স্থায়ীকরণ হাতিয়ার বানিয়ে অনেককে গোলামী করতে বাধ্য করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের পদোন্নতি, জরুরী নথি আটকে রাখা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেককে অযৌক্তিক কারণে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান, চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ ইত্যাদি আপনার স্বেচ্ছাচারিতার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে।
উপাচার্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন এখানে পদদলিত, তার একাডেমিক দুর্নীতিতে শিক্ষার্থীবৃন্দ শিক্ষা বঞ্চিত এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও আপনার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতায় বাংলাদেশ সরকারের সর্বস্তরের উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্তভাবে বঞ্চিত।
শেখ হাসিনা হল ও ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষ প্রকল্পের কাজ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও তার পরিচালনায় পরিচালিত কাজের গতিহীনতায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা সুবিধা বঞ্চিত হয়ে চলেছে।
শুধু উপাচার্যের ফেসবুক প্রচারণার লক্ষ্যে সম্মান শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডের মেয়াদ চার বছরের পরিবর্তে এক বছর করে শিক্ষার্থীদেরকে নানামূখী হয়রানির মধ্য দিয়ে সরকারের লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করে চলেছেন।
কর্মস্থলে তার ধারাবাহিক অনুপস্থিতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে এবং বিভিন্ন পরীক্ষা পরিচালনায় হয়রানিসহ নানাবিধ কৃত্রিম সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ, বিভাগ ও দপ্তরসমূহ পরিচালনা দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে। জ্যেষ্ঠকে কনিষ্ঠ আর কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠ বানানোর দায়িত্বজ্ঞানহীন অপতৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যবৃন্দের পারস্পারিক সম্পর্ক নষ্ট হতে চলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কার্যকরী পদক্ষেপ ব্যতিরেকে আপনার অযৌক্তিক কর্মপরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিগণ বিচলিত হয়ে পড়েছে। উপাচার্যের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় সৃষ্ট কর্মচারী আন্দোলনের ন্যায্য দাবি না মেনে দমন-নিপীড়ন করে চলেছেন একাধারে। ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বহীনভাবে তার নজিরবিহীন অপতৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে অননুমোদিত অনিয়মতান্ত্রিক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ তার নানাবিধ আদিখ্যেতায় বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বরূপ হারাতে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস না করে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসের বাহানায় উপাচার্য সরকার তথা জনগণের কোটি কোটি টাকা তছরূপ করে চলেছেন।
এমফিল/পিএইচডি গবেষণায় নজিরবিহীনভাবে অস্বাভাবিক সংখ্যক গবেষকের গবেষণা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অর্ধশতাধিক কোর্স পরিচালনা ও এমফিল/পিএইচডি গবেষণা তদারকির নামে বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক কর্মকাণ্ডে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্নীতি করে চলেছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে যেকোনো অন্যায়, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার প্রত্যয়ে গঠিত ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্বিক স্বার্থ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ সংরক্ষণে ১৮দফা দাবিসমূহ পেশ করেছে। দাবিগুলো হলো-
১. মহামান্য চ্যান্সেলর কর্তৃক প্রদত্ত নিয়োগ শর্ত এবং করোনাকালীন সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আপনাকে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, নিয়োগ বোর্ড, অর্থ কমিটির সভাসহ সকল প্রকার সভা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান করতে হবে। সে লক্ষ্যে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিসের সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
৩. করোনা প্রভাবে সৃষ্ট সেশনজট নিরসন করার জন্য দ্রুত কর্ম পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে এবং সে মোতাবেক ৪. ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে বি-ইউনিটের অভিযুক্ত ভর্তি জালিয়াতির প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে এবং অপরাধী ব্যক্তির শাস্তি দিতে হবে।
৬. শেখ হাসিনা হল, ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্স এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট প্রকল্প ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
৭. যুগোপোযোগী কর্মচারী পদোন্নতি নীতিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. আইন লঙ্ঘন করে হয়রানীমূলকভাবে যেসকল কর্মকর্তা/ কর্মচারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের ৯. বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে তা বাতিল করতে হবে।
১০. পদমর্যাদা খর্ব করে হয়রানী ও উদ্দেশ্যমূলক বদলীকরণ বন্ধ করতে হবে।
১১. ডরমেটরি ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল সংক্রান্ত গত ১৮/১১/২০২০ তারিখের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত পত্র প্রত্যাহার করতে হবে এবং ডরমেটরি আবাসন নীতিমালা অনুসরণ করে বন্টন করতে হবে।
১২. মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ/ নিম্ন আদালত কর্তৃক চূড়ান্তভাবে রায়ের পরেও আাদেশ বাস্তবায়ন না করে যেসকল কর্মচারী/কর্মকর্তাকে বরখাস্ত/হয়রানী করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে।
১৩. ইউজিসি অননুমোদিত অনিয়মতান্ত্রিক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে হবে।
১৪. অস্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে এবং আইন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নিয়োগ বোর্ড গঠন করত: নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে লিখিত পরীক্ষা নিয়োগ বোর্ডের সকল সদস্যের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে।
১৫. অনুষদে উপস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৯ অনুযায়ী যোগ্য শিক্ষককে ডীন ও বিভাগে উপস্থিত যোগ্য শিক্ষককে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
১৬. বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৯ ব্যত্যয় করে যেসকল বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে সেসকল ক্ষেত্রে নিয়োগপত্র সংশোধন করতে হবে, এবং আইন অনুযায়ী উক্ত পদে পুনঃনিয়োগ দিতে হবে।
১৭. সকল বিভাগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৯ অনুযায়ী বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি গঠন করতে হবে এবং যেসকল বিভাগে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে তা সংশোধন করে প্ল্যানিং কমিটি পুনঃগঠন করতে হবে।
১৮. বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হবে। প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত প্রশাসনিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের দৌরাত্ব বন্ধ করতে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট পদ হতে অপসারণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সকল পদোন্নতি/আপগ্রেডেশন/স্থায়ীকরণ যথাসময়ে নিশ্চিত করতে হবে।