স্বদেশপ্রেম রচনা – বাংলা রচনা

স্বদেশপ্রেম রচনা – বাংলা রচনা

প্রবন্ধ রচনা – স্বদেশপ্রেম রচনা – বাংলা রচনা 

ভূমিকা: ‘যখন ঈশ্বর ভক্তি এবং সর্বলোকে প্রীতি এক তখন বলা যাইতে পারে যে ঈশ্বর ভক্তি ভিন্ন দেশপ্রীতি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বর ধর্ম।’
-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

সৃষ্ট জীবের সব প্রাণীই তার নিজ দেশ, নিজ মাতৃভূমি, নিজ বাসস্থানকে ভালোবাসে। পাখি ভালোবাসে তার নীড়কে, অরণ্যের ভয়াল জন্তুও ভালোবাসে তার গহীন বনকে। আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। মানুষও ভালোবাসে তার দেশকে, পরিচিত পরিবেশকে। প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন- ‘মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা আমাদের কাছে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান।’

এই স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, গভীর অনুভূতি ও মমত্ববোধকেই দেশপ্রেম বলে। এ দেশপ্রেম মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। মানুষের মনে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এ দেশপ্রেমের জন্ম। এর মাধ্যমেই সে হয়ে ওঠে বিশ্ব নাগরিক-
‘স্বদেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম
যে নিজের দেশকে ভালোবাসে, সে বিশ্বপ্রেমিক,
মানবপ্রেমিক, মানবতাবাদী।’

স্বদেশপ্রম কী: এক কথায় স্বদেশপ্রেম হচ্ছে নিজ দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, ভাষার প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ অনুভব করা। দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ, নিবিড় ভালোবাসা ও যথার্থ আনুগত্যকেই দেশপ্রেম বলা হয়। যে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে ও বড় হয়ে ওঠে সে পরিবেশের প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি, তার একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভূত হয়। কবি বলেছেন-
‘এই দেশেতে জন্ম যেন
এই দেশেতে মরি।’
স্বদেশ প্রেম মানুষকে ক্ষুদ্র স্বার্থান্ধ থেকে রক্ষা করে তাকে ব্যাপক ও বৃহত্তের মধ্যে কাজ করার সুযোগ দেয়। তাই কবি বলেছেন-
‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়।’

বৈশিষ্ট্য: দেশপ্রেম মানুষের চরিত্রের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। বিশেষ ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ এবং সেখানে বড় হয়ে ওঠার ফলে একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ গড়ে ওঠে। এই আকর্ষণ থেকে স্বদেশপ্রীতির যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তার জন্য মানুষ সবকিছু এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। তাই কবি বলেছেন-
‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।’

নিজের দেশের মান গৌরব রক্ষার জন্য মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়। মাকে মানুষ যেমন ভালোবাসে, তেমনি নিজের দেশকেও ভালোবাসে। প্রগাঢ় এই ভালোবাসায় মানুষ উপলব্ধি করে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’- জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে বেশি মনে করার পেছনে কাজ করে দেশপ্রেম। মা যেমন সন্তানকে লালন-পালন করেন, তেমনি দেশের বুকেও মানুষ লালিত হয়।

দেশপ্রেমিক দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এজন্য ইসলাম ধর্মে দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দেওয়া, জিহাদ করে শহিদ হওয়ার সমতুল্য। যে দেশের মাটিতে মানুষের জন্ম হয়, সে দেশের ইতিহাস তার মনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তখন দেশের জন্য একটা গভীর ভালোবাসা মনের মধ্যে স্থান পায়। বাইরের দিকে এর পরিচয় যত না, মনের সঙ্গে তার সংযোগ অনেক বেশি। দেশের অবস্থা যাই হোক না কেন, ভালো-মন্দ সুন্দর-অসুন্দর বিবেচনা না করে স্বদেশ সবার কাছে প্রিয় বলে বিবেচিত। নিজের কুঁড়েঘরেও যেমন সুখের জায়গা, তেমনি নিজের গরিব দেশও পরম প্রিয় বলে মনে হয়।

স্বদেশপ্রেমের উৎস: মানুষের স্বদেশপ্রীতি জন্ম-জন্মান্তরের। আমরা যে দেশে জন্মগ্রহণ করি, সে দেশের পূর্ব ইতিহাস অজ্ঞাতসারে আমাদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। সে দেশের ঐতিহ্যের প্রতি একটা শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরবের অনুভূতি আমাদের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে থাকে। এটা স্বদেশের জন্য আত্মার নিবিড় চৈতন্যবোধ। এ বোধটুকুর জন্যই জগতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

ইতিহাসের পাতায় স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: দেশপ্রেম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে প্রাচীনকাল থেকে। প্রাচীনকালে পুরান মহাকাব্যে ও ইতিকাহিনিতে আমরা দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে কত মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’ হিসেবে বলা হয়েছে। মাতৃভূমি ও ইসলাম রক্ষার জন্য মুসলমানরা প্রাণ দিয়েছেন অকাতরে। স্বদেশের জন্য আমাদের দেশের মানুষের আত্মত্যাগ অসীম। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, সিরাজউদ্দৌলাসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ তাদের মূল্যবান জীবন দিয়ে স্বদেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন। তাদের এই আত্মত্যাগের কাহিনি পৃথিবীর ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে।

নিদর্শন: দেশপ্রেমের উপায় অনেক রকম। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ যেমন দেশপ্রেমের পরিচায়ক, তেমনি সাহিত্য, শিল্পকলা বা অন্যান্য জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে কাজ করাও দেশপ্রেমের লক্ষণ। তাই প্রত্যেকের কাজ হবে যার যার ক্ষেত্রে দেশের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে দায়িত্ব পালন করা যাতে দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধিত হয়। তাহলে সবাই নিজ নিজ কাজের মাধ্যমে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।

দেশপ্রেম নিজের দেশকে জানতে শেখায় ভালোবাসতে শেখায়। দেশপ্রেমের মাধ্যমেই বিশ্বপ্রেমে পৌঁছানো যায়। ফলে বিশ্ব মানবতার মহান আদর্শের সম্প্রসারণ ঘটে। হৃদয়ে স্বদেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা জ্বালাতে হবে, এই প্রেমকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করে বলতে হবে-
‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’

বাংলাদেশে স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশের জনগণ মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসার মতো দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে। ৫২, ৫৪, ৬৬, ৬৯ সালে রক্ত দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ৩০ লাখ শহিদের বিনিময়ে এ মাটিকে শত্রুমুক্ত করেছে।

দেশপ্রেমের স্বরূপ: জন্মভূমির স্মৃতি জীবনের সঙ্গে এ সূত্রে গাঁথা। কোনো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে, কোনো অখ্যাত পল্লীতে মানুষ জন্ম নেয়। তার বাল্যকাল জন্মভূমিতেই কাটে। তাই পরবর্তী জীবনে শহরে বা অন্য কোনো জায়গায় গমন করেও কেউ নিজ দেশের কথা ভুলতে পারে না। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য স্বপ্নবিলাসী ছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে, দেশের মাটি, দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃতি কত প্রিয়। স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও অন্যায়: প্রকৃতপক্ষে স্বদেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সে জাতির স্বদেশপ্রেম তত প্রবল। স্বদেশপ্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি উপেক্ষা করে বৃহত্তম স্বার্থের দিকে মন যখন পরিচালিত হয়; যখন আত্মকল্যাণ অপেক্ষা বৃহত্তম কল্যাণবোধ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন জ্বলে ওঠে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা।

অধ্যবসায় রচনা – বাংলা রচনা

স্বদেশপ্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাঁধা অনেক, অত্যাচার সীমাহীন। কিন্তু পথের ঝড়ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ইতিহাসের পানে তাকালে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত মেলে। পরদেশি কিংবা স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র নিবৃত্ত করতে পারে না। বাংলাদেশের ইতিহাস স্বদেশপ্রেমের গর্বে গর্বিত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সর্বশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান আমাদের স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়।

দেশপ্রেমে স্বাধীনতা: ১৯৭১ সালে আমরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেমনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তেমনি পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ তাদের নিজের দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। দেশকে শত্রুমুক্ত করে আমরা যেমনিভাবে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তেমনিভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে এর অনেক স্মরণীয় ও স্মৃতিবিজড়িত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

দেশপ্রেমের মূল্য: দেশপ্রেমের মূল্য তুলনাহীন। ভালোবাসার ওপরে জাতির উন্নতি, অগ্রগতি নির্ভর করে। দেশের জন্য মরা-বাঁচার শপথ নিয়ে জাতীয় গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের কর্তব্য। মানুষকে তৈরি করে দেশবাসীকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসতে। স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয় দেশপ্রেমিক নাগরিক।

দেশপ্রেমের উপায়: দেশপ্রেম অনেক রকম। স্বাধীনতা রক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও অন্যান্য জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে কাজ করে দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায়।

দেশপ্রেমিকের আদর্শ: বহু দেশপ্রেমিক যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন এবং তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও মহৎ প্রাণের পরিচয় দিয়েছেন, যা আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে। তাদের আদর্শ ছিল দেশের তথা জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঙ্গল সাধন করা। তাদের শৌর্য, বীর্য ও চারিত্রিক দৃঢ়তা আবহমানকাল জাতীয় প্রেরণা জোগায়।

বাংলা কাব্যে দেশপ্রেম: সতেরো শতকের কবি আব্দুল হাকিম তার নূরনামা কাব্যে বঙ্গবাণী কবিতায় দেশের প্রতি গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি যাদের স্বদেশের প্রতি অনীহা তাদের ধিক্কার দিয়েছেন।

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।’

কবি কায়কোবাদ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত বাংলাদেশের মানুষকে একান্ত আপন ভেবে বলেছেন;
‘হৃদয় আমার বাংলার লাগি
যে দেশেই থাকি সদা থাকি জাগি,
স্বর্গ হতেও শ্রেষ্ঠ সে আমার
বাংলা আমার অমিয় ধারা।’

কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে বলেছেন-
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’

তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বদেশের ভালোবাসার শির উঁচু করে ‘পূর্বাভাস’ কাব্যগ্রন্থে হুংকার দিয়ে বলেছেন-
‘হয় ধান নয় প্রাণ এ শব্দে
সারাদেশ দিশেহারা
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা।’

স্বদেশ ও বিশ্বপ্রেমের সম্পর্ক: কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত সারা পৃথিবী বিচরণ করে মাতৃভূমিকে স্মরণ করে লিখেছেন-
‘বহুদেশ দেখিয়াছি, বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।’

রবীন্দ্রনাথ উগ্রজাতীয়বাদকে ধিক্কার দিয়ে নিজের জন্মভূমিকে বিশ্বের মধ্যে সমর্পণ করে বলেছেন-
‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা।’

দেশজননী বিশ্বজননী এক ও অভিন্ন। কারণ দেশজননীর বক্ষের ওপর বিশ্বজননীর আঁচল পাতা।

দেশপ্রেমের অভাব: দেশপ্রেমের অভাব মানুষকে অমানুষ করে তোলে। প্রচুর ধন-সম্পদ, অসীম সামাজিক মর্যাদা, যথেষ্ট বিদ্যার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির অন্তরে যদি স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকে তাহলে তার ধন সম্পদ, বিদ্যা বুদ্ধির কোনো মূল্যই থাকে না। দেশকে যে ভালোবাসে না তার দ্বারা কোনোদিন দেশের কল্যাণ সাধিত হয় না। কবি তাই দেশপ্রেমহীন ব্যক্তির প্রতি ধিক্কার দিয়ে বলেন-
‘যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত,
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিত
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্ত্বার
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।’

দেশপ্রেম মানুষকে একদিকে যেমন মহান করে অন্যদিকে তা বিশ্বমানবতা তথা বিশ্ব প্রেমের উৎসও বটে। একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি নিজের শান্তির ও কল্যাণের কথা চিন্তা করে। তাই সে বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতার পথে বিঘ্নস্বরূপ সব কাজই ঘৃণা করে।

জগতের সব দেশপ্রেমিক ব্যক্তির মিলিত চেষ্টায় বর্তমান যুগের বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্টকারী যত অপশক্তি আছে তা প্রতিহত করা সম্ভব। অন্ধ স্বদেশপ্রেমের পরিণতি: স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির গৌরবের বস্তু। কিন্তু অন্ধ স্বদেশপ্রেম ধারণ করে ভয়ংকর রূপ। জাতিতে জাতিতে সংঘাত ও সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে অন্ধ স্বদেশপ্রেম। আমরা স্বদেশের জয়গান গাইতে গিয়ে যদি অপরের স্বদেশপ্রেমকে আহত করি, তবে সেই স্বদেশপ্রেম বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে ডেকে আনে ভয়াবহ রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। চলমান বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আগ্রাসী মনোভাব অন্ধ স্বদেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। অন্ধ স্বদেশ প্রেমাসক্ত নীতি বিশ্বকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, পারে মানবতার বিপর্যয় ঘটাতে।

দেশপ্রেম ও রাজনীতি: বস্তুত রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদা জাগ্রত প্রহরী। পরাধীন বাংলাদেশের দিকে দিকে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠেছিল, তাদের সবারই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার বন্ধন থেকে দেশজননীর শৃঙ্খল মোচন। তাদের অবদানেই আজ দেশ স্বাধীন। আজও দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিদ্যমান। রাজনীতির রক্তামঞ্চে এখনো কত নতুন দলের আবির্ভাব ও নিষ্ক্রমণ। কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মহত্তর, বৃহত্তর কল্যাণবোধ থেকে ভ্রষ্ট। ব্যক্তি এবং দলীয় স্বার্থ চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে প্রবল। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে মানুষের প্রয়োজনে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার সাধনা, দেশপ্রেমের অঙ্গীকার ও স্বার্থকতা তা এখন প্রায়ই অনুপস্থিত। রাজনীতি সর্বস্ব দেশপ্রেম প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ও সর্বনাশের পথকেই করে প্রশস্ত।

স্বাধীন দেশে দেশপ্রেমিকের অবদান: স্বদেশপ্রেম জাতির বিশিষ্টতার মূল সূত্র। দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে থাকলেও দেশ যে এক ও অখণ্ড এবং তার সব অঞ্চলের লোকের যে এটি স্বদেশ, এ বোধ থেকে জন্ম নেয় স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ। পরাধীনতার গ্লানিই তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার দীক্ষা দেয়। মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সূর্যসেন, প্রফুল্ল চাকী, জে এম সেনগুপ্ত, সুভাষ চন্দ্র, চিত্ত রঞ্জন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামের অক্লান্ত যোদ্ধা। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ভাষা আন্দোলনের শহিদ সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক স্বদেশপ্রেমের অমর দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক দেশ, এক প্রাণ ও একতার মহিমাময় চিত্র আমরা দেখছি। স্বদেশপ্রেমের লক্ষ্যে কোটি প্রাণের এমন উজ্জ্বল ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বিরল।

উপসংহার: বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমি। এ দেশকে ভালোবেসে আমাদের সবার দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া দরকার। দেশের কল্যাণের জন্য যদি আমরা ছাত্রসমাজ সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে পারি এবং দেশের কাজে লাগাতে পারি, তবেই দেশপ্রেমের সার্থক পরিচয় দেওয়া যাবে। এই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা উচ্চারণ করি-

‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’

ব্যক্তিস্বার্থের উপরে স্থান দিতে হবে স্বদেশপ্রেমকে। জীবনের মূলে জাগিয়ে রাখতে হবে দেশপ্রেমের চেতনা। তাহলেই স্বাধীন জাতির মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে।

লেখক:
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *