করোনা ভাইরাস

আনন্দ কুমার সাহা


২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে মহামারি হিসেবে নতুন আবির্ভূত সার্স কোভ-২ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্টরোগ কোভিড-১৯ নামে পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১১ই মার্চ ব্যাধিটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


করোনা ভাইরাস: মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে DNA এবং RNA থাকে। কিন্তু ভাইরাসের মধ্যে DNA অথবা RNA থাকে। করোনা ভাইরাস হচ্ছে RNA ভাইরাস। ২০১৯ সালে আবির্ভূত ‘সার্স-কোভ-২’ হচ্ছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর করোনাভাইরাস। সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো হচ্ছে- জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও খুসখুসে কাশি। বয়স্ক ব্যক্তিরা বা যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের সার্স-কোভ-২ দ্বারা মারাত্মক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।


তিন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বর্তমানে লক্ষ করা যায়, যেমন- SARS-COV (Severe acute respiratory Syndrome Coronavirus), MERS-COV (Middle East Respiratory Syndrome- Coronavirus), SARS-COV-2 (Severe acute respiratory Syndrome Coronavirus-2).


লক্ষণ কি?: সার্স কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও খুসখুসে শুষ্ককাশি। সর্দি, গলাব্যথা, নাক কনজেশন, শরীরে ব্যথা এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়। কেউ কেউ নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ যাদের আছে, সেই ধরনের ব্যক্তিরা ঝুঁকিতে থাকেন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা ১৪দিন পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

কিভাবে সংক্রমিত হয়: যখন কেউ সাধারণ ফ্লুতে আক্রান্ত হয় অনেকেই একটু দূরত্ব রেখে চলাচল করে। কারণ ফ্লু ছোঁয়াচে। এক গবেষণায় দেখা গেছে একটি হাঁচির মাধ্যমে ১৬,০০০ ভাইরাস শরীর থেকে বের হয়- যার কিছু অংশ মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ফ্লু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কারণে হ্যান্ডসেক, কোলাকুলি, পাশে বসে নামাজ পড়া, ট্রেনে-বাসে যাতায়াত না করা বাঞ্চনীয়। স্প্যানিশ ফ্লু-র সময় কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলো।

আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির তরল ড্রপলেটগুলোই করোনাভাইরাসের মূল বাহক। এই ড্রপলেটে প্রায় ৭০লক্ষ করোনা ভাইরাস থাকতে পারে বলে গবেষকরা মতামত দিয়েছেন। এই তরল ড্রপলেট রোদের প্রচণ্ড তাপে শুকিয়ে যায়, ফলে ভাইরাস বিস্তার লাভ করে না। ৩১শে মার্চ ২০২০ WHO-র মতামত সামাজিক শিষ্টাচার, দৈহিক দূরত্ব বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব।

রোগ প্রতিরোধ: দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া ও রান্নার বৈশিষ্ট্যের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের একটু বেশী। আমরা খাওয়ার সময় যে পরিমাণ ঝাল খাই- ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। আমাদের প্রত্যেকের বাসায় ওয়াশিং মেশিন বা ডিস্ক ক্লিনার নেই। হুইল সাবান দিয়ে কিংবা ছাঁই দিয়ে বাসন পরিস্কার করি। সাবান বা পাউডার দিয়ে জামা-কাপড় কাঁচি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা হাত পরিস্কার রাখি।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হাতে ভাইরাস টিকে থাকতে পারে না। নামাজের পূর্বে ওজু করা- এটাও এক ধরনের ভাইরাস মুক্ত থাকা। যারা পূজাচর্চা করেন- সকালে স্নান করে পূজা দেন। এগুলো কাজে করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকা যায়। শ্রমজীবী মানুষ বা কৃষক সম্প্রদায় রোদের মধ্যে যেভাবে কাজ করেন- স্বাভাবিকভাবে তাদের করোনা ভাইরাস কিংবা অন্যান্য জীবানু প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী।

উষ্ণ আবহাওয়া: উষ্ণ আবহাওয়া ভাইরাসটির গতি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। প্রত্যেক মাইক্রোঅর্গানিজম একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং pH-তে দ্রুত বংশ বিস্তার করে। যেমন ঊ ঈড়ষর ব্যাকটেরিয়া ৩৭°C এবং pH ৭.২-তে ভাল বর্ধন করে। তেমনি গাছের নাইট্রোজেন আহরণের জন্য Rhizobium 28°C এবং ৬.৮ pH বংশ বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গবেষকদের মতে ৩২°C উপরে করোনা ভাইরাস দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ৩৬-৩৯°C, যা করোনা ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক নয়। অনেকে প্রশ্ন করেন মানুষের শরীরের মধ্যে তাপমাত্রা ৩৭°C।

এটা সত্য যে, একবার পরিমাণ মত ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক তাপমাত্রা অধিক হওয়ার কারণে শরীরে প্রবেশ করবার পূর্বে ভাইরাস অনেকটাই টিকে থাকতে পারে না। এটা কিছুটা অনুমান ভিত্তিক ধারণা। পুরোপুরি গবেষণা না করলে সঠিক বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা এ মুহূর্তে আমাদের জন্য আশীর্বাদ এটা মনে করতে পারি।

SARS-COV ভাইরাস ২০০২-২০০৩ সালে চীনের গুয়াডাং প্রদেশে ও MERS-COV
২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছিল। ২০০২-২০০৩ সালের সার্স কোভ ভাইরাসের চেয়ে COV- 2 ভাইরাসের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন বেশী শক্তিশালী। এই শক্তিশালী হওয়ার কারণে ভাইরাসটি শ্বাস-প্রশ্বাস নালীর সঙ্গে ভালভাবে জড়িয়ে যায়। ড্রাগস কিংবা ভ্যাকসিন বাজারে আসার পূর্বে আমাদেরকে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সোসাল ডিসট্যান্স বা লক ডাউন করা ছাড়া আপাতত অন্য উপায় নেই।

১৯১৮-১৯ সালে যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে মহামারি ধারণ করেছিল তখনও কিন্তু এই নিয়ম মেনে চলতে হতো। আমেরিকা ১৯৪০ সালে এশিয়ান ফ্লু-র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বাজারজাত করে। খুশির খবর চীন ইতোমধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছে SARS-COV-2 বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার ব্যাপারে। আশাকরি অতি শীঘ্রই ভ্যাকসিন বাজারে আসবে এবং আমরা মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাবো।

আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যাঁরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন: ডাক্তার, নার্স, প্রশাসন বিশেষ করে সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, জনপ্রতিনিধি, সামরিক বাহিনী, পুলিশ-র‍্যাব, সাংবাদিক, নিরাপত্তা প্রহরীসহ পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। এই দুর্যোগের মধ্যে তাঁরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। জয় বাংলা।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *