বাংলাদেশের সফলতম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিনে সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা


আগামী ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২০ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন। তাঁর এই জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি ৭৪তম বৎসরে পা রাখতে যাচ্ছেন। ১৯ বার হত্যার মুখোমুখি থেকে প্রাণ বেঁচে গিয়েছেন। তাঁর এই ৭৪তম জন্মদিনে আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং কিছু কথা।

শিক্ষা ও ছাত্র রাজনীতি
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতির পিতা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তাঁর মাতার নাম বেগম ফজিলাতুন্নেছা।

১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি। তাঁর বাল্যশিক্ষার শুরু টুঙ্গিপাড়াতেই। ১৯৫৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে মোগলটুলির রজনীবোস লেনের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে ওঠেন। ১৯৫৬ সালে তিনি টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের ১লা অক্টোবর ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িতে থাকা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।

বাল্যকাল থেকেই রাজনীতি সচেতন শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ৬ বছর অবস্থান করেন। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ড থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাদেশে রাজনীতির গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অসাম্প্রদায়িক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের গণমানুষের ভবিষ্যত উন্নয়নের কথা চিন্তা করে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ই মে দেশে ফিরে আসেন।

কারাবাস
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনা শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯বার সশস্ত্র হামলা করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন কারাগারে রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দুইবার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২রা মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

১৯৮৬ সালের ১৫ই অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস কারাগারে রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আবারও গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ২০০৭ সালের ১৬ই জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ই জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন।

মৃত্যুর মুখোমুখি
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে দুইবার গুলি করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুইটি বোমা পুতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হয়। রোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২জন নেতাকর্মী নিহত হয় এবং পাঁচ’শর বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।

গ্রন্থের রচয়িতা
শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শেখ মুজিব আমার পিতা (২০১৫), ওরা টোকাই কেন (১৯৮৯), বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম (১৯৯৩), বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-১৯৭৫, দারিদ্র্য দূরীকরণ : কিছু চিন্তাভাবনা (১৯৯৫), আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি (১৯৯৮), সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র (১৯৯৪), বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা (২০০২), সাদা কালো (২০০৭), সবুজ মাঠ পেরিয়ে (২০১০), বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন (১৯৯৯), সহে না মানবতার অবমাননা (২০০৩), ঞযব ছঁবংঃ ভড়ৎ ঠরংরড়হ-২০২১, ), The Quest for Vision-2021, Democracy in Distress Demeaned Humanity (2003), Living in Tears (2004), Democracy Poverty Elimination and Peace (2005), Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman (Edited, 2018).

পারিবারিক জীবন
স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া। ড. মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার ফতেহাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ১৭ই নভেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। ড. ওয়াজেদ মিয়া একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ১৯৬১ এবং ১৯৬২ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এস-সি. সম্মান এবং এম.এস-সি. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০৯ সালের ১০ই মে পরলোক গমন করেন। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় একজন তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তাঁর একমাত্র কন্যা সায়মা হোসেন ওয়াজেদ একজন মনোবিজ্ঞানী এবং তিনি অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে কাজ করছেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন বলে বাংলাদেশ বেঁচে আছে। আমরা তাঁর ৭৪তম শুভ জন্মদিনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি তিনি দীর্ঘজীবী হউন। শান্তিময় হোক আগামী দিনগুলো। বেঁচে থাকুন বাঙালির প্রতিটি হৃদয়ে।

তথ্যসূত্র: প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ওয়েবসাইট (https://www.pmo.gov.bd)

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম: আবদ্ধ জীবনে ভ্রমণের স্বাদ

সাজু সরদার


বাংলাদেশ! বর্তমান বিশ্বে একটি বিস্ময়কর নাম। এ বিস্ময় বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড কিংবা স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে নয় বরং বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা নিয়ে, বাংলাদশের অপার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা নিয়ে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময় আর আমাদের অহংকার। এ অহংকার নেতিবাচক বা অমূলক নয়। এ অহংকার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জনের মনোবল।

আমাদের এ অহংকার তাদের জন্য শিক্ষা যারা এদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেছিলো, যারা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিলো। এ অহংকার থেকে তারা শিক্ষা পায় যারা একদিন “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ধারণাকে কটাক্ষ করেছিলো। বর্তমান সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাকে বাস্তবে রুপদানের মাধ্যমে সকল কটাক্ষের জবাব দিয়েছে। আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকল শ্রেণীর মানুষের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ২০২০ সালের জুলাই মাসের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৬৪ মিলিয়নের বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং তারমধ্যে ১০৬ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ও পোস্ট-ই সেন্টার থেকে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক সেবা পাচ্ছে, স্কুল-কলেজে আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধির ফলে দেশে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা বাণিজ্যরও প্রসার ঘটেছে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নতুন গতি সঞ্চর করেছে। যে গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, এক অদৃশ্য শত্রু সেই গতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেই শত্রুর নাম করোনা ভাইরাস। যার শক্তির কাছে পুরো বিশ্ব আজ দিশেহারা। করোনা ভাইরাসের কারণে মানবজীবন থেকে শুরু করে শিল্প, সেবাসহ সকল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হলো পর্যটন খাত বা পর্যটন শিল্প। করোনা পরিস্থিতির কারণে সবার আগে পর্যটন খাতকে লকডাউন বা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবার সবার শেষে উন্মুক্ত করা হয়েছে বা হবে।

পর্যটন শিল্পকে ছাতার সাথে তুলনা করা হয় (Umbrella Concept)। একটি ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে যেমন আমরা বৃষ্টি কিংবা রোদ থেকে নিজেদের বাঁচায় তেমনি পর্যটন নামক ছাতাকে আশ্রয় করেই হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, পরিবহনের মতো বিভিন্ন সহযোগী খাত বেঁচে থাকে। কারণ মানুষ ভ্রমণ বা পর্যটনে বের হলেই হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, পরিবহন ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। করোনার পরিস্থিতির কারণে পর্যটনখাতের পাশাপাশি উল্লেখ্য সকল অংশীদারি বা সহযোগী খাত সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব খাতের সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছে।

আপাতদৃষ্টিতে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো মনে হলেও পর্যটন খাতে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই এখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়ার বদলে ঘরে থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ঘরে বসেই মানুষ এখন স্বপ্ন দেখছে পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবে, কোথায় থাকবে কিংবা কোন রেস্তোরাঁয় বসে একসাথে সকালের নাস্তা কিংবা দুপুরের এবং রাতের খাবার খাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি, বিভিন্ন অভিব্যক্তি এবং ছবি প্রমান করে করোনার এই পরিস্থিতিতে তারা ভ্রমনকে কতটা অনুভব করে এবং এই আবদ্ধ জীবনে কতটা অস্বস্তিতে আছে। তবে ভার্চুয়াল ট্যুরিজম এই আবদ্ধ জীবনের সমাধান দিয়ে কিছুটা হলেও ভ্রমনের স্বাদ বা স্বস্তি এনে দিতে পারে।

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম একটি ইলেকট্রনিক বা অনলাইন ভিত্তিক পর্যটন কৌশল যার মাধ্যমে পর্যটকরা অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসে ভিডিও বা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করা দর্শনীয় স্থানগুলির সৌন্দর্য ভার্চুয়ালি উপভোগ করতে পারে, ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য অর্জন করতে পারে এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, ভ্রমণ সংস্থার (Travel Agency and Tour Operator) সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং ভার্চুয়ালি অনলাইন ভিত্তিক পর্যটন সম্পর্কিত সেবা গ্রহণ করতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই পর্যটকদের জন্য এমন ভার্চুয়াল ট্যুরের ব্যবস্থা আছে যার মাধ্যমে পর্যটকরা ঘরে বসেই কোন দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে কিংবা প্রত্যক্ষ ভ্রমনের পূর্বেই পর্যটকরা ভ্রমণ স্থান এবং থাকার স্থান (হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট) ঘুরে দেখতে পারে।

করোনাকালে ভ্রমনপ্রিয় মানুষেকে চীন মহা প্রাচীর, পেরু মাচুপিচু ও জর্ডান পেত্রার সৌন্দর্য ভার্চুয়ালি উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হলেও বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশে ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের সকল উপাদান যেমন- ডিজিটাল ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ, ভ্রমণ এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বা উন্মাদনা বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের তেমন কোন সুবিধা দেশে নেই বললেই চলে। ২০১৭ সালে তরুণ দম্পতি সফটওয়্যার প্রকৌশলী নাসির খান ও মুন রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঙালী জাতিসত্তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তির ঠিকানা, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিকে ভার্চুয়াল ট্যুরের (https://tour.bangabandhumuseum.org.bd/) আওতায় নিয়ে আসেন।

সরকারি পর্যায়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরকে প্রযুক্তি বান্ধব করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সহযোগিতায় ভার্চুয়াল ট্যুরের (https://vt.bnm.org.bd/) সুবিধা চালু করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের ভার্চুয়াল ট্যুরের সুবিধা এখনো বিদ্যমান। যাদুঘর দুটির ভার্চুয়াল ট্যুর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে যে কেঊ যাদুঘরের যে কোনও গ্যালারী বা স্থান দেখতে পারবে। বাংলাদেশের কিছু তারকা মানের হোটেলেও ভার্চুয়াল ট্যুরের সুবিধা চালু আছে। যার মাধ্যমে অতিথিরা হোটেলের সেবা গ্রহনের পূর্বেই উক্ত হোটেলের সুযোগ সুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগত হতে পারে। ভার্চুয়াল ট্যুরকে প্রচার-প্রসারের কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে কোন দর্শনীয় স্থান, হোটেল, মোটেল কিংবা রিসোর্টের সৌন্দর্য ও সুযোগ সুবিধা উপস্থাপন বা প্রচার করে পর্যটক কিংবা অতিথিদের আকৃষ্ট করা যায়। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবার প্রতি পর্যটকদের বিশ্বাস জন্মে এবং তারা ভ্রমণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধি বা প্রসারে ভূমিকা রাখে।

ভার্চুয়াল ট্যুরিজম সুবিধায় দর্শনীয় স্থানের উচ্চ রেজ্যুলেশনের ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ করা হয় যা দেখার জন্য পর্যটকদের উচ্চগতির মানসম্মত ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্ট ডিভাইসের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে স্মার্ট ডিভাইসের স্বল্পতা বা সমস্যা না থাকলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আছে। যে দেশে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীদের গাছে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয় (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা) সে দেশে এমন বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। তবে মানসম্মত ইন্টারনেট সমস্যার সমাধান করে ভার্চুয়াল ট্যুরিজম সুবিধা চালুর মাধ্যমে পর্যটন খাতের নতুন দ্বার উন্মোচন করা যায়। এর ফলে পর্যটকরা যেমন আবদ্ধ জীবনে বা স্বাভাবিক সময়ে (New Normal) ভ্রমণের স্বাদ পাবে, তেমনি ভ্রমণের পূর্বেই কোন দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অবগত হয়ে উক্ত স্থান ভ্রমণ করতে পারবে।

যার মাধ্যমে পর্যটক ও পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্থাপিত হবে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক এবং পর্যটন শিল্প হবে আরো সমৃদ্ধ। পর্যটন শিল্পের সমৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যয়ে মুজিব বর্ষেই ভার্চুয়াল ট্যুরিজমের দ্বার উন্মচনের মাধ্যমে “মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, নতুন করে পর্যটনের খুলবো দ্বার” এবং “ডিজিটাল বাংলাদেশ” স্লোগান দুটি সার্থক ও সফল হয়ে উঠুক।

সাজু সরদার
শিক্ষক
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশে বেকারত্বের হার এবং বাস্তব পরিস্থিতি

ফিরোজ কবির


আয়তনে ছোট কিন্তু জনসংখ্যায় টইটম্বুর বাংলাদেশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এই উন্নয়নশীল দেশে প্রকট আকারে প্রধান সমস্যা হতে চলছে বেকারত্ব।

“লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে”- প্রবাদটির বাস্তবতা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দিন দিন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়ছে না চাকরির বাজার। শৈশব থেকে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হলেও পূরণ হচ্ছে না সে স্বপ্ন। অনেক কষ্ট, সাধনা আর অনেক টাকা খরচের পর উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বেকার হয়ে বসে থাকায় সে স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। কাজ না পেয়ে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিক্ষিত বেকার শ্রেণির সংখ্যা। এই মুহূর্তে একটা ভাল চাকরি পাওয়াই হল স্বপ্ন-প্রত্যাশা!

বেকার এই শব্দটার মধ্যে কত যে কষ্ট লুকিয়ে থাকে। বেকার ছাড়া কেউ বোঝে না। আমাদের দেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই ধারদেনা করে পড়াশুনা করে। কেউ সম্পদ বন্ধক বা বিক্রি করে পড়াশুনা শেষ করে। এরপর যদি চাকরি না পেয়ে বেকার জীবন কাটায় সেটা কতটা কষ্টকর ভুক্তভোগীই জানেন।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরি প্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাঁদের চাহিদামত কাজ পাচ্ছেন না৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ২০১০ সালে বেকার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ, ২০১২ সালে ২৪ লাখ, ২০১৬ সালের দিকে ২৬ লাখ। বৃদ্ধির এই ধারার তথ্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ২০২০ সালে বেকার সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি।

শিক্ষিতদের বেকার হওয়ার পিছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। সব থেকে বড় কারণ চাকরি নিরাপত্তা ও অন্যসব চাকরি থেকে সুবিধা বেশি বলে সরকারি চাকরির পিছনে ছোটা। সরকারি চাকরি যাকে আমরা সোনার হরিণ বলি।

বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরণ এক নয়। সেখানে সরকারিভাবে বেকারদের ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও সেসব দেশের বেকাররা এ ভাতা নেয়াকে অসম্মানজনক মনে করে। আবার ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের জনশক্তি কম এবং কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। তারা অন্যদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করে। আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকলেও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ। বলা যায়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে।

করোনা দেশে বাড়তে থাকা এই বেকার সমস্যাকে বাড়িয়ে একদম ঘাড়ের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। এখন থেকেই এই সমস্যা নিয়ে আলোকপাত না করলে করোনা পরবর্তী সময়ে অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। কোনো দেশের পক্ষেই বেকার সমস্যা একদম নিরসন করা সম্ভব নয়, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

লেখকঃ জুনিয়র অফিসার,
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড,
উত্তরা ব্রাঞ্চ, ঢাকা।

বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠান খুলেই যাচ্ছে, চাটার দল কেবল ফায়দা লুটতেই ব্যস্ত

ড. কামরুল হাসান মামুন


বঙ্গবন্ধুর নামে খালি নানা প্রতিষ্ঠান খুলেই যাচ্ছে। কিন্তু কোন একটি প্রতিষ্ঠানও আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেনি যেটি বঙ্গবন্ধুর উচ্চতার সাথে যায়। নামক ওয়াস্তে করে চাটার দল কেবল ফায়দা লুটতেই ব্যস্ত।

দেখুন বঙ্গবন্ধুর নামে পাঠাগারের কি অবস্থা। একই কথা খাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। একেতো বিশ্ববিদ্যালয় নামক কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ চুরি করার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। সেখানে স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নামে বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বারের মত কম্পিউটার চুরি হয়েছে।

আজকে আবার দেখলাম সৈয়দপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় সেটির সাথে আবার আন্তর্জাতিক করেছে। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝেইতো আন্তর্জাতিকতা অন্তর্নিহিত। এখানে আবার আলাদা করে “আন্তর্জাতিক” বলতে হবে কেন? কারা এইসব নাম রাখে?

যারা বিশ্ববিদ্যালয় নামের সাথে “আন্তর্জাতিক” শব্দটি যুক্ত করেছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় মানে কি সেই সম্মন্ধে ন্যূনতম ধারণাই নেই। কিন্তু ফায়দা লুটার ধারণা শতভাগ আছে। আমি নিশ্চিত এটি আরেকটি নামকাওয়াস্তে প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে।

আল্লার ওয়াস্তে এইসব বাদ দিন। পারলে বঙ্গবন্ধুর নামে এমন একটি প্রতিষ্ঠান করুন যেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি কেবল বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করা তাহলে বলার কিছু নাই।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি: ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও আমরা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


বুধবার রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা সরকারি বাসভবনে ঢুকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলীকে কুপিয়ে জখম করে।

কয়েক মাস আগেও গাজীপুরে একজন সৎ ইঞ্জিনিয়ারকে অফিসে ঢুকে জখম করেছে, তারও কিছুদিন আগে একজন কলেজের অধ্যক্ষকে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে আর ডাক্তারদের কথায় কথায় তাদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে।

এ ধরনের খবরগুলো পড়া সাধারন মানুষ হিসেবে আমার জন্য কাঙ্খিত নয়। আজকে সকালে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তাঁর বাবাকে কুপিয়ে জখম খবরটি পড়েও মনটি ভীষন খারাপ হয়ে গেল। আমার কয়েকটি বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলাম কারনটি ইউএনও ওয়াহিদা খানম স্থানীয়ভাবে দুনীর্তির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।

বিকালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক জাহেদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ইউএনওর মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। মাথার খুলির হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। এটি মস্তিষ্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে প্রচণ্ডভাবে। ভেতরে রক্ত রক্ষণ হয়েছে। তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল না।’

এই কথাগুলো শুনতে টিভিতে ভাল লাগছিল না। ভাবছিলাম আমরা কতটা অসভ্য হলে এই কাজটি করতে পারি।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাংলাদেশে একটি পরিচিত কথা ৷ বলা হয়ে থাকে, এই সংস্কৃতির কারণেই এখানে অপরাধীরা বেপরোয়া৷ তারা আইনকে গুরুত্ব দেয় না, অপরাধ করতে ভয় পায় না৷ তারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়৷ এমন প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এতদূর নিয়ে এসেছে। এসব দুর্বৃত্তদের লাগাম টেনে ধরতে হবে, না হয় আমরা কেউ শান্তিতে থাকতে পারবেন না।

দেশটা একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে নিরাপত্তাও পাওয়া যাবে না। বিচারও পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ প্রয়োজন।

আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তনের দরকার ছিল, তা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদার যে একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার আছে, মননের ব্যাপার আছে—সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার, পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের যে সমীকরণ আছে সেটা বদলাতে হবে—এই বিষয়গুলোকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে ।

এ ধরনের ঘটনার সুরাহা হতে পারে যখন যারা ওই ঘটনার সুরাহা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকে। আমরা কেবল সরব হতে পারি এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে বা প্রতিরোধে। আমরা সরব হতে পারলেও আমাদের এখতিয়ার তো সীমাবদ্ধ।

আমরা তো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারি না, এ ধরনের ঘটনায় অপরাধীদের বিচারের যে বাস্তব প্রক্রিয়া তার মধ্যে যেতে পারি না। সেগুলো যারা করবে, আমরা যাদের কাছে বিচার চাইলাম তারা বিচার করল না; আমরা তখন কী করতে পারি! তাই এগুলো যাদের দায়িত্ব তাদেরই আন্তরিকভাবে এ ধরনের অপরাধের বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

এ ধরনের হত্যা কান্ডের বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা কতখানি! হয় তাদের সক্ষমতা নেই, না হয় তারা আন্তরিক নয়। দুটিই আমাদের জন্য বিপজ্জনক।

এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তারা যাতে আন্তরিক হয় সেই চেষ্টাও আমাদের করতে হবে। এর জন্য আমাদের বারবারই কথা বলতে হবে। গণমাধ্যমও সেখানে ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের তো একটা দায়দায়িত্ব আছেই। আমাদের জায়গা থেকে আমাদের সেটা করতে হবে। তবে রাষ্ট্র কেবলমাত্র নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

আশা করি, সরকার একজন সৎ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবি হিসেবে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক, ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ও গবেষণায় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপ প্রাপ্ত।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক দূরদর্শী রাজনীতিক

প্রভাষ কুমার কর্মকার


পৃথিবীতে কোনো কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে মানুষের নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা নেই, সীমারেখা নিবদ্ধ থাকতে পারে শুধু মানুষের চিন্তন রেখায়ই। আমরা যদি কোনো কিছু সৃজন কিংবা চিন্তনের আগেই সংকীর্ণতার কারণে তার বাউন্ডারি বা সীমারেখা নির্ধারণ করে ফেলি, তবে ওই পরিকল্পনা কখনোই দীর্ঘ পথপরিক্রম করে সফল পরিসমাপ্তিতে পৌঁছাতে পারে না। অর্থাৎ অনেক অসাধ্যই সাধন করা সম্ভব হয়, যদি দৃঢ় মনোবল আর সঠিক সময়োপযোগী পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো যায়।

আমার অনুসন্ধিত্সু মনে এই অনুধাবন রেখাপাত করল ব্রেন ট্রেসির ইংরেজি উক্তি ‘There are no limits to what you can accomplish, except the limits you place on your own thinking’ অনুধাবন করতে গিয়ে। বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। প্রাণপ্রিয় এই মাতৃভূমি আমার অহংকার।

বাংলাদেশ নামটি মনে এলেই কিংবা চিন্তা করলেই যেন আমাদের মনে অসম্ভব ভাবাবেগ তৈরি করে, আমরা বিমোহিত হই। আমাদের জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’ আমাদের মনকে আন্দোলিত করে।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ডাক, অতঃপর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম প্রাণপ্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এখন প্রশ্ন এই যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃজনে কোন চিন্তাশক্তি কাজ করল? কে তিনি, যিনি এই অনুপম চিন্তাশক্তির ধারক? নাকি আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো জাদুকরের বাঁশির ফুঁ আমাদের এই স্বাধীনতা উপহার দিল।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা রহস্য যাই বলি না কেন, তার ইতিহাস দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের কাছে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকাটাও অস্বাভাবিক নয় এই কারণে যে, জন্মের প্রায় সাড়ে তিন বছর পরই এ দেশের কপালে ঘোর অমানিশার কালো টিপ যেমন পরতে হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমীদের দ্বারা, তেমনিভাবে মিথ্যার অপলাপে ক্ষণিকের জন্য হলেও সত্যকে উপেক্ষিত হতে হয়েছিল।

আর তাইতো আমাদের স্বাধীনতার বীজ কখন, কিভাবে বপিত হয়েছিল সে বিষয়ে কারো কারো কিছুটা অস্পষ্টতা থাকতেও পারে, তবে কখনো কখনো কারো কারো জ্ঞানপাপী মনোভাব পোষণ অবাক করে! প্রকৃতপক্ষে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, শোষিত ও অধিকারবঞ্চিত বাঙালি জাতির জন্য ভাবনা নামক আনুভূতিক সত্তা দৈববাণীতে আসে না।

এর জন্য শয়নে, স্বপনে-জাগরণে ও মননে দেশমাতৃকার জন্য চিন্তাকর্ষক হওয়ার প্রয়োজন হয় এবং প্রয়োজন হয় পরোপকারী, আত্মদানের মতো চেতনার। আর এই পরোপকারী, আত্মদানার্থক বীজের বপন কিংবা অঙ্কুুরোদ্গম শুরু হতে হয় বাল্যকাল থেকেই, পরিবার থেকেই।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তত্কালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। পিতা শেখ লুত্ফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের আদরের সন্তান বঙ্গবন্ধুর ডাকনাম ‘খোকা’। সেদিনের সেই ছোট্ট খোকার পারিবারিক ঐতিহ্য ও পিতা-মাতার মানবতাবাদী দর্শন তাঁর মানবহিতৈষী ভাবদর্শনকে আরো পরিণত করতে প্রেরণা জুগিয়েছে।

তিনি পরোপকারী ও আত্মদানার্থক চিন্তনশক্তির লালন শুরু করেন বাল্যকাল থেকে এবং তাঁর পরিবার থেকেই। নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিতের জন্য ভাবনা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হওয়ার প্রেরণা ও ত্যাগের আকর তিনি তাঁর পরিবার থেকে পেয়েছেন।

শোষিত-নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রামই তাঁকে আত্মত্যাগী অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। পিতা-মাতার আদর্শ তাঁর নিজস্ব সত্তাকে বিকশিত করতে অনুপ্রাণিত করেছে। মহীয়সী রমণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের একনিষ্ঠ সহযোগিতা তাঁকে মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার জার্নি সম্পাদনে অমূল্য অবদান রেখেছে।

ইস্পাত-কঠিন মনোবল বঙ্গবন্ধুকে জয়ের ব্যাপারে আগুয়ান রেখেছে। কর্মী ও সাধারণের জন্য ভাবনা বলি আর উৎকণ্ঠাই বলি, তা সর্বদা চিন্তনে রাখতেন বলেই তিনি পেরেছিলেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে। কর্মীবান্ধব বঙ্গবন্ধু তাই ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা (উৎস : কারাগারের রোজনামচা—শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৬৮)।’

তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের জনগণের কষ্ট লাঘব করতে এবং তাদের আত্মপরিচয়ে বলীয়ান করতে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘নিজের জীবনের বিনিময়ে যদি এদেশের ভাবী নাগরিকদের জীবনকে কণ্টকমুক্ত করে যেতে পারি, আজাদী আন্দোলনের সূচনাতে এদেশের মানুষ মনের পটে যে সুখী-সুন্দর জীবনের ছক এঁকেছিল, সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের পথ কিছুটাও যদি প্রশস্ত করে যেতে পারি, তাহলেই আমার সংগ্রাম সার্থক মনে করব (উত্স : বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ—শেখ হাসিনা, পৃষ্ঠা-৫২)।’

কর্মসম্পাদনে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য আবেদন সৃষ্টিকারী ও উদ্বুদ্ধকরণসত্তার জাগরণ ঘটানোর কঠিন মনোবল থাকতে হয়। এই অনুধাবন ও চিন্তাকর্ষণে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং মানবহিতৈষী মনোভাব যে বাঙালির মুক্তির উপায় তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু অনুধাবনই করেছেন তাই নয়, তিনি হূদয়ে ধারণ করে, বাস্তবে প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালির মণিকোঠা স্পর্শ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনি কতটা অনন্যসাধারণ। তাইতো এই মহান নেতার আহ্বান আপামর জনতার কাছে শুধু আহ্বানই নয়, এ এক আজ্ঞা পালনের ব্রত।

তাইতো তিনি মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করে বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কারণেই। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার নিরিখ করতে গিয়ে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো তাইতো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি।’

বঙ্গবন্ধু এমনই দূরদর্শিতার সঙ্গে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রণয়ন করেন, যা পরবর্তী সময়ে এক দফায় পরিণত হয় এবং তাঁর ডাকে, প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সমগ্র মুক্তিকামী জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়, বঙ্গবন্ধুকে আশ্রয় করে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা।

সারা বিশ্বের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি এমন দেশের সংখ্যাও কম নয়। আসলে সময়োপযোগী পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপের মাধ্যমে একজন যোগ্য ও দক্ষ সেনাপতি ছাড়া যেমন যুদ্ধ পরিচালনা কিংবা যুদ্ধবিজয় সম্ভব হয় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর সঠিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনা ছাড়া এ দেশের মুক্তি ছিনিয়ে আনা কখনোই সম্ভব হতো না।

বাঙালির মর্মস্পর্শী প্রাণের স্পন্দন আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতটা বাংলা অন্তপ্রাণ এবং কতটা কৌশলী দেশ ও দেশের স্বাধীনতার বিষয়ে, সে প্রমাণ তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ আমাদের অহংকার, ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণের একটি হিসেবে। এই ভাষণের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির অনুরূপ, বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্ব, জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বা শিক্ষা অনন্তকাল ধরে জাতির জন্য আবশ্যকীয় হয়ে থাকবে।

শুধু বাঙালি জাতির জন্য কেন, বিশ্বমানবতার জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। ৪৬ বছর পর ইউনেসকো কর্তৃক তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতিদান তা-ই প্রমাণ করে (উত্স : ৭ মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ—হারুন-অর-রশীদ)।’

এ দেশকে যে তিনি স্বাধীন করবেন, দুঃখী নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তাঁর বহুদিনের, যার অনেক প্রমাণের মধ্যে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রদত্ত ভাষণ প্রণিধানযোগ্য। ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, শিক্ষাই শ্রেষ্ঠ নীতি এবং শিক্ষা হলো শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। দেশ গঠনের পূর্বেই তিনি শিক্ষা বিষয়ে বলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না (উত্স : বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ—শেখ হাসিনা, পৃষ্ঠা-৬১)।’

জাতীয় উত্পাদনের কমপক্ষে ৪ শতাংশ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের তাগিদ তিনি তখনই অনুধাবন করেন। তিনি পাঁচ বছরের শিশুদের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা, মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন, নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, বিশেষ করে মেডিক্যাল, কারিগরি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষাবান্ধব পরিকল্পনার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা-বর্বরতা তাঁকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে দেয়নি। আবারও বঙ্গবন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শুধুই একজন মানব অথবা একটা শরীরী আত্মাই নন, তিনি একটি প্রেরণা। তিনি বাঙালি জাতির স্বপ্ন-উন্মেষ, অগ্রভাগে নেতৃত্বদানকারী, পরিকল্পনা প্রণয়নকারী এক মহান রাজনীতিক।

জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নকারী মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের ব্রত ও সংগ্রামী রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল এ দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, শোষণ-বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন করা। আর এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন।

জাতির পিতা প্রকৃতপক্ষেই দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বদ্ধপরিকর ছিলেন বলেই অগ্রাধিকারভিত্তিক ক্ষেত্রগুলোও তখন থেকেই নির্ধারণ করেন। যে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত, সে জাতি তত উন্নত—তা তিনি মনে করতেন বলেই উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন, আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও আলোকিত মানবসম্পদ তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

অতঃপর রাজনীতির এই মহাকবি শত প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে আমাদের একান্ত আপন করে দিলেন গৌরবদীপ্ত লাল সবুজের পতাকা এবং আমাদের জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি …।

অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের মাঝে বীর বেশে উপস্থিত হলেন স্বাধীনতার এই মহানায়ক। দেশে ফিরেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য নানা রকম পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।

ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চিত, শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের চিরকষ্ট ও বেদনার প্রচ্ছদ দূর করতে হলেন বদ্ধপরিকর, যাতে এ দেশকে শিক্ষাদীক্ষায় এই উপমহাদেশ তথা বিশ্বের মধ্যে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা যায়, এ দেশ যেন উন্নত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে কাজ শুরু করেন।

বাঙালির মানসপটে উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাঙালির অস্তমিত স্বাধীনতা সূর্যকে আমাদের নিজের করে দিলেন, ঠিক তখনই এই দেশের বিরোধীভাবাপন্ন পাকিস্তানপ্রেমীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। মানুষ নামের কুলাঙ্গাররা পাকিস্তানের পরাজয়কে নিজেদের পরাজয়সম ভাবাদর্শনের অংশ হিসেবে নীলনকশার জাল বুনতে শুরু করে। গোটা বাঙালি জাতি যখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা, তখন ওই নরপিশাচেরা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মত্ত হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

সুযোগ বুঝে তারা জাতির সূর্যসন্তান বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য শুধু বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে সরানো কিংবা তাঁকে হত্যা করাই নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানের আদর্শিক রাষ্ট্র কায়েম করা। মিথ্যার ভিত্তি যে ঘুণে জর্জর, মিথ্যাশ্রয়ীরা যে দুর্বল, ভীতি যে তাদের তাড়া করে ফেরে তাইতো ওই ঘাতকচক্র শুধু জাতির পিতাকেই বুলেট বিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অতি আদরের ১০ বছরের ছোট্ট রাসেলও ঘাতকদের নির্মমতা থেকে প্রাণে রক্ষা পায়নি। এমন হূদয়বিদারক বর্বরতম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো কেউ দেখেনি। ব্যক্তি মুজিবের অনুপস্থিতি যে তাঁর আদর্শের পুষ্পবৃষ্টি হয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইল অতিক্রম করবে, তা ওই ঘাতকচক্র অনুমান করতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-উন্মেষ যাঁর সাধনা, আদর্শ যাঁর অনুপ্রেরণা, সত্য-সুন্দর-কল্যাণাশ্রয়ী পথ যাঁর নিশানা, সেই মহাপরিকল্পনা প্রণয়নকারী উন্নত বাংলাদেশের রূপকার গণমানুষের হূত্স্পন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আপনার নিকট শোকের এই মাসে আমাদের নিবেদন, আপনি অতি দ্রুত আমাদের জাতির পিতার দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করুন।

লেখক : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ ও প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কেমন হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র!

ড. মো. তরিকুল ইসলাম


অধিক জনসংখ্যা ও দরিদ্র এই দেশটিতে (বাংলাদেশ) হয়ত আমরা হার্ভাড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোনো দামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবো না। কেননা সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ছাড়াও মানসম্মত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়েও রীতিমত ঘাটতির প্রশ্ন রয়ে যায়।

মূলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান কেমন তা উক্ত বিষয়গুলির মানদন্ড ছাড়াও দেশীয় ও বৈদেশিক কর্মক্ষেত্রে তার থেকে প্রাপ্ত জনশক্তির কর্মদক্ষতা বা অবদানের উপরেও নির্ভরশীল।

একটি মানসম্মত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য অভিজ্ঞ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত নিশ্চিত করাটাও অত্যন্ত জরুরী। এদিক থেকে হয়ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সার্বিক দিকে মানের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়- কিন্তু এই বিশাল জনশক্তিকে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হলে নিশ্চয়ই একটি মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে।

কেননা এত বড় একটি জনগোষ্ঠী থেকে মানসম্মত শিক্ষার্থী ও অভিজ্ঞ শিক্ষক গোষ্ঠী বের করা মোটেও অসম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধাভিত্তিক পরিচর্চা হতে পারে একটি ফলপ্রদ পদক্ষেপ।

শিক্ষাকার্যক্রমটি নাম্বারকেন্দ্রিক সনদে রূপান্তর কিংবা শুধুমাত্র স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে না নিয়ে বরং একে তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন- (১) আবশ্যিক বা মৌলিক অংশ: যেহেতু শিক্ষা একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার সেহেতু ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাব্যবস্থার এ পর্যায়টিকে নিশ্চিত করতে হবে।
এটিকে আবশ্যিক বলছি একারণেই- এখানে শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিক জ্ঞান-শিক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে, যেমন- ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা, মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ, দেশীয় আইন বা নিয়ম-কানুন, অত্যাবশ্যকীয় সাধারণ জ্ঞান, ইত্যাদি। এককথায় একজন সাধারণ মানুষের জীবনধারনে অপরিহার্য বিদ্যাশিক্ষাদান করাই এ স্তরের মূল উদ্দেশ্য।

বিশাল এই জনগোষ্ঠীর একটি বিশেষ অংশ হয়ত এর আওতায় সরকারের পক্ষেও আনা সম্ভব না হতে পারে, তাই এই স্তরটির সময়সীমা নির্ধারনও করতে হবে সেভাবে যেন সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা থেকে একজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়লেও অন্তত এই স্তরটি সমাপ্ত করার সুযোগ সে পায়। সেই সাথে এ স্তরেই ছড়িয়ে দিতে হবে পরবর্তী স্তরে পৌঁছাবার আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা।

(২) দক্ষতা অর্জন অংশ: দরিদ্র ও ঘনবসতির এই দেশটিতে কর্মদক্ষ জনশক্তি গড়া এবং শিক্ষাজীবনের পরবর্তী স্তরে মেধা স্থানান্তর করাই এ স্তরের মূল লক্ষ্য। এ স্তুরে শিক্ষার্থীদেরকে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করা হবে যেন তারা দেশ বিদেশের কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মেধা ও শ্রমকে সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

(৩) অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞতা অংশ: দ্বিতীয় স্তর থেকে একটি বিশেষ শ্রেণিকে বিশেষত যারা দক্ষ এবং অধিক দক্ষতা অর্জনে অর্থাৎ অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ হতে ইচ্ছুক বা হওয়ার সক্ষমতা রাখে তাদেরকে ব্যক্তিগত, বিশেষ অনুদান (ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক) ও সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিপালন করা যেতে পারে। এটি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষাকার্যক্রম।

এখানে শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (যেমন- অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি, পোস্টডক্টরেট) বিষয়ক জ্ঞানচর্চা করবে। এতে করে দেশীয় সম্পদ ও শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন ও প্রয়োগবিধি নিশ্চিতকরণে সুবিধা হবে। তবে, এর জন্য আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলিকেও সাজাতে হবে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ইদানীং বহু চাকরীদাতা প্রতিষ্ঠান চাকরীর বিজ্ঞাপনে আবেদনকারীদের কাছ থেকে পদমর্যাদাতিরিক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা দাবি করেন; যা বেকারত্ব বৃদ্ধি ছাড়াও জন্ম দিচ্ছে নানারকম অনিয়ম ও দুর্নীতির। এতে শিক্ষা ও সনদের মান এবং মূল্যায়ন দুটোই কমে; বেড়ে যায় নাম্বারভিত্তিক সনদের শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রতিযোগিতা।

এছাড়াও বেড়ে যায় পদকেন্দ্রিক যোগ্যতা ও দক্ষতার অবদমন, কর্মক্ষেত্রে মেধা ও দক্ষতার অবমূল্যায়ন- তুদপরি অসম বা অকার্যকরি বণ্টন, আর্থিক (উপঢৌকন) ও ক্ষমতার (যেমন- ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক) প্রভাবশালিত্ব, এবং শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক খরচ- মতান্তরে দেশীয় সম্পদ ও মেধার অপচয়। আমাদের এটি ভুললে চলবে না যে – গুনমানে পরিমাণ প্রহারিত হয়। শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য ও মন না চাইলেও যেন সবাইকে উচ্চশিক্ষার আসর পর্যন্ত জোরপূর্বক টেনে আনতে না হয় সে ব্যবস্থার সুরাহা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই করতে হবে।

একজন রোগী যখন পরপর ১০ জন ডাক্তারের নিকট গিয়ে সঠিক চিকিৎসা পায় না তখন স্বভাবতই সে ধরে নেয় এদেশে উপযুক্ত ডাক্তার নেই এবং সে সঠিক চিকিৎসাও পাবে না; শরণাপন্ন হয় বিদেশের ডাক্তারের প্রতি। আমরা অধিকংশই আজ ঠিক এই অবস্থানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।

একজন শিক্ষার্থী ৮০ নাম্বার পেয়ে এ+ পেল আর অপরজন ১০০ পেয়ে পেল, দুজনের মধ্য পার্থক্য নিশ্চয়ই চোখে পড়ার মত! শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করে দেয়া ও তদনুযায়ী ট্রিটমেন্ট দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করা অর্থাৎ তাদেরকে দৃশ্যত জনশক্তিতে রূপান্তর করার গুরুদায়িত্ব নিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে। আর এ কাজে সার্বিক সহায়তা দেবে শিক্ষার্থীর পরিবার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা।

শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতাভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নিশ্চিত করা না গেলে শাখাভিত্তিক ও বিশেষায়ণ জ্ঞানচর্চায় ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষায়িত বিষয়ের অন্তরালে শিক্ষার্থীরা মত্ত হয়ে পড়ে ভিন্নতর (চাকুরীর জন্য) জ্ঞানচর্চায় যা গুনগত ও সংখ্যাগত উভয় দিক দিয়েই বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার অন্তরায়। পারতপক্ষে, মানসম্মত দ্রব্য উৎপাদনেও বিশেষজ্ঞের প্রত্যক্ষ ছোঁয়ার বিকল্প নেই।

আমাদের শিক্ষা- ও কর্মক্ষেত্র-ব্যবস্থাপনায় যেথকটি শ্রেণি খুঁজে পাওয়া যায় তা হল- (১) পছন্দনীয় দক্ষতা অর্জন ও পছন্দ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র (অতি নগণ্য); (২) পছন্দনীয় দক্ষতা অর্জন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র নয় (অধিক); (৩) পছন্দ মোতাবেক দক্ষতা অর্জন নয় বরং কর্মক্ষেত্র (নগণ্য); এবং (৪) পছন্দ মোতাবেক দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্র কোনটিই নয় (অধিক)।

এককথায়, শিক্ষার্জন ও জীবনধারনের সর্বস্তরে উপভোগ্য সময় অতিবাহিত করতে হলে মেধা ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা অত্যন্ত আবশ্যিক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে কবে?

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা


অনেক শিক্ষার্থী ফোন করে জানতে চায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে কবে? সেটা আমার অজানা। তাই সঠিক উত্তর দিতে পারি না। ২৫ আগস্টের আগে মনে হচ্ছিল- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে একটা ঘোষণা আসতে পারে।

কয়েকদিনের মধ্যে আশা-নিরাশার ব্যাপারটি লক্ষ্য করলাম। পত্রিকায় যেভাবে লেখা তাতে মনে হচ্ছিলো সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিলো ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে খোলার বিষয়ে কিছু একটা জানানো হবে। ২৫ আগস্ট জানতে পারলাম আপাতত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। বিশেষজ্ঞমহল খোলার বিষয়ে আরও ধৈর্য্য ধরতে বলেছেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিছুটা ভিন্নতর। অনেকে অতীত অভিজ্ঞতায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। যুব সম্প্রদায়, টগবগে রক্ত করোনার কারণে- কিছু ঘটে গেলে সামাল দেয়া যাবে কি-না এ ব্যাপারে পিছুটান থাকে।

বাংলাদেশে করোনার পরিস্থিতি দেখে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ মুহুর্তে খোলা যেতে পারে বলে তারা মনে করে। তবে প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলার বিষয়ে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য একটা পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে :

(১) মাস্টার্স পরীক্ষার্থী যাদের শুধুমাত্র পরীক্ষা বাকি আছে- তাদের পরীক্ষা শেষ করতে হবে। যেসব বিভাগে ব্যবহারিক কিংবা মৌখিক পরীক্ষা অথবা থিসিস কিংবা প্রজেক্ট বাকি-তাদের কাজগুলি শেষ করতে পারলে মাস্টার্স পর্ব শেষ হয়ে যাবে। এতে হলগুলির উপর বিশেষ কোন চাপ পড়বে না।

(২) মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর স্নাতক বিশেষ করে যাদের টার্মিনাল পরীক্ষা শেষ করতে পারলে- মাস্টার্স এবং স্নাতক ডিগ্রি পেতে পারতো। এতে করে ক্যাম্পাসে সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহজ হতো।

এই পরীক্ষা দু’টি শেষ করতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। এরই মধ্যে বোঝা যাবে করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। সীমিত পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে পরিস্থিতি বা পরিবেশ অনুমান করা যাবে এবং সরকার কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে বলে মনে করি।

কোন কারণে করোনা সংক্রমণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারও বন্ধ করা যাবে তাতে কেউ আপত্তি করবে না। ডঐঙ বলেছে, আগামী দু’বছর এভাবেই করোনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সীমিত পরিসরে খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। সকল শিক্ষার্থী একসাথে ক্যাম্পাসে আসলে সামাজিক দূরুত্ব বা করোনা সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। সেকারণে পর্যায়ক্রমে (মাস্টার্স, স্নাতক) ক্লাস খুললে ভাল হবে বলে অনেকের ধারণা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ এ প্রসঙ্গ বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বায়োটেকনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ প্রদান জরুরি

অধ্যাপক ড. মো. মেহেদী হাসান খান


বর্তমান করোনা মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা ফুটে উঠেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার ইতিমধ্যে চার (৪) হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ (৫) হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। তবুও সমস্যার সমাধান দৃশ্যমান হচ্ছে না।

এ অবস্থায় সরকার আরও দুই (২) হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু চিকিৎসার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য গ্রাজুয়েট যেমন বায়োটেকনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট কিংবা ফার্মাসিস্টদের নিয়োগের ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু সংক্রামক রোগের জীবাণু শনাক্তকরণে, রোগের কারণ নির্ণয়ে, ভ্যাকসিন তৈরিতে নতুন নতুন ঔষুধ আবিষ্কারে এ সমস্ত গ্রাজুয়েটদের অবদান অনস্বীকার্য।

বর্তমানে বাংলাদেশে আশিটিরও বেশি ল্যাব এ কোভিড-১৯ শনাক্ত হচ্ছে। এর বেশিরভাগ ল্যাবই বায়োটেকনোলজিসহ উপরে বর্ণিত গ্রাজুয়েটরা বিনা পারিশ্রমিক এ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তবুও এদের নিয়োগের ব্যাপারে বা পারিশ্রমিক প্রদানের ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে এই সমস্ত গ্রাজুয়েটরা দেশে কোনো চাকরী না পেয়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক ল্যাবে গবেষণা করে যখন বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন কিংবা ঔষধ আবিষ্কার করেন, তখন আমরা বাংলাদেশী হিসেবে শুধুমাত্র গর্ববোধ করি। এই ভ্যাকসিন এবং ঔষধ আমরা পরবর্তীতে উচ্চ মূল্যে আমদানি করি।

আমাদের দেশে বিজ্ঞানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই সমস্ত বিষয়গুলোতে ভর্তি হয়। পরবর্তীতে দেশে কোন চাকরী না থাকায় বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে আমাদের জনগণের কষ্টের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে মেধাবী গ্রাজুয়েট তৈরি করে মেধা পাচার করছি।

১৯৯৩ সালের পূর্বে এই সমস্ত গ্রাজুয়েটদের সরকারী চাকুরীতে প্রবেশের সুযোগ ছিল। এরপর এক অদৃশ্য কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায়, বিশেষ বিসিএস- এর মাধ্যমে চিকিৎসকদের সাথে সাথে বায়োটেকনোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং ফার্মাসিস্ট গ্রাজুয়েটদেরকেও নিয়োগের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

বায়োটেকনোলজিস্ট এবং বায়োকেমিস্টদেরকে রোগ শনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন ল্যাবে মাইক্রোবায়োলজিদেরকে সংক্রামক রোগের গবেষণা ও ভ্যাকসিন তৈরিতে এবং ফার্মাসিস্টদেরকে ঔষধ প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। দক্ষ ব্যক্তিকে যথাযথ জায়গায় নিয়োগ প্রদান করলে কাজে গতি আসবে এবং বর্তমান অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা দূর হবে।

এজন্য প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পি.এস.সি সহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক: অধ্যাপক ড. মো. মেহেদী হাসান খান, ডীন, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, বাংলাদেশ।

দুর্নীতি মুক্তির পরশ পাথর: পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নাকি সঠিক পদায়ন

শেখ মাহাতাবউদ্দিন


সাম্প্রতিক সময়ের খবর এবং মানুষের মুখরোচক সমালোচনার অন্যতম বিষয় হল চিহ্নিত পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি। বিশেষ করে টেকনাফ থানার শামলাপুর তল্লাশিচৌকির নিকটে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের মৃত্যুতে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের সম্পৃক্ততা এই আলোচনাকে অনেক রসদ যুগিয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ মনে করছেন।

প্রদীপ কুমার দাশ গ্রেপ্তারের পর থেকেই একে একে বেড়িয়ে আসছে তার বিভিন্ন অপকর্মের ফিরিস্তি। রিতিমত তাজ্জব বনে যাওয়ার মত রেকর্ড তার, যার অন্যতম হল, ২০১৮ সালের মে থেকে২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারে “বন্দুকযুদ্ধ” বা “ক্রসফায়ারে” নিহত হয়েছেন মোট ২৮৭ জন, তাদের মধ্যে ১৬১ জনই মারা গেছে টেকনাফ থানা পুলিশের হাতে।

প্রশ্ন হল তাহলে কি কেবল কক্সবাজারেই এমন ঘটনা হয়েছে? উত্তর না, প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এমন ভাবে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। হ্যা, ১৩ আগস্ট 2020 পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ মৃতের তুলনাতে এই সংখ্যাটি মাত্র ৬৬৩ জন কম, অর্থাৎ জন জীবনে এই ঘটনার গুরুত্ব মহামারীর কাছাকাছি।

সে যাই হোক, টেকনাফ থানার এই মৃত্যুর মিছিলের অধিকাংশগুলো নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। একই সাথে প্রদীপ কুমার দাশের অনৈতিক এবং অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডেরও অগণিত অভিযোগ প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন গনমাধ্যম গুলোতে।

শুধু যে প্রদীপ কুমার দাশকে নিয়েই এমন লোমহর্ষক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে আসছে কিংবা প্রদীপ কুমার দাশই প্রথম ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যার সম্পর্কে এমন রিপোর্ট তা কিন্তু নয়। কিছু দিন পূর্বের সংবাদ পত্রগুলো ঘাঁটলেই দেখব বরগুনার আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষেই মিলেছে এক আসামীর ঝুলন্ত লাশ।

এমন বহু প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনার নায়ক হিসেবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নাম আসে পত্রিকার পাতাতে। তার মানে কি পুলিশ বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মানেই অঘটন ঘটন পটীয়সী? উত্তর অবশ্যই না হবে, কারন এর উত্তর সর্বদা হ্যা হলে আমরা কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। তবে যে হারে একেকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নামে রিপোর্ট হচ্ছে সেটাও আশংকাজনক।

বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে মাননীয় সাংসদগণের ডিও লেটারের মাধ্যমে অনেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদায়ন হয়। একই সাথে একজন কনস্টেবল বা এ এস আই থেকে পদোন্নতি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন। সময়ের সাথে সাথে উপরস্থ অসৎ সহকর্মীদের বিভিন্ন অন্যায় এবং সিস্টেমের ফাঁক ফোঁকরে লুকিয়ে থাকা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এদের নৈতিকতার কফিনে শেষ পেরেক বিদ্ধ হওয়া ঠেকানো এদের জন্য দুস্কর নয় বরং অসম্ভবই হয়ে পরে। ফলাফল, তড়িৎ আবেশের মত অসততার আবেশ যুক্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

এই অসততার আবেশ এবং প্রদীপের নিচের অন্ধকারকে মশালের আলোকবর্তিকার আলতে ঝলমলে করতে ৪ বছর পূর্বেই এক অবিসংবাদিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে গনমাধ্যম মারফত জেনে ছিলাম। এই সিদ্ধান্ত শুনেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়কে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম আমরা রাষ্ট্রের সাধারণ এবং সচেতন জনগণ।

সিদ্ধান্তটি ছিল, সরাসরি বিসিএস থেকে অর্থাৎ সহকারী এস পি দের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা, যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পদায়ন করা হবে। একজন সদ্যজাত সন্তানের যেমন অপরাধ প্রবণতা শূন্যের কোঁটাতে তেমনি একজন সদ্য সারদার ট্রেনিং এবং আনুসাঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা শেষ করা পুলিশ অফিসারেরও গায়ে কাঁদা মেখে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার ইচ্ছাও থাকবে সর্বনিম্ন লেভেলের।

ফলশ্রুতিতে থানার পূর্বোক্ত পুলিশের সদস্যদের মধ্যে অনৈতিক কিংবা অসৎ কেউ থাকলে তার অসততাকেও লাগাম টেনে ধরতে পারবেন সহজেই। এই প্রয়াস অন্তত কোন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রদীপ কুমার দাশ হতে দিবে না বলেই অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সচেতন জনগণের বিশ্বাস। বাধা হিসেবে বলতে পারেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার অভাবের বিষয়টি, এই ক্ষেত্রে বলব, সকল কাজের জন্য অভিজ্ঞতা ভালো কোন গুন না।

অপরদিকে, থানা সদরের প্রায় সকল সরকারি দপ্তর পরিচালিত হয় একজন বিসিএস ক্যাডার কিংবা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে শুধুমাত্র এই থানার দেওয়াল গুলো বাদে। যদি একজন বি সি এস কর্মকর্তা অন্য দপ্তরগুলো সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারেন তবে সারদার ট্রেনিং এবং আনুসাঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পৃক্ততা এর পরে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিজের অধিনস্তদের সহযোগিতা নিয়েই একেকটি থানাকে জনগণের ভয়ের স্থল থেকে মুক্ত করে জনবান্ধব এবং জননিরাপত্তার আধার হিসেবে গড়ে তুলবেন বলেই সচেতন জনগণ বিশ্বাস করতে চায়।

পরিশেষে রাষ্ট্রের সচেতন জনগণের পক্ষ থেকে এবং একজন মেরুদণ্ড গঠনের কারিগর হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আবেদন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা থানাকে দুর্নীতি মুক্ত করতে প্রতিটি থানাতে একজন বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগ দিন।

বাংলাদেশ পুলিশের মত দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গঠনকারী একটি বাহিনীকে অসাধু কর্মকর্তাদের করা অনৈতিক কাজের ভার মুক্ত করুন, যার অন্যতম হাতিয়ার হবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সৎ, চৌকশ এবং মেধাবী বিসিএস ক্যাডারদের নিয়োগ।

শেখ মাহাতাবউদ্দিন, পিএইচ. ডি.
সহযোগী অধ্যাপক, পুষ্টি এবং খাদ্য প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।