বেকারত্ব অভিশাপ নয়, উদ্যোক্তা হয়ে উঠুন


মো: সোহেল রানা


দেশ আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকও আমাদের। দেশের নাগরিক কিভাবে জীবনযাপন করছে সেটা দেখার দায়িত্বও আমাদের। এখানে আমাদের বলতে ব্যক্তি ও সরকার। প্রতিটি ব্যক্তির একটি নিজস্ব গতিধারা থাকে।

তেমনই রাষ্ট্রেরও তার নিজস্ব গতিধারায় দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করে যাবে। আধুনিক যুগের নাগরিক চায় নিরাপত্তা ও মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা। কিন্তু সংখ্যা যখন কম থাকে তখন পরিকল্পনা করা সহজ হয়, সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তা কঠিন হয়ে পরে।

ক্রমশ আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে ৷ মৌলিক দায়িত্ব পালনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। উন্নত খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিটি নাগরিকের কাম্য। ফুটপাত থেকে শুরু করে অট্টালিকায় বসবাসকারী সকল ধরনের নাগরিক আমাদের দেশে আছে। এটা মূলত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ফসল। কিন্তু প্রতিটি নাগরিকের নূন্যতম মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করলে আধুনিক যুগের বড় ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে।

জনগনকে উপযুক্ত রুপে জনশক্তি হিসেবে ব্যবহার করাই কাম্য। যেমন, আমাদের দেশে অনেক ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা শেষ করে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বেকারই থেকে যায়। আবার যারা চাকরির জন্য চেষ্টা করছে তারা সকলেই যে চাকরি পাবে এমনটা নয়।

তাহলে ফলাফল দাঁড়ালো কিছু তরুণ দীর্ঘদিন বেকার থেকে কর্মহীন হয়ে পড়লো ৷ কিন্তু এই পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন চেষ্টা করে ফলাফল শূণ্য হওয়ার চেষ্টা না করে নিজে স্বল্প পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করলে এই মুল্যবান সময় নষ্ট হত না। দেশ ও দেশের জনগনের জন্য মঙ্গলজনক হতো।

তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণকে উপযুক্ত রুপে জনশক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে৷ এটা না হলে জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যেই কর্মসংস্থানের অভাব তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ধীরে ধীরে চাকরি প্রবল হয়ে উঠছে। কিন্তু চাকরি প্রাপ্তির সংখ্যা অপেক্ষা চাকরি প্রত্যাশির সংখ্যা অনেক বেশি। তাই নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। না হলে একটি বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর তথ্য মতে, “২০১০ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ, ২০১২ সালে ২৪ লক্ষ, ২০১৬ সালে ২৬ লক্ষ”। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যমতে, “বর্তমানে বাংলাদেশে বেকার আছে ৩০ লক্ষ এর বেশি “। বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না করলে বেকারের হার বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

আইএলও(ILO) এর মতে,” বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১২ তম। বিশ্ব পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে মোট বেকারত্বের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা সব থেকে বেশি। ডিগ্রী লাভ করার পর মানসম্মত চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বেকারই থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে পাবলিক, প্রাইভেট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি।

লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স তথ্যমতে,” শিক্ষিত বেকারের হার সব থেকে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার”। এই পরিসংখ্যান বেকারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। আধুনিক যুগে লেখাপড়া শেষ করে সকলের ইচ্ছা থাকে একটি মানসম্মত চাকরি করবে। নিজের সম্মান বৃদ্ধি করবে। সম্মানের সাথে সাথে মানসম্মত বেতন ও আশা করে।

অর্থনীতিবিদ ড.জায়েদ বখত বলেন, “শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির সমন্বয় না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে “। একটি দেশের তরুণ সমাজকে দেশের ভবিষ্যৎ বলে ধরা হয়। আর সেই তরুণ সমাজকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাওয়া পাওয়া পর্যবেক্ষণ করে তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব। তরণের ইতিবাচক চিন্তাধারা ধরে রাখতে হবে৷

বর্তমানে বেশিরভাগ তরুণী বিনোদন প্রিয় হয়ে পড়ছে। অনলাইন আসক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে যেমন, ফেসবুক, টিকটক, ফানি পোস্ট, লাইকি, ইউটিউব, অনলাইন গেইম ইত্যাদি। একজন বুদ্ধিজীবীর মূল্যবান কথার চেয়ে মূল্যহীন বিষয়ে বেশি আকর্ষিত হয়ে পড়ছে। যা কিনা তাদের একটি নিম্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। গুণীজনের কদর না করলে গুণীজন শূন্য দেশে পরিণত হবে দেশ । তাই দেশকে রক্ষা করার জন্য তরুণ সমাজকে প্রথমে রক্ষা করতে হবে।

তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনর করার জন্য দেশের স্বার্থে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তরুণ সমাজকে দক্ষ কর্মঠ নাগরিকে পরিণত করতে হবে। তরুণদের নিয়ে কর্মসংস্থান মূলক সেমিনার করা ও পরিকল্পনায় আওতায় এনে সুনিদিষ্ট পন্থায় আগাতে হবে।

অদক্ষ জনগণই দেশের বোঝা হয়। দক্ষ জনশক্তি দেশের মঙ্গল বয়ে আনে। তাই জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রতিটি জনগণ দেশের স্বার্থে অবদান রাখতে পারে সেই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। চাকরির পাশাপাশি তরুণ সমাজকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ প্রদান করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। কারণ জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই হারে কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব নয়; এটাই সত্য! তাই তরুণ সমাজকে উদ্যোক্তা হয়ে নিজ নিজ কর্মসংস্থান নিজেই তৈরি করে নিতে হবে। এবং অন্যকে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

বর্তমান করোনা মহামারীতে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে তারা হতাশাগ্রস্ত জীবন যাপন করছে। অনেক গার্মেন্টস, কলকারখানা, শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হলে অবশ্যই তাঁদের চাকরির বিকল্প পথ বের করতে হবে। আর সেই বিকল্প পথ হলো উদ্যোক্তা হয়ে উঠা। উদ্যোক্তা হলে নিজেই নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে।

দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচবে। বর্তমানে এটাই উপযুক্ত পন্থা। বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। তার মধ্যে কিছু লাভ উদ্যোগ হলো হাঁসের খামার, মুরগির খামার, গরুর খামার, নার্সারি করা, মাশরুম চাষ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে নিজ নিজ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।

যা সহজেই তারা স্বনির্ভর হতে পারে।খামারের পরিধি বৃদ্ধি পেলে অন্যের কর্মসংস্থানও তৈরি করতে পারবে। এগুলোর পাশাপাশি কুটিরশিল্প, হস্তশিল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে। যার চাহিদা দেশ বিদেশে অনেক।

বর্তমানে অনলাইন ব্যবসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক অস্বচ্ছল ছাত্রছাত্রী,গৃহবধূ, পঙ্গু জীবন অতিবাহিত কারি অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করেছেন। যা সকল স্থরের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। যে কোনো খামার বা উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য নূন্যতম কিছু মূলধনের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মূলধনের অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হতে পারে না।

সরকারকে এ দিকে লক্ষ্য রেখে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দিতে স্বল্প সুদে বা সুদহীন ঋণ দিয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে এবং এক্ষেত্রে সরকারকে ও সহজলভ্য ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাহলে তরুণ সমাজ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তাঁদের সুদিন ফিরবে এবং দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারবে। দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। জিডিপিতে অবদান রাখতে পারবে। শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি কর্মহীন থাকবে না।

সুতরাং, সকল স্থরের মানুষকে স্বনির্ভর করার মাধ্যমেই দেশ ও দেশের জনগণের মঙ্গল নিহিত রয়েছে ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া৷

ইভটিজিং নারী জীবনে অভিশাপ

মুহম্মদ সজীব প্রধান


বিশ্বজুড়ে ১৩ জুন ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবসে আমরা ইভটিজিং কতটা প্রতিরোধ করতে পেরেছি সেখানেই রয়ে যায় বড় একটি প্রশ্ন।ইভটিজিং প্রতিরোধে আমাদের অক্ষমতা দেখে মনে হয় ইভটিজিং করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের চেয়েও কঠিন কাজ।

ইভটিজিং নারী জীবনে একটি ভয়ানক অধ্যায় যা নারীকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং নারীর স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করে। ইভটিজিং এর ভয়াল থাবায় মেয়েশিশু, কিশোরী ও তরুণীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেননা, স্কুল, কলেজে আসা-যাওয়ার পথে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ইভটিজিং এর স্বীকার হন। এমনকি অনেক মেয়ে জীবন ও সম্মানের হুমকিতে পড়েন যা তাদের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করে। বর্তমান সমাজে ধর্ষকরা যে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে তার সূত্রপাতও ঘটে এই ইভটিজিং থেকে।

এছাড়াও, তরুণীরা বখাটেদের প্রস্তাব না মানলে তাদেরকে এসিড নিক্ষেপ সহ হত্যাও করা হয়। সাম্প্রতিক কালে ইভটিজিং সমস্যার হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত ও অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা বহু কিশোরী ও তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় আর এমন দৃষ্টান্ত অহরহ। এমতাবস্থায় অধিকাংশ মেয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এমনকি বাবা-মাও মেয়েদের সুরক্ষার জন্য পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের বাল্য বিবাহ দেন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাড়তি বয়সি এসব মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।

প্রকৃতপক্ষে, শহর, উপশহর, গ্রাম-গঞ্জে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলছে ইভটিজিং আর এর পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে- পারিবারিক ও সামাজিক ধ্বজভঙ্গ অবকাঠামো, সামাজিকভাবে মেয়েদের ছোট করে দেখা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের অসচেতনতা, আইনের যথাযথ শাসন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধীকতা, পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ করা, মেয়েদের উগ্র পোশাক পরে অবাধ চলাফেরা, স্যাটেলাইট টিভিতে অসামাজিক প্রদর্শনী এবং সমাজে সর্বোপরি সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাব।

কিন্তু ইভটিজিং নামক সামাজিক ক্যান্সারকে প্রতিহত করতে আমাদেরকে অবশ্যই এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোতে আনতে হবে ব্যাপক পরিবর্তন যেখানে মেয়েশিশুদের মাঝে সাহসী ও প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করা হবে এবং ছেলে শিশুদেরকে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হবে।

শুধু তাই নয় ইভটিজিং সমস্যাকে নির্মূল করতে প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। তাহলেই ইভটিজিং নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে কিশোরী ও তরুণীরা।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।