শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য কি আমাদের শিক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না?

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম


গত কয়েকদিন ধরে একটা নিউজ বেশ আলোচনায়। বিষয়টি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ও এমফিলের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। জানি না এটা নিয়ে আলোচনা এইবার কেন, এই বিজ্ঞপ্তিতে একই ভাষা ও নীতি বহুবছরের ছিলো। বোধ করি, এবার প্রথম আলো সহ মিডিয়ায় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি কাভার হয়েছে বিধায় এটা আলোচনায় আসছে।

আলোচ্য বিষয় দুটি এই ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে
১. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র সরাসরি পিএইচডি ‘তে ভর্তি হতে পারবে না;
২. পিএইচডি ও এমফিল ভর্তিতেও স্কুল কলেজের রেজাল্ট এর শর্ত

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, দুনিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয়(বাংলাদেশের ছাড়া) এরকম আজগুবি শর্ত দেয় না।এগুলো রীতিমতো ‘হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য!তবে, হয়তো এই শর্ত ঢাবি প্রকাশ্যে উল্লেখ করেছে, কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়তো লিখে দেয় না।কিন্তু তারা অলিখিতভাবেই এটা বিধিবদ্ধ করে নিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এখন প্রশ্ন হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা করতে পারে কিনা?
উত্তর সহজ, প্রথমত,এগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইনগতভাবে সবই পারে ও বিধিবদ্ধ! বিশেষ করে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অর্ডিন্যান্সে হয়তো শুধু একজনকে পুরুষ থেকে মহিলা রুপান্তর করতে পারে না বাকি সব পারে।
১৯৭৩ এর অর্ডিন্যান্স অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো। কিন্তু আমরা এর যোগ্য কিনা সেই প্রশ্ন বরাবরই জ্বলজ্বল করে! কারণ শিশুদের হাতে উপকারী বস্তুও তাৎপর্যপূর্ণ নয়।এগুলোর মর্ম বোঝার জন্য ‘বড়’ হতে হয়!এই স্বায়ত্তশাসনের নামে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এরা একেকটি মগের মুল্লুক বানিয়ে ফেলেছে।পত্রিকা খুললেই তাদের লজ্জাস্কর নিউজগুলো হরহামেশাই চোখে পরে।

লেখকের আরও কলাম-

এইচএসসি বিনা পরীক্ষায় পাশের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা : একটি মূল্যায়ন

দ্বিতীয়ত, নৈতিক ভাবে এরা এটা করতে পারে কিনা? না, নৈতিকতার প্রশ্নে তারা মোটেই এইসব করতে পারে না।পারে না এই কারণে এগুলো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে,তাই জনগণের বৃহৎ স্বার্থে এরা কাজ করবে এটা প্রত্যাশিত। তাদের কাজগুলো রাষ্ট্রকে সঠিক বার্তা দিবে এটাই প্রত্যাশিত।

এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত আদালতে রিট করা! চাইলে সংক্ষুব্ধ কোন ছাত্র বা আইনজীবীও রিট করতে পারেন। রাষ্ট্রের সচেতন সমাজের উচিত এরূপ পাড়া-মহল্লার মাতবরদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে সোচ্চার হওয়া।কারণ সমাজে এর ভুল বার্তা যাচ্ছে আর দেশের সংবিধান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্বীকার করে কার্যত রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই শতবর্ষ উদযাপন করলো,আর কত শতবছর গেলে স্কুলের বাচ্চাদের মত আচরণ বন্ধ করবে? শতবর্ষ পেড়িয়ে গেলেও এখন পিএইচডি ভর্তি থেকে স্কুলের রেজাল্ট এর বিবেচনার মত হাস্যকর শর্ত থেকে সরে আসতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।আরো মজার বিষয় এই ধরনের বিজ্ঞপ্তিতে প্রায়ই বলা থাকে, আভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের জন্য যেকোন শর্ত শিথিলযোগ্য! দুনিয়ার আর কোন দেশে এরকম ‘হাস্যকর’ শর্ত আছে কিনা জানি না।

প্রসঙ্গত, ইউজিসি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ও এমফিল প্রোগ্রাম চালু করার সুযোগ দেয় না, যা অবশ্যই সংবিধানের ২৮(১) এর সাথে সাংঘর্ষিক। যেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস সরকার ও ইউজিসি অনুমোদিত,সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অধিকারই নাই এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করা! অনেকে শুধু নিয়ম বলে চুপ করে আছেন।আরে যে নিয়ম আপনার অধিকারকে সমুন্নত রাখে না সে নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতেই হবে,সেটা হউক গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে! এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির নিজেদের অক্ষমতার দায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে খোড়া যুক্তিতে।মোটাদাগে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে বিরত রাখার কোন সুযোগই নেই তাদের।তারা বিভিন্ন শর্তারোপের মাধ্যমে অবশ্যই তার অনুমতি ‘যোগ্য’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেয়া উচিৎ। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি বাংলাদেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রাম চালু করার সক্ষমতা এই দেশের কথিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক বেশিই আছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে বৈষম্যমূলক পোষ্য কোটাও চালু রেখেছে যা ভর্তি থেকে শিক্ষক নিয়োগেও প্রযোজ্য হয়।এখানে আরেকটি আলোচনা প্রাসঙ্গিক- এই বৈষম্য কি শুধু ঢাবিই করে? উত্তর- না! শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নয়, স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। স্কুল পর্যায়ে সাধারণত জেলার সেরা স্কুল থাকে জেলা স্কুলগুলো!গ্রাম থেকে যেসব ছেলেরা এই স্কুলগুলোতে পড়তে আসে তাদেরকে গেরাইম্যা বলা হয়!

কর্মক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান রীতিমতো নাম উল্লেখ করে যোগ্য-অযোগ্য ঘোষণা করে দেয়!চাকুরীতে অনেক প্রতিষ্ঠান রীতিমতো বুলি করে চাকুরী প্রার্থীদের তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি না পাওয়া কুমিল্লার আবদুল আউয়াল।১ম হয়েও আউয়ালের ২৯তম বিসিএসের প্রার্থিতাই শুধু বাতিল হয়নি এবং সরকারি চাকরিতে তাঁকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন পিএসসি। তখন পিএসসি বলে, ‘আউয়ালের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথম হওয়ার মতো নয়।’ কিন্তু কীভাবে তিনি প্রথম হলেন, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি পিএসসি। বরং সব সিদ্ধান্তই প্রথা ভেঙে গোপন রাখা হয়েছে।এখন জানি কি সেই গোপন কারণ যে কারণে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হলো!

২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় শীর্ষ দশে যাঁরা আছেন, তাঁদের নয়জনই কোনো না কোনো বিষয়ে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে।কিন্তু একমাত্র আবদুল আউয়ালই পাস কোর্সে (ডিগ্রি) পড়েছেন, মাস্টার্স করেছেন। আর তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ!

২০১৫ সালে চাকরিতে নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জিতে অবশেষে বিসিএস ক্যাডারে চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয় মেধাবী শিক্ষার্থী আব্দুল আউয়াল। তাকে পুলিশে চাকরির জন্য মনোনীত করেছে পিএসসি।অবশ্য নিয়োগেও শুনেছি গড়িমসি, পরে জয়েন করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না।আর যদি জয়েন করেনও এতগুলো বছর আর হয়রানীগুলো তাকে কে ফিরিয়ে দিবে?প্রসঙ্গত,২০০৯ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় ২৯তম বিসিএসের কাজ।২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৯তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেবার মোট ৫ হাজার ৬২ জন চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন।

তাদের মধ্যে ১ হাজার ৭২২ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে পদায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়।সেখানে ১ম হয়েছিলেন আওয়াল।পরে প্রথম হবার পর ওনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ডিগ্রি পাস হওয়া দেখে কমিশন সন্দেহ করে তার ফলাফল আর সন্দেহের থেকেই তাকে আবার মূল্যায়নের জন্য ভাইভাতে ডাকে। তারপর তাকে অবমূল্যায়ন করে ও চাকুরীতে নিষিদ্ধ করা হয়।এত বড় একটা বিসিএস পরীক্ষার তিন ধাপের আয়োজনে কেউ জালিয়াতি করে না হয় চাকুরী পেতে পারে,কিন্তু সে কি প্রথম হতে পারে?আব্দুল আওয়াল যদি আজকে ঢাবি,রাবি,চবির ছাত্র হতো হয়তো এই প্রশ্নই আসতো না!!

এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ সংবিধানের ২৮(১) ও ৪৪ ধারার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।এই ধারাদ্বয় এরুপ বৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করে।তাই সচেতন সমাজের উচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা! না হলে নিভৃতে বৈষম্যের জাঁতাকলে বহু মেধাবী প্রতিষ্ঠানের নামে পিষে যাবে,ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতি।

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম
শিক্ষক
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও
মানবাধিকার কর্মী ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: গৌরবের ৬৮ বছর

আনন্দ কুমার সাহা

১৯৫৩ সালের ৩১শে মার্চ পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ হয়। গভর্নরের অনুমোদনের পর ১৯৫৩ সালের ১৬ই জুন ঢাকা গেজেটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তথ্যটি প্রকাশিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্টের কার্যক্রম শুরুর জন্য সরকার প্রফেসর ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীকে একই বছরের ৬ই জুলাই উপাচার্য নিয়োগ করেন। পদ্মা তীরবর্তী ওলন্দাজ বাণিজ্য কেন্দ্র ‘বড়কুঠি’-তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৫৪ সালে ৫ জন ছাত্রী ও ১৫৬ জন ছাত্র নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক যাত্রা শুরু করে। শুরুতে রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৬৪ সালের মধ্যে বর্তমান মতিহার ক্যাম্পাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি অনুষদ।

জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ সম্প্রতি ২টি অনুষদে বিভক্ত হয়েছে। মনোবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি এবং চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস। ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা এবং ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব জিও সায়েন্সেস।

লেখকের আরও লেখা

ড. শামসুজ্জোহা

আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকাটা আনন্দের

গত ২৭.০৬.২০২০ তারিখে সিন্ডিকেট সভায় আরও ২টি অনুষদ অনুমোদিত হয়েছে। কৃষি অনুষদ থেকে ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস এবং ফিশারীজ অনুষদ সৃষ্টি হয়েছে। ৬টি ইনস্টিটিউটসহ মোট ৫৮টি বিভাগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

ইনস্টিটিউট

জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় উচ্চতর গবেষণা ও পরিচর্যার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি ইনস্টিটিউট শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে: ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (১৯৭৪), ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (১৯৮৯), ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স (২০০০), ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (২০০০), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (২০০০) এবং ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ এন্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেস (২০১৫)।

ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স সেল এবং সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং: এই প্রতিষ্ঠান দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংযুক্তের সংখ্যা শিক্ষক-১২২১ জন (প্রফেসর ৬০৪, সহযোগী ২৯৭, সহকারী ২৩০, প্রভাষক ৯০ জন), অফিসার-৮০৫ জন, সহায়ক কর্মচারী-৭১৪ জন, সাধারণ কর্মচারী-১২২৯ জন এবং শিক্ষার্থী-৩৮,৩০০ জন ও বিদেশী শিক্ষার্থী-৫৮ জন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতীক

মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই গোলাম সারওয়ারের আঁকা মূল নকশা নির্বাচনের পর কিছুটা পরিবর্তন করে বর্তমান প্রতীকে রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকে রয়েছে একটি বৃত্ত। তা বিশ্বের প্রতীক। একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যা জ্ঞানের প্রতীক এবং আকাশ দৃষ্টি থেকে শাপলা ফুল সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জাতীয় প্রতীক। এটি সূর্য অর্থেও প্রাণ ও শক্তির উৎস। প্রতীকের রং: বৃত্ত ও মূল গ্রন্থ কোবাল্ট ব্রু। তা আকাশ, নদী ও উদারতার রং। গ্রন্থের বহিঃরেখা রক্তলাল, জাতীয় পতাকার রং। গ্রন্থের মধ্যরেখা সোনালি, সোনার মতোই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মূল্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রতীকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে নকশা আহ্বান করা হয়। শিল্পী গোলাম সারোয়ারের আঁকা মূল নকশা নির্বাচনের পর কিছুটা পরিবর্তন করে বর্তমান প্রতীকে রূপ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী হাশেম খান।

শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১৬১ জন (১৫৬ জন ছাত্র এবং ৫ জন ছাত্রী)। বর্তমানে সকল বিভাগে বিভিন্ন বর্ষে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ৩০০ জন এবং বিদেশী শিক্ষার্থী ৫৮ জন। প্রতিষ্ঠার গত ৬৮ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২,৬৫০ জন শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১,৯৪৬ জনকে পিএইচডি এবং ৭০৪ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয় (২০২০ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত)।

মুক্তিযুদ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ অংশগ্রহণ করে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর শামসুজ্জোহা শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হলে আইয়ূব খানের পতন ত্বরান্বিত হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষক (গণিত বিভাগের হবিবুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মীর আব্দুল কাইয়ূম এবং ভাষা বিভাগের সুখরঞ্জন সমাদ্দার) এবং ৫ জন সহায়ক কর্মচারী, ১০ জন সাধারণ কর্মচারী ও ৯ জন ছাত্র শহীদ হন। এছাড়াও এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অজ্ঞাত আরও অনেকে এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছে। এখানে শিক্ষকতা করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ইতিহাসবিদ ডক্টর এ.আর. মল্লিক ও জাতীয় অধ্যাপক এ.এফ. সালাহউদ্দীন আহমেদ। তাঁদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

৬ই জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস। কোভিড-১৯ এর কারণে এ বছর তেমন কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। তারা অনুপস্থিত। ইতোমধ্যে আমরা কোভিড-১৯ এর কারণে অনেককেই হারিয়েছি। আর হারাতে চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় আবার ফিরে পাবে তার প্রাণ। এই হোক আজকের প্রার্থণা। #রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ৬৮ বছর।

লেখকঃ উপাচার্য (রুটনি দায়ত্বি) ও উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।

একুশে এসাইনমেন্টই হোক প্রমোশনের সমাধান

 

তরিকুল ইসলাম মাসুম

একুশ মাস আগে (অক্টোবর ২০১৯) চীনের উহান শহরে বিস্তার ঘটার পর থেকে ধীরে ধীরে সমগ্র পৃথিবীটাকে করালগ্রাসে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে মহামারী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ওরফে নোভেল করোনা।

গত বছর মার্চের আট তারিখে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর থেকেই জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করার পাশাপাশি ১৭ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সেই সাথে সারাদেশে একযোগে কঠোর লকডাউন শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। ধাপে ধাপে লকডাউন শীথিল করা, ক্ষেত্রবিশেষে তা তুলে নিলেও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আজও খোলেনি। তাছাড়া নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পর সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে করোনা পরিস্থিতি অবনতির দিকেই ঝুঁকছে। ফলে স্বশরীরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চালু করা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁিড়িয়েছে।

একুশ দফা (সম্ভবত) ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। চলমান ছুটি ইতোমধ্যে ষোল মাসে পদার্পন করলেও ঈদের আগে খোলার ন্যূনতম কোন লক্ষণ নাই। এমনকি করোনার ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতার দরুণ এবছর খোলার পরিবেশ সৃষ্টি হবে কিনা সন্দেহ রয়ে যায়। অন্যদিকে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে স্বশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণ করা একটি জটিল সমীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ উদ্যোগ গ্রহণে তৎপর হলেও শতভাগ সফলতা অর্জন করতে যথারীতি ব্যর্থ হচ্ছে।

বলে রাখা প্রয়োজন, এইচ.এস.সি.থ ২০২০ ব্যাচকে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় অটোপাস দেওয়া হয়েছে। যদিও ফলাফল নির্ধারণ নিয়ে নানান সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তবুও সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যথেষ্ট দাবি রাখে। মাধ্যমিকে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে ওপরের শ্রেণীতে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।

একাদশে গত দুই বছরে স্বশরীরে একটিও পরীক্ষা হয় নি, শুধুমাত্র অনলাইনে কুইজ পরীক্ষা নিয়ে একাদশ থেকে দ্বাদশে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২১ সালের মাধ্যমিক ও সমমান এবং এইচ.এস.সি ও সমমান পরীক্ষাসমূহ অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যান্য শ্রেণীতে পুন:রায় এসাইনমেন্ট দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু দুই পাবলিক পরীক্ষা কিভাবে হবে তা নিয়ে চলছে নানান কল্পনা-জল্পনা। কেউ কেউ প্রস্তাব দিচ্ছেন অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য।

বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমি এই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি। অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে নির্ধারিত বিষয়সমূহের পরীক্ষার আদলে এসাইনমেন্ট নেওয়া হোক অথবা প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের আলোকে অর্ধশত নম্বরের এসাইনমেন্ট (ত্বত্তীয়) গ্রহণের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্টি নীতিমালা তৈরি করে বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসমূহকে দায়িত্ব দেওয়া হোক।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটু বেশি নাজুক পরিস্থিতির স্বীকার। গত বছর মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন যেন আরেকটি জটিল সমীকরণ। ইতোমধ্যে নানান ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা কতটুকু সার্থক তা বলাবাহুল্য। প্রথম দিকে কিছুটা সাড়া ফেললেও আপতত তা যেন ধূ ধূ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল অনুষদভূক্ত বিভাগসমূহে কিছুটা সচল শোনা গেলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। অন্যান্য বিভাগসমূহের অবস্থা বর্ণনার অযোগ্য। তাছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় নেটওয়ার্ক সুবিধা অপ্রতুল। সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। তথাপি অনেকেই দুই বা ততোধিক বছর ধরে একই শ্রেণি/বর্ষ/সেমিষ্টার এ আটকে রয়েছে।

গত জানুয়ারী মাসে শর্ত সাপেক্ষে পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি দিলে চতুর্থ বর্ষের আটকে থাকা চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। সেই সাথে মার্চ থেকে অন্যান্য বর্ষ ও সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করা হলেও অপ্রত্যাশিত কারণে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নয়, সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ বিশেষ করে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে করোনা এখন বেসামাল। এই দুই বিভাগের সীমান্ত এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বিশেষ লকডাউনের আওতায় রয়েছে। এমাতাবস্থায় গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করলেও নানা কারণে বন্ধ ঘোষণা করছে।

এমন পরিস্থিতি মোলাবিলা করতে এবং করোনা ভ্যাকসিন প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত লেখাপড়ার বিশাল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশনের ব্যবস্থা করুন। এক্ষেত্রেও পরীক্ষার আদলে প্রশ্ন দিয়ে এসাইনমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পাদন করা যেতে পারে। অথবা বিগত বর্ষ বা সেমিষ্টারগুলোর গড় সিজিপিএ থেকে ৫০% এবং এসাইনমেন্ট, ক্লাসের উপস্থিতি, টিউটোরিয়াল বা ইনকোর্স এ গৃহিত নম্বর এর উপর ৫০% জিপিএ নিয়ে ফলাফল প্রদানসহ পরবতর্তী বর্ষ বা সেমিষ্টার এ প্রমোশন দেওয়া যেতে পারে।

শর্তসাপেক্ষে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তীতে গ্রহণ করতে হবে। তবে শেষ বর্ষ বা সেমিষ্টার এর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে ব্যবহারিক পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ করা যেতেই পারে। সেই সাথে মৌখিক বা ভাইভা পরীক্ষা অনলাইনে জুম বা গুগল মিট এ সংযুক্ত করে গ্রহণ করলে সকলেই উপকৃত হতো। তাছাড়া কোন বিভাগের সকল শিক্ষার্থীরা যদি অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে পরীক্ষা দিতে সম্মত হয়, তবে সেই সকল বিভাগে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে।

এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ অনার্স প্রথম বর্ষের তিন লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদেরকে শর্তসাপেক্ষে অটো প্রমোশন দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ । যদিও সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত – পরিস্থিতি স্বাথাবিক হলে এসব শিক্ষাথর্ীদেরকে অবশ্যই প্রথম বর্ষের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। কেউ যদি উক্ত পরীক্ষায় অংশ না নেয় কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রমোটেড না হয়, সেক্ষেত্রে প্রমোশন বাতিল বলে গন্য হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী বর্তি হয়েছিল ৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৭৬ জন। কিন্তু পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী সহ সর্বমোট ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার ৮৩৫ জন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধের ষোল মাস চলমান, অথচ ৮৩ শতাংশ কলেজ শিক্ষার্থীদেও অনলাইনে ক্লাস শুরুই করতে পারে নি। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো অনলাইন ক্লাসের ধার ধারে না। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষের অপর্যাপ্ততা, সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস এমনকি শিক্ষকদের অলসতার কারণে অফলাইনেও ঠিকমতো ক্লাস হতো না। যেখানে ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাস পেয়েছিল মাত্র পাঁচ মাস, সেখানে তারা দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন পাবে কোন পড়াশোনা ছাড়াই! পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে আর এঁরা আবার আটকেন থাকা পরীক্ষাই বা কবে দিবে? তার চাইতে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে উপরের শ্রেণিতে প্রমোশন দেওয়াই উত্তম পন্থা হবে বলে মনে করি।

আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রায় এক বছর আগেই হয়তো আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু করোনা মহামারীর জন্য আটকে আছে।

গত জানুয়ারি মাসে আমরা পরীক্ষা শুরু করেছিলাম, ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো এবং একটি ত্বত্তীয় পরীক্ষা হওয়ার পর টি.আই.সি.আই এর জন্য আমরা ফেব্রুয়ারিতে নরসিংদীর ঘোড়াশালে এক মাস অবস্থানের পর আমরা ফিরে আসি। হঠাৎ করেই সরকারিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলমান পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা আটকা পড়ে আছি। এমতাবস্থায় আমরা না পারছি কোন সরকারি/বেসরকারি চাকরির আবেদন করতে, না পারছি কোন প্রাইভেট চাকরিতে যোগদান করতে। তাই আমরা চাই যেভাবেই হোক আমাদের আটকে থাকা ত্বত্তীয় পরীক্ষাগুলো শেষ করে ফলাফল দেওয়া হোক।

ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মোছাঃ হনুফা খাতুন বলেন, “আমরা এভাবে আর ঝুলে থাকতে পারছি না, এই পরিস্থিতিতে স্বশরীরে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে আমাদের মুক্তি দিতে দুইটি পদ্ধতির যেকোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক। প্রথমত, আমাদের স্থগিত হওয়া বাকি পরীক্ষাগুলো অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। দ্বিতীয়ত, বিগত বর্ষ বা বর্ষগুলোর ফলাফলের সাথে চতুর্থ বর্ষে আমাদের দেওয়া টিউটোরিয়াল, এসাইনমেন্ট এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা, প্রজেক্ট রিপোর্ট ও টি.আই.সি.আই ট্রেনিং এর পরীক্ষার ফলাফল গড় করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রদান করা হোক। কেননা, এ বছরের জন্য আমরা স্বশরীরে পরীক্ষা দেওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, প্রতিটি শতকেই দুই একটি মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তাতে মানুষের প্রাণহানি, পশু-পাখি ও পরিবেশের বিপর্যয়সহ দুর্ভিক্ষের অবতারণা ঘটে। ক্ষতি হয় চিকিৎসা, শিক্ষা, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সেইসব মহামারী থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দুই, তিন কিংবা পাঁচ বছর সময় লেগেছে। করোনা ভাইরাস থেকেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির অবতারণা কবে হবে তা এখেনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদি দুই বা তিন বছর লেগেই যায়, ততদিন তো জীবন থেমে থাকবে না।

জীবন তার নিজস্ব গতিতে নদীর স্রোতের মতো কলকল বেগে কিংবা ঘড়ির কাটার মতো টিকটিক করে চলতেই থাকবে। আর সেই জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো বিবাহ* যা মানষকে সামাজিক ও দায়িত্বশীল জীবন যাপনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিগ্রি স্নাতক বা অনার্স শেষ করতে না পারায় অনেক মেয়ের বিবাহ আটকে রয়েছে। এমনকি বিবাহ করার সর্বোত্তম সময় ২০-২৫ বছর বয়সের মধ্যে অনেক ছেলে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অভাবে বিবাহ করতে পারছে না। সুতরাং, পরীক্ষা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতার জন্য লক্ষ লক্ষ বেকারদের জীবন বৃক্ষের চূঁডায় কালো মেঘ জমা হয়ে মনের পৃথিবীটাকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে। শুধুই প্রতীক্ষা, কবে মেঘরাজি বৃষ্টি হয়ে পড়বে আর মনজগতে সূর্যের হাসি উদিত হবে।

আশাকরি, করোনার এই সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংক্ষিপ্ত সময়ে সরকার, শিক্ষামন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষাবোর্ড, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ব স্ব উদ্যোগে যথাযথ কর্মসূচি প্রদানপূর্বক সংশ্লিষ্ট সকলকে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। করোনামুক্ত একটি সবুজ-শ্যামল ও নির্মল পৃথিবী দেখার প্রত্যাশায়।

লেখক:
তরিকুল ইসলাম মাসুম ( শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক) ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

একজন উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত?

একজন উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত??

নাসির উদ্দীন: হিদেই ওহনো। আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের কন্টেক্সটে উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ভবনের কাছেই আমার ল্যাব। এজন্য প্রায় প্রতিদিনই উনার ভবনের চারপাশে হাটাহাটি করা হয়। নিজের প্রয়োজনে উনার ল্যাবের অন্য একজন প্রফেসরকে মেইল করতে গিয়ে উনাকে মেইল করেছিলাম।

উনি আমার প্রয়োজন বুঝতে পেরে সে মেইল যথোপযুক্ত মানুষের কাছে ফরওয়ার্ড করেছিলেন। তারপরে জানতে পারি উনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। ল্যাবের অন্য একজন সহকর্মীর কাছে জানতে পেরেছিলাম উনি নাকি ফিজিক্সে নোবেল পেতে পারেন।

আগ্রহ নিয়ে উনার ল্যাব ওয়েবসাইট, গুগল স্কলার ইত্যাদিতে ঢুঁকে উনাকে একটু পড়তে চেষ্টা করেছিলাম। জাপানের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টোকিও ইউনিভার্সিটিতে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন।

আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ভিসিটিং গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট ছিলেন। হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। তারপর থেকে তহকু ইউনিভার্সিটিতে ন্যানোইলেকট্রনিক্স ও স্পিনট্রোনিক্স ল্যাবের দায়িত্ব নিয়ে এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যা দেখলাম তাতে বুঝতে পারলাম উনি নিজ ফিল্ডে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকজন সেরা গবেষকের একজন।

গুগল স্কলারে উনার সর্বোচ্চ সাইটেড আর্টিকেলটি প্রায় ১০০০০ বার সাইট হয়েছে। বিশ্বসেরা অনেক গবেষকের টোটাল সাইটেশনও উনার মাত্র একটি আর্টিকেলের সাইটেশনের চেয়েও কম থাকে।

২০১৯ সালে বিশ্বের ২১৬ জন হাইলি সাইটেড রিসার্চারের মধ্যে উনি একজন ছিলেন। প্রেসিডেন্ট অবস্থাতেই গত বছরে উনার প্রায় ২০ টিরও বেশি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ সালে স্পিনট্রনিক্সে কাজের জন্য উনি নোবেলের জন্য পসিবল ক্যান্ডিডেট লিস্টে ছিলেন।

উনার বিল্ডিংয়ের সামনে অতিরিক্ত মানুষ বা গাড়ির আনাগোনা নেই। বের হয়ে যাওয়ার সময় ১০/২০ জনের চাটুকার গ্রুপের উপস্তিতিও থাকেনা।

উপরের বাস্তব গল্প বললাম দেশের উপাচার্য দের সাথে একটু তুলনামূলক বিবেচনা করার জন্য। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যত বড় পজিশনে তার একাডেমিক ক্যারিয়ার ততই নিচে। অতিরিক্ত রাজনীতি করে একাডেমিককে নষ্ট করে ফেলেছেন।

একবার দেশের কিছু উপাচার্যের রিসার্চগেট আর গুগল স্কলারের প্রোফাইল খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। ২/৩ জন ছাড়া বেশিরভাগেরই পাইনি।দেখাযায়, অনেক উপাচার্যের লাস্ট ভালো একটা আর্টিকেল ১০/১৫ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ দেশে বহু স্কলার গবেষক আছেন যাদেরকে এসব পদে দেয়া হয় না।

একজন উপাচার্যের নিজের ফিল্ডে দারুণ স্কলার হওয়া উচিত। নিজের একাডেমিক দক্ষতার প্রতি নিজের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা না থাকলে অন্যান্য সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য কখোনোই সে রোল মডেল হতে পারবেন না। উনাকে নিজেকে বাকিদের কাছে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। উনি গবেষক না হয়ে বাকিদের কোন লজ্জায় উনি গবেষনায় উতসাহ দেবেন?

একজন উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ জ্ঞ্যান থাকা উচিত। তার অধীনস্থ ডিন, পরিচালক বা বিভাগের হেড দের সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মত উনার জ্ঞ্যানের পরিধি থাকা উচিত।

তৃতীয়ত, একজন ইন্সপাইরিং লিডার হওয়া উচিত যার মাধ্যমে উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্টেকহোল্ডারদের (প্রফেসর-প্রভাষক থেকে মালি পর্যন্ত) কাছে সম্মানের সাথে সকল বিষয়াদি ডিল করতে পারেন। দৃঢ়তা নিয়ে কমান্ড করতে পারার যোগ্যতা থাকা উচিত। সবার কথা মন দিয়ে শোনার ও উপদেশ নেয়ার মত মানসিকতা থাকা উচিত।

একজন উপাচার্যের উনার নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সম্যক জ্ঞ্যান থাকা উচিত। ভালো সেন্স অফ হিউমার থাকা উচিত। বৈশ্বিক চিন্তা করে লোকালি ইম্পলিমেন্ট করার দক্ষতা থাকা উচিত।ধৈর্যশীল হওয়া উচিত। চালাক নয় বরং জ্ঞ্যানি হওয়া উচিত। সর্বশেষ, একজন ভালো মানুষ হওয়া উচিত।

আমরা র‍্যাংকিং নিয়ে কথা বলি অথচ র‍্যাংকিং এ ভালো করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ামকগুলো নিয়ে কথা বলিনা। উপাচার্য নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক। ভালো একাডেমিসিয়ানের সাথে উপরোক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের হাতে দায়িত্ব দিলে অবস্থার উন্নতি হবে বলে আমার বিশ্বাস।

এ দায়িত্ব পালন করতে হবে ইমানের সাথে। শিক্ষা ও গবেষনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হলে যোগ্য লোকের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভার থাকা আবশ্যক।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) ও পিএইচডি গবেষক তহকু ইউনিভার্সিটি, জাপান।

দ্রুতই শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করা উচিত

নাসির উদ্দীন: গতবছর মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের পর আলরেডি ১৪ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। মাঝখানে করোনার অবস্থা যথেষ্ট ভালো থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার ব্যাবস্থা নেয়া হয় নি। অনলাইন ক্লাস পরিক্ষা অবশ্যই অফলাইনের বেস্ট অলটারনেটিভ নয়, কিন্তু এর চেয়ে তো ভালো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।

প্রথমদিকে অলনাইনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করা সম্ভব না হলেও পরবর্তীতে অনেকেই অনলাইনে ক্লাস নিয়েছেন এবং এটিই এই প্যান্ডামিক সিচুয়েশনে অনেকাংশেই যৌক্তিক সমাধান। তবে এই ক্লাস পরিক্ষা নেয়ার জন্য জাতীয়ভাবে বা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নিজস্ব ভাবে নির্দিষ্ট রুলস তৈরি করতে না পারার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও শিক্ষকদের একাংশ অনলাইনে ক্লাসের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে ক্লাস নিতেও খুব বেশি আগ্রহ দেখান নি। আবার ক্লাস নিতে গিয়ে উপস্থিতি কম থাকার কারনে অনেক শিক্ষক ক্লাসে আগ্রহ পান নি। আবার শিক্ষকদের একাংশ যথেষ্ট গুরত্ব দিয়েই পড়িয়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের একটা অংশ অনলাইন ক্লাসের সুযোগকে ফাঁকি দেয়ার অপশন ভেবে গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে যার দরুন শিক্ষকদের আগ্রহ কমেছে।

অন্যদিকে আপদকালীন সময় বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিম কোম্পানি গুলোর সাথে কথা বলে সাশ্রয়ী রেটে ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেটের ব্যাবস্থা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। মোটাদাগে বলা যায় শিক্ষা নিয়ে কোনো পক্ষই যথেষ্ট আগ্রহী ছিলো না। যাইহোক তারপরেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যুথবদ্ধ চেষ্টায় অন্তত এক সেমিস্টারের ক্লাস সবারই হয়েছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, খাদ্য, বস্ত্রের মতই শিক্ষা আমাদের মৌলিক চাহিদা। করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যেমন জরুরি, শিক্ষার সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত রাখাও সমান জরুরি বলে মনে করি। আমার কাছে মনে হয়েছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা ছাত্রছাত্রীদের হতাশ করছে যার ফলে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।

এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও একটি সমাধান হয়েছিলো পরিক্ষা গুলো অফলাইনে নিয়ে নেয়া। সেটিও ভাল ভাবেই শুরু হয়েছিলো। একটি/দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা হল খুলে দেয়ার জন্য আন্দোলন করার জন্য সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার প্রধান স্টেক হোল্ডার এটি ভুলে গেলে চলবে না। তাদের জন্য শিক্ষকদের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের দায় আছে এটি এড়িয়ে গেলে হবে না। দ্রুতই একটি রূপরেখা তৈরি করে সেটির বাস্তবায়ন করা উচিত। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে এই মূহুর্তেই পরিক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। যেহেতু ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট আমাদের সাবকন্টিনেন্টে আঘাত হেনেছে সুতরাং আরও কিছুদিন ক্লাসগুলো অনলাইনেই চলুক। তবে অফলাইনে ল্যাব ক্লাস এবং পরিক্ষা শুরু হোক। এই পরিক্ষা নেয়ার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

১. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ একটি ব্যাচকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার অনুমতি দেবে। মাস্টার্স, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ এভাবে। এদের ল্যাব ক্লাস এবং পরিক্ষা অফলাইনে নেয়া শেষ হলে পরের ব্যাচ আসবে। একটি ব্যাচের ল্যাব ক্লাস ও পরিক্ষা নেয়ার জন্য এক মাস সময় বরাদ্দ থাকবে। তবে মাস্টার্স থিসিসের ছাত্রছাত্রীরা সবসময়ই তাদের গবেষণা চালিয়ে যাবে।

২. বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে ফ্রি মাস্ক, টেমপারেচার রিডার এবং ডিসইনফেক্টেড দ্রবণ থাকবে। টেমপারেচার ৩৭.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি হলে শিক্ষার্থী আইসোলেশনে চলে যাবে। কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থায় সহায়তা করবে।

৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া বহিরাগত কেউ প্রবেশ করবে না। ছাত্রছাত্রীরাও অহেতুক আড্ডা দেবেনা। তাদের ল্যাব ক্লাস বা পরিক্ষা শেষ হলে তারা নিজ হল বা মেসে চলে যাবে।

৪. হলে থাকা শিক্ষার্থীরা হলেই থাকবে। তবে যে ব্যাচের পরিক্ষা হবেনা তারা হলে থাকতে পারবে না। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ জিরো টলারেন্স নীতি ফলো করবে। অন্য ব্যাচের কেউ থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. অনলাইনে কুইজ/ওপেন বুক এক্সাম/এসাইনমেন্ট/এটেন্ডেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে কোর্সের অর্ধেক মার্কের ইভালুয়েশন করে নেয়া। বাকি অর্ধেক মার্কের কিছুটা শর্ট সিলেবাসে অফলাইনে এক্সাম হবে।

এভাবে শিক্ষা-কার্যক্রম আপাতত চালানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হয়ে একটি যৌক্তিক সমাধানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় রাখুক। তারা নিজেরা গ্রহনযোগ্য সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ইউজিসির চেয়ারম্যান, সদস্যদের সাথে আলাপ করুক। দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের অবশ্যই নিতে হবে। আপনারা অভিভাবকদের স্থানে থাকতে চাইলে দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মোদ্দা কথা, শিক্ষা-কার্যক্রম দ্রুতই শুরু করা হোক। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা মানসিক পীড়ন থেকে মুক্তি পাক। সবাই ভালো থাকুক।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) ও পিএইচডি গবেষক তহকু ইউনিভার্সিটি, জাপান।

কোভিড-১৯ এর সেকেন্ড ওয়েভ ও আনুষঙ্গিক কিছু কথা

 

ড. ফেরদৌসী বেগম:সারাবিশ্ব জুড়ে চলছে কোভিড-১৯ অতিমারীর সেকেন্ড ওয়েভ। বলে রাখা ভালো কোভিড-১৯ ই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রথম মহামারী নয়। আবার করোনা ভাইরাস ও মানুষের জন্য নতুন নয়। মানুষ ও অনেক প্রাণীদেহে এই ভাইরাস অনেক আগে থেকেই আছে। মানুষের শরীর জুড়ে আছে এমন মিলিয়ন মিলিয়ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া কিন্তু সবাই রোগ সৃষ্টি করে না।

কিছু আমাদের সুস্বাস্হ্য, হজম, মুড, ইমোশনসহ বিভিন্ন জৈবিক বিষয়গুলোকেও প্রভাবিত করে। শুধুৃমাত্র প্যাথোজেনিক অনুজীবগুলো নিয়েই সমস্যা। যেহেতু আমরা অণুজীব বেষ্টিত পৃথিবীতে থাকি যাদের জম্ম মানুষ সৃষ্টির আগে এবং সংখ্যায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে তাই এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।

প্রায় প্রতি একশত বছর পর পরই একটি করে বৈশ্বিক মহামারী ঘটছে। ১৫২০ সালে স্মল পক্স, ১৬২২ সালে প্লেগ (ইটালি), ১৭২০ সালে প্লেগ(ফ্রান্স), ১৮২০ কলেরা, ১৯১৮-২০ ইনফ্লুয়েন্জা। কোভিড -১৯ শুরু হয়েছিলো ২০১৯ এর ডিসেম্বরে চায়না থেকে । ২০২০ সাল জুড়েই চলেছে এর তান্ডব। আর এখন ২০২১ সালে চলছে সেকেন্ড ওয়েভ। সারা বিশ্বই এখন আতন্কিত। বিশ্বায়নের এই সময়ে কোন ভাবেই রোগটি এক জায়গায় স্হির থাকবেনা।

একদেশে সৃষ্ট একটি সংক্রমণশীল মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যা সেকন্ড ওয়েভ এর জন্য দায়ী এবং বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

কোভিড-১৯ মহামারীর এই সেকন্ড ওয়েভ এ করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন তৈরী হচ্ছে যা অধিক সংক্রমণশীল। সাধারনত প্যথোজেনের যে অংশটুকু রোগ সৃষ্টি করতে পারে তাকে এন্টিজেন বলে। এটি ইমিউনিটিকেও ইনডিউসড করতে পারে। করোনা ভাইরাসের এর ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন হলো এন্টিজেন। রোগ সৃষ্টিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতিকভাবে এ ভাইরাসে প্রতিনিয়ত মিউটেশন ঘটে এবং যদি একাধিক হোস্ট থাকে তাহলে এই মিউটেশন এর রেট আরো বেড়ে যায়।

মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসের এই স্পাইক প্রোটিন এর কেমিস্ট্রিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট তৈরী হয়। ২০১৯ থেকে এখন পর্যন্ত শুধু করোনা ভাইরাসের প্রায় চার হাজার ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হয়েছে এর মধ্যে চারটি ভ্যারিয়েন্ট খুব বেশি সংক্রমণশীল। এগুলো হলো ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.১.৭), সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট( পি ১) ও ক্যালিফোর্নিয়ান ভ্যারিয়েন্ট( বি ১.৪২৭ ওবি ১.৪২৯)। এদের সবারই স্পাইকে ঘ৫০১ণ নামে একটি কমন মিউটেশন ঘটেছে।

সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে ঊ ৪৮৪শ ও শ৪১৭ঘ নামে আরো দুটি মিউটেশন দেখা যায়। এদের সংক্রমনশীলতা মুল ভাইরাস এর চেয়ে ইউকে ধরনের ৩০-৫০%, সাউথ আফ্রিকান ধরনের ৫০% এবং ব্রাজিলিয়ান ধরনের ১৫০ গুন বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্হা বেশ নাজুক। ডাবল মিউটেন্ট আতন্ক কাটতে না কাটতেই ওখানে শুরু হয়ে গেছে ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমন। মহারাষ্ট্র, দিল্লী ও পশ্চিমবঙ্গে এর সংক্রমন সবচেয়ে বেশি। পশ্চিমবঙ্গকে এই ট্রিপল মিউটেন্ট এর উৎস ধরা হচ্ছে এই ধরনকে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট বলা হচ্ছে যার সংক্রমন ক্ষমতা ৩০০ গুণ বেশি।

বাংলাদেশের পরস্হিতি ও খুবই নাজুক। গত জানুয়ারীতে বি১.১.৭ নামক ইউকে এর নতুন ধরন সনাক্ত হয়। মার্চ পর্যন্ত ইউকে ধরনের প্রাধান্য ছিলো। এপ্রিলে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সাউথ আফ্রিকান ধরন। এছাড়া আরো একটি নতুন ধরন বি ১.৫২৫ সনাক্ত হয়েছে যেটি ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর ২৪ টি দেশে আছে । এর সাথে আরো যুক্ত হয়েছে ভারতের ট্রিপল মিউটেন্ট আতন্ক। তাই অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমান পরিস্হিত খুবই ঝুকিপূর্ন।ক্রমাগত মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্ট এর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রোগলক্ষণেও পরিবর্তন ঘটছে।

প্রথমবারের সংক্রমণে কমন লক্ষন জ্বর, হাঁচি, কাশি এসব প্রকাশ পেতে দশ বারো দিন সময় নিতো। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভের মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্টগুলো মারাত্মক সংক্রমণশীল। কমন লক্ষণগুলোর পরিবর্তে মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, অস্বাভাবিক আচরণ এসব দেখা যাচ্ছে। রুগীর ফুসফুস দ্রুত আক্রান্ত(৩০-৪০%) হতে দেখা যাচ্ছে। আবার ফলস রিপোর্ট ও পাওয়া যাচ্ছে। কারন এই মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্টগুলো খুব দ্রুত নাক থেকে ফুসফুসে চলে যাচ্ছে। ফলে নাকের সোয়াব নিলে রেজাল্ট নেগেটিভ আসছে কিন্তু রোগী আসলে করোনা পজেটিভ। ফলে রোগ সনাক্ত করতে জটিলতা বাড়ছে। টেস্ট রিপোর্ট আসার আগেই ৩-৫ দিনেই রোগীর ফুসফস ৫০% ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু হার বেড়ে যাচ্ছে। প্রথমবারে বয়স্ক মানুষ বেশী আক্রান্ত হলেও এবার কিন্তু তরুনদের আক্রান্তের হার বেড়েছে। ক্রমেই জটিল পরিস্হিতি তৈরী হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো এই নতুন মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টগুলো কেন বেশী সংক্রমনশীল? সাধারনভাবে একটি প্যাথোজেন বডিতে প্রবেশ করলে তার এন্টিজেন পোষকের একটি রিসেপ্টর সাইটের সাথে আবদ্ধ হয় এবং এই যুতবদ্ধতা খুবই সুনির্দিষ্ট। শুধুমাত্র একটি এন্টিজেন তার কমপ্লিমেন্টরী রিসেপ্টর সাইটের সাথেই আবদ্ধ হয়।

করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের কমপ্লিমেনটারী রিসেপ্টর হলো অঈঊ২ যা মানব কোষে থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে যে সংক্রমনশীল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টগুলোর স্পাইক প্রোটিনে(ঘ৫০১ণ) কমন পরিবরতন ঘটছে যেটির মানব কোষের রিসিপ্টর সাইটের সাথে আবদ্ধ হওয়ার সক্ষমতা অনেকগুন বেশি যা তাকে অধিক সংক্রমণশীল করছে। আবার সাউথ আফ্রিকান বা ব্রাজিলিয়ান ধরনের স্পাইক প্রোটিনে আরো দুটি মিউটেশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে যার কারনে মুল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে এন্টিবডি তৈরী হয়েছিলো সেগুলো ঠিকমতো যুক্ত হতে পারে না বা ভাইরাসটিকে নিস্ক্রয় করতে পার না। ফলে ইতিপূর্বে যারা আক্রান্ত হয়েছে তারাও আাবার আক্রান্ত হতে পারে। সাউথ আফ্রিকান ধরনটি ভ্যক্সিন বা ইতিপূর্বে আক্রান্ত ব্যাক্তির বডিতে তৈরী হওয়া এন্টিবডিকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম অর্থাৎ ইতিমধ্যে তৈরী হওয়া এন্টিবডি এদের উপর কাজ করতে পরছেনা না। যার ফলে এই ভ্যারিয়েন্ট গুলো মারাত্মক সংক্রমনশীল হয়ে উঠছে।

এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। প্রতিটি জীবের বা মানুষের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম বা ডিফেন্স মেকানিজম থাকে যা তাকে প্রাকৃতিকভাবে রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্হা দুই ধরনের। একটি জম্মের সাথে প্রাকৃতিকভাবেই লাভ করি আর একটি হলো সারাজীবন ধরে অর্জন করি। এর মধ্যে কিছু আছে আমারা খাদ্যাভাস বা লাইফস্টাইলের মাধ্যমে পাই।

কিছু আর্টিফিশিয়ালি ভ্যাক্সিন এর মাধ্যমে বডিতে দেওয়া হয় যাকে ইনডিউসড ইমমিউনিটি বলে। শরীরে ইমিউন সিস্টেম দুই ধরনের। একটি হলো হিউমোরাল যা রক্তের সিরামে অবস্হিত এন্টিবডির মাধ্যমে ঘটে আর একটি হলো সেলুলার প্রকৃতির যেখানে বিভিন্ন শ্বেত কনিকার কোষসমুহ জড়িত থাকে। কোন প্যাথোজেন বডিতে প্রবেশ করলে অটোমেটিক্যালি এই মেকানিজমগুলো কাজে করে।

শত্রু যদি চেনা থাকে বা বিপদটা কোথা থেকে আসছে সেটা যদি জানা থাকে তাহলে সিক্যুউরিটির ব্যবস্হা নেওয়া সহজ। এক্ষেত্রে নিজের শক্তিটুকু প্রয়োগ করবেন বা পুলিশকে জানাবেন। আর শত্রু অপরিচিত হলে কাবু করতে না পারলে ব্রাশফায়ার এর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বডিও তাই করে। প্যাথোজেন এর সুনির্দিষ্ট এন্টিজেন কোষের রিসিপ্টরে যুক্ত হলে বা কোষে প্রবেশ করলে তাকে লক করার জন্য বিটা-লিম্ফোসাইটিক কোষগুলো প্রচুর পরিমানে এন্টিবডি তৈরী করে। যদি চেনা কেস হয় তাহলে আরোও বেশি তৈরী করে এবং সেগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বডিতে মজুত থাকে। পরবর্তীতে সেম প্যাথোজেন আসলে তাকে লক করতে পারে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বডিতে নিস্ক্রিয় প্যাথোজেন বা এন্টিজেন দিয়ে দেওয়া হয়।

ফলাফলও একই রকম হয়। কিন্তু যখন প্যাথোজেন শক্তিশালী হয় তখন এন্টিবডি দিয়ে কাবু করতে পারে না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এন্টিবডি দিয়ে কাবু করার পর টি -লিম্ফোসাইটিক সেল বিভিন্ন রকম কমপোনেন্ট যেমন সাইটোকাইনিন সিক্রেট করে প্যাথোজেনকে মেরে ফেলে। যদি প্যাথোজেন অচেনা ও শক্তিশালী হয় তাহলে তাকে কাবু করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বা ব্রাশফায়ার এর মতো েঘটনা ঘটায়। করোনার ক্ষেত্রে আমরা এরকম ঘটনা দেখি। এক্ষেত্রে ইমিউনিটির সেল টি- লিম্ফোসাইট প্রচুর সাইটোকাইনিন তৈরী করে যাকে আমরা ‘সাইটোক্রম স্ট্রম’ বলি। যার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের শ্বাস অঙ্গ বা অন্যান্য অঙ্গগুলো দ্রুত ফেইলর হয় এবং সংগে সংগে যথাযথ সাপোর্টিভ চিকিৎসা না পেলে রোগী মারা যায়।

ভাইরাস ঘটিত রোগে ভ্যাক্সিনই হলো
একমাত্র প্রতিরোধ ব্যবস্হা। আমরা করোনা হলে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ খাই। এগুলো সব সাপোর্টিভ চিকিৎসা হিসেবে দেওয়া হয়। কিন্ত ভ্যাক্সিনই একমাত্র ব্যবস্হা যা দিয়ে আপনি ভবিষ্যতে এ রোগকে প্রতিহত করতে পারবেন বা সুরক্ষা দিতে পারবেন এর কোন বিকল্প নেই। অতিমারীর এ সময়টিতে যত দ্রুত বেশি মানুষকে ভ্যাক্সিনাইজড করা যাবে ততই মঙ্গল। অতীতে আমরা দেখেছি ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে গুটি বসম্ত, কলেরা, টাইফয়েড, যক্ষাসহ বহুরোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।

পোলিও, মাম্পস, রুবেলা এগুলোও নিয়ন্ত্রনের পথে। আমাদের জাতীয় টীকাদান কর্মসূচীও বেশ কার্যকরী ও ফলপ্রসূ। আমরা ভাগ্যবান যে সরকার বিনামূল্যে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম শুরু করেছেন। যারা এর আওতায় বা বয়সসীমার মধ্যে পড়েন প্রত্যেকের উচিত ভ্যাক্সিন নেওয়া। এই মুহুর্তে আ্যাস্ট্রেজেনিকার ভ্যাক্সিন দেওয়া হচ্ছে।

এটি সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট বা ট্রিপল মিউট্যান্ট বা অতি সাম্প্রতি সৃষ্ট সংক্রমণশীল মিউট্যান্ট গুলোর উপর খুব বেশি কার্যকর হবে না তারপরও দিতে হবে। এটি বডিকে অন্যান্য ধরন থেকে সুরক্ষা দিবে। এক ডোজ ভ্যাক্সিন নিলে এন্টিবডি তৈরী হতে দুই থেকে চার সপ্তাহ সময় নেয়। আবার এর কার্যক্ষমতা কতদিন পর্যন্ত হবে সেটাও জানা নেই। তিনমাস বা ছয়মাস হতে পারে যা আমাদেরকে অতিমারীর এই সময়টুকুকে পার করতে সহায়তা করবে। প্রয়োজনে আমরা আবার সেকেন্ড শট না বুস্টার ডোজ নিবো। তবুও ভ্যাক্সিন নিতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে এই অতিমারী অতিক্রম করতে হলে হারড ইমুউনিটি অর্জন করতে হবে। যেটি অর্জিত হবে যখন কোন এলাকার আশিভাগেরও অধিক মানুষের মধ্যে এই এন্টিবডি তৈরি হবে যা ভ্যাক্সিন ও প্রাকৃতিকভাবে করোনা সংক্রমনের মাধ্যমেই সম্ভব। শুধু ভ্যাকসিন নিলেই চলবে না স্বাস্হ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। তিনটি জিনিস অবশ্যই মানতে হবে মাস্ক পড়া, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করা এবং জনসমাগম ও জনাকীর্ন স্হান পরিহার করা। হয়তো আগামী চার পাঁচ বছর বা এই দশক আমাদের এগুলো মেনেই চলতে হবে।

তারপরও করোনা ভাইরাস কখনই পৃথিবী থেকে যাবে না। তবে সংক্রমনের এই তীব্রতা কমবে। মিউটেন্ট ভ্যারিয়েন্টগুলো কয়েক জেনারেশন কমপ্লিট করার পর আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসবে।ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে শতভাগ না হলেও এটি নিয়ন্ত্রিত হব্। সত্যিই বিশ্বাস করি গভীরভাবে বিশ্বাস করি এ পৃথিবী একদিন শান্ত হবে। কোভিত- ১৯ অতিমারী মুক্ত হবে। মানুষ তার আগের মতোই আবার নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে অভ্যস্ত হবে। সেদিন আসবেই আসতেই হবে।

লেখক– প্রফেসর ড. ফেরদৌসী বেগম, অণুজীববিদ, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

শহীদ বুদ্ধিজীবী হবিবুর রহমান

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা


১৫ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আরও একটি শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক প্রফেসর ড. হবিবুর রহমান পাকিস্তানী বর্বর সেনাদের হাতে নিহত হন। তিনি মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমানের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

হবিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২১ সালের ১লা জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মায়ের নাম সিদ্দীকা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হবিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়।

বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে বটগ্রামের কাছে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন হবিবুর রহমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সে সময় প ম শ্রেণিতে বৃত্তি পান। স্কুল জীবনে বৃত্তির টাকা এবং ছাত্র পড়িয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তিনি। নিজের অদম্য আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের জোরে হবিবুর রহমান অজপাড়াগাঁ থেকে উচ্চশিক্ষার শিখরে উঠতে পেরেছিলেন।

হবিবুর ১৯৩৮ সালে নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার ‘দত্তপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেই সময়ে পাঁচ বিষয়ে লেটার পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। এরপর হবিবুর ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে আই.এস-সি পাস করেন এবং একই বছর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে বি.এস-সি অনার্স শ্রেণিতে। তিনি ১৯৪৩ সালে অনার্স ডিগ্রি পান। এরপর তিনি এম.এস-সি শ্রেণিতে ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম.এস-সি ডিগ্রি পান।

হবিবুর রহমানের এই অসাধারণ ফলাফলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিত বিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের কাছে হবিবুর রহমানকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশ করে চিঠি দেন। ১৯৪৬ সালে হবিবুর রহমান প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি বদলি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এরপর তিনি বদলি হন ঢাকা কলেজে এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সেখানেই শিক্ষকতা করেন।

১৯৫৪ সালের নভেম্বরে হবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি পান। এরপর ১৯৫৮ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) পদে উন্নীত হন। ১৯৬২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ফলিত গণিতের বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ফিরে এসে ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। পরের বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন হবিবুর রহমান বিয়ে করেন ওয়াহিদা রহমানকে। কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির হবিবুর রহমান পারিবারিক জীবনে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্যরকম একজন মানুষ। গল্পগুজবে মাতিয়ে রাখতেন ছেলেমেয়েদের, কবিতা শেখাতে গিয়ে নিজেই কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, খেলার ছলে অঙ্ক শেখাতেন। সন্তানদের তিনি বলতেন, “জ্ঞান একটি প্রজ্বলিত শক্তি, যা আলোকিত করে নিজেকে এবং সমাজকে।”

সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও নিয়মনিষ্ঠার সমন্বয়ে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন হবিবুর রহমান। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হবিবুর রহমান। তাঁর সুপরিকল্পিত নির্দেশনাতেই ড. জোহার মৃত্যুর পর পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় আহত-নিহতদের খোঁজখবর নেওয়ার কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছিল।

বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বইগুলো হলো : স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য ‘যোগাশ্রয়ী বীজগণিত’, স্নাতক শ্রেণির জন্য ‘কলেজ বীজগণিত’, স্কুলের জন্য ‘নতুন বীজগণিত’ এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ‘পাটীগণিত’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির জন্য রচিত বই দুটি সেসময় অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ ও নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে : On Pell’s Equation’, ‘On Fermat’s Last Theorem’, ‘On Crisis of Civilization’ (1950), ‘On fundamental Human Rights’ (1969,‘নতুন শিক্ষানীতি’ (১৯৬৯) এবং ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ (১৯৭০)। শিক্ষা সংস্কারেও তিনি অত্যন্ত সাহসী ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিলেন।

প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার খবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতেই শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে চলে যেতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ে। তাঁর সহকর্মী, বন্ধু এবং পরিচিত অনেকে তাঁকে সে সময় অনুরোধ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে। কিন্তু সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে হবিবুর রহমান ক্যাম্পাসেই থেকে যান।

১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল বিকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে হবিবুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁর পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট এবং গলায় চাদর ছিল। অস্থায়ী সামরিক হেড কোয়ার্টার ‘বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি ভবনে’র ছাদের উপরে সামরিক অফিসারদের সামনে হাজির করা হয় হবিবুর রহমানকে। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত সেদিনই অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।

শহীদ হবিবুর রহমান ও স্ত্রী ওয়াহিদা রহমানের সংসারে দুই ছেলে ও চার মেয়ে। তাঁরা হলেন: মো. খায়রুল এনাম, আনিসুর রহমান, রোকসানা রাজ্জাক, শারমীন রহমান চৌধুরী, নাসরিন রহমান মোল্লা ও মোনালিসা হাসান। হবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ওয়াহিদা রহমান প্রচ- পরিশ্রম করে ছয় সন্তানকে মানুষ করেছেন। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু আর্থিক সহযোগিতা করেছে। ওয়াহিদা রহমান ২০০২ সালে মারা যান।

শহীদ হবিবুর রহমানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘শহীদ হবিবুর রহমান হল’। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে।

লেখকঃ উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা


১৪ এপ্রিল বা পহেলা বৈশাখ বাঙালির কাছে সর্বজনীন একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নববর্ষের এই দিনে অনেকে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা কাপড় পরিধান করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ১লা বৈশাখ ভীষণ আনন্দে ভরপুর একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সরকারও চাকুরীজীবীদের নববর্ষ ভাতা দিয়ে থাকেন।

কিন্তু ১৯৭১ সালে সারাদেশের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দিনটিতে নেমে আসে এক অন্ধকার সময়। এদিনে আমরা আমাদের একজন প্রিয় সহকর্মীকে হারাই। তিনি হচ্ছেন ভাষা বিভাগের (বর্তমানে সংস্কৃত বিভাগ) শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার।

সুখরঞ্জন সমাদ্দারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি, বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার, মায়ের নাম প্রফুল্লবালা সমাদ্দার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সুখরঞ্জন ছিলেন সবার বড়। কার্তিকচন্দ্র সমাদ্দার ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ও খ্যাতিমান অধ্যাপক।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুখরঞ্জন সমাদ্দারের খ্যাতি ছিল। স্থানীয় বাইশারী স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৪ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ (বি. এম. কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাস করেন। বাবা কার্তিকচন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনার্স কোর্স ছিল দুই বছরের। ১৯৫৮ সালে সুখরঞ্জন সমাদ্দার কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিষয়ে ১৯৬০ সালে এম.এ. পাশ করেন।

অনার্স পাসের পর সুখরঞ্জন প্রথমে কিছুদিন গোপালগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতচর্চা করতেন।

১৯৬৩ সালে তিনি চম্পা সমাদ্দারের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁদের। একাত্তরের ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাড়ার ৭১/বি নম্বর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের জুবেরী ভবন তখন মিনি ক্যান্টনমেন্ট। সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে প্রথমে জুবেরী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেনারা তাঁকে হত্যা করে বিনোদপুরের এক দিঘির পাড়ে ফেলে রাখে।

অসহায় চম্পা সমাদ্দার ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসেনের কাছে তাঁর স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে। ড. সাজ্জাদ হোসেন তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। নানা জায়গায় ছুটাছুটি করে চম্পা সমাদ্দার স্বামীর প্রকৃত অবস্থান জানার চেষ্টা করেন, কিন্তু খবর মেলেনি। তবুও তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন। জুলাইয়ের গোড়ার দিকে চম্পা সমাদ্দারের সমস্ত আশা-ভরসার করুণ পরিণতি ঘটে। একজন প্রতিবেশী সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্যান্ডেল, ভাঙা চশমা চম্পা সমাদ্দারের হাতে স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে পৌঁছে দেন। চম্পা সমাদ্দার নিশ্চিত হন, তাঁর স্বামী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।

এ ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন : “১৩ই এপ্রিল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি ই.পি.আর সেনা (মুক্তিযোদ্ধা) অন্ধকারে চুপি চুপি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার পেছনে এসে পানি চাচ্ছিল। আমার স্বামী তাঁকে নিজ হাতে পানি খাওয়ান। ওই ই.পি.আর সেনাকে আশ্রয় দিলে বিপদ হতে পারে জেনেও তাঁকে আশ্রয় দেন। তাঁর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার স্বামী নিজ হাতে সে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে সারা রাত তাঁর সেবা করেন। রাত ৪ টার পর ওই যোদ্ধা চলে যান।

পরদিন ১৪ই এপ্রিল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯ টার দিকে হানাদার সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন অবাঙালি চেয়ারম্যান সৈয়দ মতিউর রহমানের ইঙ্গিতেই আমার স্বামী গ্রেফতার হন। উর্দু ভাষায় “ইনি হিন্দু” বলে স্বামীকে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

হানাদার বাহিনীর ঘাতকেরা তাঁকে সেদিনই নির্মমভাবে হত্যা করে বিনোদপুরে ফেলে রেখে যায়। এটা তখন আমি জানতাম না। পরে জেনেছি। আমাদের বাসায় প্রতিদিন দুধ দিতেন এক ঘোষ। তিনি বিনোদপুরে এক দিঘির পাড়ে আমার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি আমার স্বামীর মৃতদেহ তাঁর কাজলার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠোনে মাটিচাপা দিয়ে রাখেন। তিনি সেদিনই পরিবারসহ ভারতে চলে যান। ফলে আমাকে খবর দিতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে তিনি ঘটনাটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁর দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে শহীদের মর্যাদায় পুনঃসমাহিত করে”।

সুখরঞ্জন সমাদ্দারের চাকরির মেয়াদ ১০ বছর পূর্ণ না হওয়ায় চম্পা সমাদ্দার তাঁর স্বামীর পেনশন বা এককালীন কোনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। এমনকি সরকারি কোনো অনুদানও পাননি তিনি। চম্পা সমাদ্দার ম্যাট্রিক পাস ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ মিসেস সমাদ্দারকে পড়াশোনা করতে অনুপ্রেরণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ৯০০ টাকা করে ভাতা বরাদ্দ করে। এভাবেই চম্পা সমাদ্দার এম.এ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে সহকারী হাউস টিউটর হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করে অবসর নেন।

শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের একমাত্র ছেলে সলিল রঞ্জন সমাদ্দার পেশায় চিকিৎসক। বাবার আদর্শের ন্যায় তিনিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপিত। দুই মেয়ে মল্লিকা সমাদ্দার ও সুস্মিতা সমাদ্দার কলেজ ও স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাবার মতো তারাও সঙ্গীত চর্চা করেন।

লেখকঃ উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ

মোঃ রিয়াজ উদ্দীন রেজা


ছাত্র রাজনীতি হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিয়োজিত, অধিকার আদায়ে সোচ্চার, ইতিবাচক সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থেকে সর্বদা হীনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী, শিক্ষাঙ্গনে দূর্নীতি অনিয়ম প্রতিরোধে অকুতোভয়, ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নীতিবান আর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির বাতিঘর বা কারখানা।

যদিওবা বর্তমানে চর্চিত ছাত্র রাজনীতির ধারা ভিন্ন। তবুও এদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির বর্ণাঢ্য অতীত রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা দাবি আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীকার আদায়ে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে দেশ রক্ষার আন্দোলনে এদেশের ছাত্র সমাজ তথা ছাত্র রাজনৈতিকবৃন্দ উল্ল্যেখযোগ্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অতএব একথা বলা যায়, অতীতের ছাত্র রাজনীতি ছিল দেশের স্বার্থ নির্ভর, দেশের কল্যাণ নির্ভর, আদর্শ এবং নীতি নির্ভর।

কিন্তু বর্তমানে এমন আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার ক্ষুদ্র অনুপস্থিতি তথা ব্যত্যয় এর অন্যতম কারণ ক্ষমতার মোহে শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিতে আগমন। এছাড়া নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ও নানাবিধ অরাজকতা বৃদ্ধির সাথে যুক্তিযুক্ত।

যদিওবা চলমান ছাত্র রাজনীতির অশুভ ধারা সুশীল সমাজের কিছু সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের দৃষ্টান্ত স্বরূপ। তবুও বলাবাহুল্য নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ এগুলো ফাঁকা বুলিতে পরিণত হওয়ায় দিনদিন কতিপয় অসামঞ্জস্যতাগুলো সামগ্রিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে।

এমন নয় যে, একজন শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি করলে তাকে পরবর্তীতে রাজনীতিটাই করে যেতে হবে কিংবা তাকে রাজনৈতিক নেতা হতে হবে। রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও একজন ব্যক্তি দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাস্তবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী সম্পন্ন একটি শ্রেণী গড়ে ওঠে।

এই নেতৃত্বের গুণাবলীর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পরবর্তীতে শিক্ষকতায়, চিকিৎসায়, সাংবাদিকতায়,ব্যবসায়, বিচার বিভাগে, প্রশাসনসহ রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে তথা দেশ গঠনে এবং কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা জানি প্রতিটি পেশায় সফলতার জন্য ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব গুণ অতীব জরুরি।

ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে এই ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব গুণের বিকাশ ঘটে থাকে। আবার ব্যক্তিজীবনে, পেশাগত জীবনে সর্বোপরি জাতীয় জীবনে একজন মানুষের জন্যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই সব থেকে বড় গুণ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এটা সৃষ্টি হয়ে থাকে নেতৃত্বের ট্রেনিং মাধ্যমে। আর এই ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।

আমরা জানি,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটি এবং এসএমই খাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য।

এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। এসব সম্ভব হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিচক্ষণ, দূর্দান্ত, দুরাদর্শি , ডায়নামিক নেতৃত্বের ফলে। আর এসবের নেপথ্যেও রয়েছে কিন্তু ছাত্র রাজনীতি। তিনি ছাত্র রাজনীতির ‘প্রডাক্ট’।

তিনি যে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, সেটারও কারণ ছোটবেলা থেকে ছাত্র রাজনীতি তাঁকে নেতৃত্ব শিখিয়েছে। একমাত্র নেতৃত্বের গুণাবলীই মানুষকে অসম্ভব থেকে সম্ভবের দিকে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে থাকে।

এটা স্বীকার্য সত্য,প্রজম্মের কাজ ওই প্রজম্মকেই করতে হয়। তাই শুধুমাত্র সাময়িক প্রাপ্তিকে বড় মনে না করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ স্বার্থ নির্ভর ছাত্ররাজনীতি চর্চার সুষ্ঠু ধারা আমাদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।

বর্তমান প্রজম্মকে ভাবতে হবে, আমাদের পূর্বসূরিরা যদি নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, সামরিক স্বৈরাচার দূর করতে পারে, তাহলে আমরা কেন একটি ভালো ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারব না।

বর্তমানের তরুণরা যদি এ কাজ না করে তাহলে ভবিষ্যতে আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নেতৃত্বে শূন্যতা নেমে আসবে। নানা ধরনের মৌলবাদী বা পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী ওই সুযোগে রাষ্ট্র দখল করবে।আধুনিক বাংলাদেশ রক্ষা করতে হলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি তরুণ প্রজম্মকে করতেই হবে।

আর সেজন্য ছাত্র রাজনীতিকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা তৈরির কারখানার কালচার থেকে বেরিয়ে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নেতৃত্বের ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে দেশ গঠনের কারিগর বিনির্মাণে মনোযোগ দিতে হবে।

দেশের প্রতিটি সেক্টরে যদি দক্ষ নেতৃত্বের পুনর্বাসন করা যায়, তাহলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। সেলক্ষ্যে ক্ষমতার মোহ নির্ভর মরীচিকার ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে মেধা ভিত্তিক আদর্শ ও নীতি নির্ভর ছাত্র রাজনীতি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।

তাই ছাত্র রাজনীতিকে আরো বেশি শিক্ষার্থী বান্ধব, আরো বেশি মানবিক, আরো বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক তথা শিক্ষার মান উন্নয়ন কেন্দ্রিক করতে হবে। এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে নেতৃত্বের ট্রেনিং এর জন্য নানাবিধ কর্মসূচি, কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ – ই একমাত্র ছাত্র সংগঠন যে সংগঠনের নেতাকর্মীরা ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলন, লড়াই – সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।

দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগেরই ১৭ হাজার নেতাকর্মী শহীদ হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেটা ইতিহাস বিবেচনায় আসলেই বিরল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগকে নিয়ে বলেছিলেন, “ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস”।

তিনি যথার্থই বলেছিলেন। আমি মনে করি, একুশ শতকের চলমান রাজনীতির বিপরীতে ছাত্র রাজনীতিকে নার্সিং করে সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং সাফল্য অর্জন করার কৃতিত্ব একমাত্র ছাত্রলীগের রয়েছে। ছাত্রলীগ যেমন অতীতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গৌরবের সাথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, তেমনি চলমান ছাত্র রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত করার সাংগঠনিক সক্ষমতা একমাত্র ছাত্রলীগই রাখে।

একটি উন্নত নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন, সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতি চর্চা নির্ভর, নীতি ও আদর্শ কেন্দ্রিক রাজনীতি নির্ভর উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশের প্রত্যাশায়।

লেখক

মোঃ রিয়াজ উদ্দীন রেজা

কর্মী, যশোর জেলা ছাত্রলীগ।

“একুশ বাঁধে বাংলা,বাংলা রাঁধে একুশ”

আবুবকর সিদ্দিক শিবলি


আপনি ইংরেজি সাহিত্য,ইংরেজি কিংবা বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জানেন তো ঠিকমত? যদি না জানেন তবে কিন্তু আপনি বুদ্ধিমান কিংবা সুদর্শন নন,আপনার জ্ঞান পরিমন্ডল বিস্তৃত নয়।

আপনি জানেন বা না জানেন তবে আপনাকে জানতেই হবে,লোকমুখে জ্ঞানী হতে চাইলে।কেননা,আমাদের কাছে জ্ঞান মানেই অজানাকে জানা,নিজের কাছে নতুন রূপে নিজেকে জানা নয়।

মাতৃভাষা,শব্দটা শুনলেই প্রথম মন অগোচরে যেই অনুভূতির উদ্রেক হয় সেটা একান্তই প্রিয়। নিজের ভাষা,মনের ভাষা,ইচ্ছেখুশি আবেগ উদগীরণের ভাষা।

কিন্তু বর্তমান? তাতে বিশ্বাসী নয়। আপনাকে জানতে হলে,জ্ঞানী হতে হলে কিংবা লোকমুখে বুদ্ধিমান হতে হলে অবশ্যই পরিশুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি গুটিকয়েক ইংরেজি শব্দ কথাচ্ছলে যোগ করতে হবে,আঞ্চলিক তো ভুলেও নয়।

আমরা সামান্য(শতাংশ শূন্যের কাছাকাছি) আধুনিক হতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বকীয়তা হারাচ্ছি। যতটা না হচ্ছি জ্ঞানী,তার থেকেও দ্বিগুণ পরিমাণে হচ্ছি হযবরল ভাষাবিজ্ঞানী।

আমাদের যাবতকালের বাংলা সাহিত্যিক? নির্বোধ আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়,তারা বোধহয় বাংলার মাঝে ইংরেজি ভাষার বাণিজ্য করছে। নয়তো কেন তারা এতো শ্রুতিমধুর বাংলা ভাষা রেখে আমার মতো মূর্খ পাঠকদের ইংরেজির বেড়াকলে ফেলে হয়রান করছে?

এই যে আপনাকেই বলছি,আপনার বাড়িতে ইংরেজি অভিধান আছে তো নাকি? বাংলা থাকুক বা না থাকুক চলবে,তবে ইংরেজি থাকতেই হবে। কারণ আমরা ইংরেজি পড়ি খুঁজে বুঝে।আর বাংলা,পারি বলে অধমের মতো না বুঝে।

একুশ এসেছে বাংলা হয়ে
লোক সমুচ্চরণে বলে কয়ে
দ্বিধা,ঘাত,সংঘাত ভুলে
রক্ত দিয়েছে মাতৃভাষা দখলে
বাংলাপ্রেমী উদ্যমী জাগ্রত জনতাবল
যাদের বিনিময়ে করছি মুখবদল।
তাই আজি তাদের প্রতি
রক্তিম সম্মানে জানাই ফুলেল ভালোবাসা নিরঙ্কুশ
আর বলি একাত্ব একাচ্চরণে
একুশ বাঁধে বাংলা,বাংলা রাঁধে একুশ।

লেখক
আবুবকর সিদ্দিক শিবলি
শিক্ষার্থী,
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।