শিক্ষার মান: উচ্চ শিক্ষায় মানের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব আবশ্যক (পর্ব-১)

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার একটি অঙ্গীকার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) একটি লক্ষ্য হলো-সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা। উচ্চ শিক্ষার মান নির্ধারন করতে পারে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পদ্ধতি এবং কোন দেশি বা বিদেশি সংস্থা। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা জরুরি।

মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ব্যক্তিক পর্যায়ে আয় বৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। তবে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে গেলে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করাটাও জরুরি। তাদেরকে বাদ রেখে উচ্চ শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার মান নিয়ে সবসময়ই পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা ও সমালোচনা চলে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর দেশের মানুষ আশা করেছিল সুন্দর একটি শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে, শিক্ষার মান বাড়বে। কিন্তু সঠিক শিক্ষানীতির অভাব ও রাজনীতির পালা বদলের মাধ্যমে বার বার নীতি পরিবর্তনের ফলে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

উচ্চ শিক্ষার নামে আমাদের দেশে প্রচলিত যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে তা আসলে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার উদ্দেশে নয়, পেশাগত কাজের উপযোগী হওয়াটাই এক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন নিয়েও আমাদের ভাবনা নেই। পাসের হার বাড়ানোই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। এ কারণে ভালো শিক্ষকও তৈরি হচ্ছে না। তাই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে শিক্ষা দিচ্ছি সেটিকে উচ্চশিক্ষা বলা যাবে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব বড় ও প্রথম বিষয়। ভালো নেতৃত্ব থাকলে ছোট পরিসরে অনেক বড় কাজ করা সম্ভব। সত্যিই বলকে কী আমাদের নেতৃত্বের অভাব। আমরা ভালো গবেষক, ভালো শিক্ষক পাচ্ছি, তবে সবক্ষেত্রে সবাই যে ভালো নেতৃত্ব দেবে এমন নয়। আবার তারাই ভালো নেতা হতে পারেন যদি যথাযথ সমন্বয় হয়।

জবাবদিহিতার অভাব আরেকটি বিষয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এগুলোকেই আমি চ্যালেঞ্জ বলবো। যদি এগুলো কাটিয়ে ওঠা যায় তবে শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব।

উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা কোনও ভিশন বা লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারিনি। ভিশন যখন নেই, তখন মিশনও থাকছে না। তাই নীতি নির্ধারণী কোনও লক্ষ্যও নেই। আমরা চাকরির মার্কেট ও বিদেশে উচ্চ শিক্ষা যাচাই করে কাউকে শিক্ষা দিই না। একই সঙ্গে ছাত্র ও শিক্ষকদের শেখার আগ্রহ কমেছে। এটিও মানতে হবে। এসব নানাবিধ কারণে নেতৃত্বও আসেনি। যারা সত্যিকারার্থে যোগ্য তারা কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। এটি ভাবার বিষয়।

ইউজিসির দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিশ্চিত করা। অসঙ্গতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। এই কাজে ইউজিসির যে অবকাঠামো দরকার তাতে ঘাটতি রয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান জটিলতা শুরু হয় সদস্য নির্ধারণ নিয়ে। এখানে কোনও সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। আর এই কমিশনকে পারিপার্শ্বিক চাপ সামলাতে হয় অনেক বেশি।

এছাড়া আমাদের ইউজিসির লোকবলের অভাব। আবার যথাযথ লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও চাপের সম্মুখীন হতে হয়। এই হচ্ছে সার্বিক অবস্থা। এক্ষেত্রে ইউজিসির কাজ করা খুব কঠিন।

শিক্ষার প্রতি আমাদের গণমাধ্যমের আছে উদাসীনতা। আমাদের গণমাধ্যম ব্যস্ত থাকে রাজনীতি নিয়ে, শিক্ষাক্ষেত্রের জটিলতাগুলো আড়ালেই থেকে যায়। এগুলো সামনে আসা উচিত। উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর শিক্ষার পার্থক্য নির্ধারণ করতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীকে পেশাগত দিকে সফল হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি, যাতে করে সে কাজ করে যেতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি বিকাশ ভিন্ন। ব্যক্তি বিকাশ কোনও যন্ত্র দিয়ে হয় না।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যার গড় করলে আমরা দুটো সমস্যা খুঁজে পাই। একটি হচ্ছে সঠিক পরিচালনা সংকট, আরেকটি হচ্ছে শিক্ষকদের মান। শিক্ষাব্যবস্থা ও মান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সরকারি কর্তৃপক্ষ। ফলে শিক্ষায় একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। ’৪৭-এর পর এটি আরও বেড়েছে। আলো ছড়ানো শিক্ষকদের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। উচ্চতর শিক্ষায় একজন ছাত্র নিজের জীবিকা নিয়েই ভাবছে। অন্যের জীবিকা দেওয়ার মতো প্রসারিত শিক্ষাজীবন তাকে আমরা দিতে পারছি না। উচ্চতর শিক্ষায় এই জায়গাটায় পৌঁছানোর ওপর জোর দিতে হবে।

এটিকে আমি কারিগরি শিক্ষা বলতে চাই। আমরা যে এমবিবিএস বা প্রকৌশল শিক্ষা দিচ্ছি এগুলো কারিগরি শিক্ষা। বাজার ধরার জন্য এইসব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যাতে শিক্ষার্থীরা পেশাগত স্থানে কাজ করে যেতে পারে। তবে এগুলো কোনওটাই উচ্চশিক্ষা নয়। কারণ উচ্চশিক্ষা হচ্ছে নির্মোহ শিক্ষা; কোনও চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে শিক্ষা দেওয়া।

সামাজিকভাবে আমরা জানি, শিক্ষা মানেই হচ্ছে অধিকার। কতটুকু অধিকার সেটি আগে আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ অধিকার, নাকি দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধিকার। কার কতটুকু অধিকার সেটি জানতে হবে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারেও উচ্চশিক্ষা অধিকার হিসেবে উল্লিখিত হয়নি। এখানে সাধারণ শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে বলা হয়েছে। সেটাও আবার দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উপর নির্ভর করবে। আমাদের সামাজিক গতিশীলতার কারণেই শিক্ষিত হচ্ছি। শিক্ষার কাজ গোটা জাতির জন্য যোগ্য লোক তৈরি করে তোলা। এখন মানুষ হিসেবে আমি দেশ ও জাতির সম্পদ। আমার পেছনে দেশ খরচ করে আর আমি বিদেশে চলে যাই।

বাংলাদেশে প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ৯-১০ লাখ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর সবাইকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই, কিন্তু আবার উচ্চশিক্ষাকে অস্বীকার করার উপায়ও আমাদের নেই।

অনেক সময় মনে হয়, যারা বের হয়েছে তাদের সবার উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি আমরা সামাজিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করি, তাহলে আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ এখন ডিজিটালাইজেশনের যুগ। আমরা যদি মনে করি, পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কেউ এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে তা কিন্তু নয়। যদি আমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই, উচ্চশিক্ষার পথ ধরে হাঁটতেই হবে।

উচ্চ মাধ্যমিকে ১০ লাখ পাস করা শিক্ষার্থীর মধ্যে যে এক লাখ উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তারাই বা কী পাচ্ছে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই তো মুখস্ত-নির্ভর। এগুলোর দিকে মনোযোগী হতে হবে আমাদের। উচ্চশিক্ষার মান যদি উচ্চতর না হয়, তবে আমরা সমাজের জন্য বোঝা তৈরি করছি বলেই মনে হয়। উচ্চশিক্ষার মান বা কোয়ালিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আশার জায়গাগুলোতে আশান্বিত হওয়ার কোনও কারণ আমি দেখি না। কেননা সবকিছুই শুধুমাত্র কাগজে-কলমে হচ্ছে। কিন্তু আসলে আমাদের যেটি প্রয়োজন, একজন ভালো শিক্ষক, সেটি কি কাগজে-কলমে মূল্যায়ন করে তৈরি করা সম্ভব? সম্ভব না। আমরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সব স্তরেই ৯৯ শতাংশ পাস করাতে গিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করছি তাতে আপনি কাকে ভালো শিক্ষক হিসেবে তৈরি করবেন?

অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলতে চাই, বর্তমানে উচ্চ শিক্ষায় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমূলক নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পদ্ধতি চলছে তা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়নতো দূরের কথা, দেশে কোন স্তরে মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার মানোন্নয়নে ও শিক্ষা বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সরকার ও আমাদের সকলের কাজ করতে হবে।

তথ্যের উৎসঃ বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা সভা।

লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ।

উচ্চ শিক্ষায় অবহেলার ৫০ বছর: শিক্ষার্থীরা অধিকার বঞ্চিত (পর্ব-৩)

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


ক্ষমতাবান শ্রেণী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সেই কারনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য প্রমাণিত। সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সফল কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়। এর কারণ এই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছাত্রদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার এই উদ্দেশ্যে শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা রয়েছে।

নিজেদের পদ-পদবির উন্নতি সন্ধান করতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দল করে যেমন লাল, সাদা, নীল ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়ার সবলতম প্রমাণ হচ্ছে ভিসি পদের চাকুরির জন্য দলের লোক বসানোর মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য, লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চা নয়। যে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সেটা তৈরি হয়নি কারণ না আছে গবেষণা করার আগ্রহ, না আছে পরিবেশ, না আছে প্রয়োজন। দুই একজন তো নিশ্চয় নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা তো একটা গোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র এহসান রফিকের ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন তার বাবা। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ভবিষ্যতে যেন আর কোনো বাবাকে তার সন্তানকে এভাবে নির্যাতিত হতে দেখতে না হয়। এহসান রফিকের বাবার ভাগ্য ভালো যে, তার সন্তান প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল হল থেকে। কিন্তু বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের বাবাকে বহন করতে হয়েছে সন্তানের লাশ।

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল প্রশাসন অকার্যকর হওয়ায় একের পর এক ঘটছে এ ধরনের মর্মান্তিক আর শোকাবহ ঘটনা। হল প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে যুগের পর যুগ নেতাকর্মীদের হাতে মেধাবী অনেক শিক্ষার্থীর ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। দেশসেরা মেধাবী সন্তানেরা দেশসেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের অনেককে শিকার হতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, লাঞ্ছনা আর অবমাননার।

গত অক্টোবরে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার পর হলগুলোতে গণরুম, গেস্টরুম ও পলিটিক্যাল রুম সংস্কৃতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে। সে সময়কার আলোচনায় অনেকটাই মনে হয়েছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি একটি বড়সড় পরিবর্তনের সূচনা করবে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে। দফায় দফায় মিটিং করে বহিরাগত ও হলে বসবাস করার অধিকারহীন শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এগুলো শুধু নোটিশ বোর্ডের বিষয়। খুব যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা স্বস্তি প্রকাশ করব, এমন কিছুই হয়নি।

ছাত্রসংগঠনের নেতা কর্মী তথা এলাকার সিনিয়র ছাত্ররা সত্যিকারার্থে আবাসিক হলের রাজা বাদশা যেখানে প্রভোস্ট হলো নিস্ক্রিয় দর্শক। আর হল দখলে নেয়ার পর প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কাউকে চিহ্নিত করতে পারলে তাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়া, পিটিয়ে হাত- পা ভেঙে দেয়া, বিছানাপত্র পুড়িয়ে দেয়া, কখনো কখনো বন্দুকযুদ্ধ আর হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো ছাত্রসংগঠনের নিজেদের মধ্যে মারামারিতেও হত্যার ঘটনা ঘটে।

বিশিষ্টজন বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ‘গবেষণা সেল’ থাকার কথা, সেখানে টর্চার সেলের এই ভয়াবহতা সমগ্র জাতির জন্য লজ্জা এবং পরিতাপের।

তারেক বাড়ি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে ২০১৮ সালে। এখন সে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। দু’বছর ধরে সে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকে। চারজনের একটি কক্ষে থাকছেন ২০ থেকে ২৫ শিক্ষার্থী। এ হলে অনেকেই ঘুমান পালা করে। কেউ ঘুমান রাতে আর কেউ দিনে। একদিক থেকে সে ভাগ্যবান। কারণ কেউ কেউ গণরুমেও আশ্রয় পায় না। তাদের কেউ থাকে খোলা বারান্দায়, কেউ বা মসজিদে। পড়ে কখনও লাইব্রেরি, কখনও হলের রিডিং রুমে, কখনও বিভাগের সেমিনার রুমে – আর কোথাও জায়গা না পেলে নিজের বিছানার উপর বসে বসে। কবে সিট পাবে তা সে জানে না। না পেলে তার করারও কিছু নেই। এই উপায়েই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ঘূর্ণিঝড়ের সময় খোলা সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র নয়। ছাত্ররা এখানে আশ্রয় চাইতে আসেনি। এখানে সিট পাওয়া তার অধিকার। কিন্তু ব্যাপারটা অবস্থাদৃষ্টে এখন একরকম আশ্রয়কেন্দ্র হয়েই দাঁড়িয়েছে।

একটা ঘুমাবার বিছানা ও একটা পড়ার টেবিল, মোটামুটি চলা যায় এমন একটা ঘর – এর বাইরে কোন বিলাসিতা আশা করে না দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা তারেকদের মতো ছাত্ররা। কিন্তু বাস্তব চিত্র খুবই করুণ। পত্রিকায় এ নিয়ে খবর এসেছে, ছবি এসেছে। হাজতিদের মতো হলের ডাইনিং, টিভি রুম, মসজিদে লাইন দিয়ে শুয়ে আছে ছাত্ররা। এই রুমগুলো পেলে ভাল, অনেক জায়গায় রুম না পেয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় হলের বারান্দাতে। লাইন দিয়ে খোলা বারান্দাতে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে আছে ছাত্ররা; সেখানে রোদ আসছে, বৃষ্টি আসছে, শীত আসছে। দুই সিঁড়ির সংযোগস্থলের ফাঁকা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পেতে পড়তে বসেছে ছাত্ররা কিংবা বারান্দার কোণে পেতেছে চেয়ার-টেবিল – এ চিত্রও বিরল নয়।

একটি লেখায় এই সংকটের পুরোটা তুলে ধরা অসম্ভব। হলের খাবারের গুণগত মান নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। আলোচনা হতে পারে হলগুলোর স্যানিটেশন নিয়ে – যেখানে এক একটা ফ্লোরের দুপাশের ৬/৮ টি বাথরুমে শত শত ছাত্র যাতায়াত করে। দুজনের রুমে ৮ জন গাদাগাদি করে কোনরকমে শুতে পারে, কিন্তু বাথরুমের ক্ষেত্রে সে নিয়ম খাটে না।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চিত্র আজ অনেকটা রিফিউজি ক্যাম্পের মতো। দেশের যারা ভবিষ্যৎ, যারা চিন্তা করবে, লিখবে, পথ দেখাবে, নেতৃত্ব দেবে, সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানী-শিক্ষক-প্রশাসক হবে তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন চলে এই যুদ্ধের মধ্যে। এই যুদ্ধ চিন্তা করার কোন অবসর রাখে কি? এই ভাবনাই সে প্রতিনিয়ত তৈরি করতে থাকে যে, কবে দুটো পয়সা রোজগার করব, একটু ভাল থাকব, এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পাব।

আবাসন সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী মেস কিংবা বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়। এসব মেস ও বাসাগুলোতে পরিবেশ নিম্নমানের, প্রতিনিয়ত লোডশেডিং এবং ন্যূনতম সুবিধা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অভিন্ন চিত্র। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-এর তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৭ হাজার ৯৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ হাজার ৭৫ জন শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে আবাসিক হলে থাকছেন। শতকরা হিসেবে ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর। এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে ৩৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ শতাংশ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ শতাংশ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শতাংশ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ শতাংশ, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসন সুবিধাই নেই।

একইভাবে শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য কোনো হল নেই বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মেসে থাকছেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ হাজার ৫৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে আবাসিক হলগুলোতে আসন আছে মাত্র ১ হাজার ৩৯ জনের।ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার মেসগুলোর ওপর। ইউজিসি প্রতিবেদনের তথ্যমতে মাত্র ১২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ শতাংশ। সবমিলে দেশের ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। বাকি ৬৪ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীই এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন এমিরিটাস অধ্যাপককে চিনি । যিনি জীবনে তিন (৩) বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার অফার প্রত্যাখান করেছিলেন। তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে দুই ( ২)বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার অফার প্রত্যাখান করেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং তৎকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা। স্যারের কাছে কারন জিজ্ঞাস করতে বলেছিলেন,” আমি উপাচার্য হয়ে এসির হাওয়া খাবো আর আমার ছাত্ররা হলে কষ্টে থাকবে। এটা আমি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারছি না।”পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামি লীগ সরকারের আমলে একইভাবে (এক) ১ বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই অসাধারন যা বর্তমানে বাংলাদেশে খুবই বিরল ঘটনা।

জানা গেছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) ছাত্রদের জন্যে কোনো নিজস্ব ফোরাম নেই, নেই কোনো কোন দলীয় নেতা, কোনো দলের স্বার্থন্বেষী কার্যক্রম নেই, নেই কোন সেসন জট। উপস্থিতি নেই টেন্ডারবাজিরও। অস্ত্রের ঝংকার তো দূরে থাক রক্তের বিভীষিকাও নেই। ছাত্র রাজনীতি না থাকার পরও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) স্ব-গৌরবে নিজেদের প্রকাশ করে চলছে বছরের পর বছর। তবে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ক্যারিয়ার ক্লাবগুলো খুবই কার্যকর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লাবগুলোকে নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এছাড়া দেশের সব বিশ্ববিদ্যলয়কে পেছনে ফেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) উদ্ভাবনী ক্যাটাগরিতেও শীর্ষে উঠে এসেছে। সুতরাং অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত গুনগত উচ্চ শিক্ষার মানের জন্য এই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো ও ম্যানেজমেন্টকে অনুসরন করা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নামে মাত্র একটি মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নাম মাত্র একজন ডাক্তার। কোনো ওষুধ দেয়া হয় না। জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই যন্ত্রপাতি। এছাড়া রোগী ভর্তি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হলেও এ খাতে টাকা আদায় করা হয়েছে। নিয়মিত সমাবর্তনের হয় না বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এর চেয়েও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের পাশাপাশি নিম্নমানের খাবার সরবারহ, সরকার দলীয় রাজনীতির থেকেও আঞ্চলিক রাজনীতির ছাত্র নেতৃত্বের প্রভাব, জুনিয়র ছাত্রদের মিছিল-মিটিং বাধ্য করা, ক্লাসে সিনিয়র ছাত্রদের প্রভাবে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহন না করা, মুখস্থ নির্ভর পড়াশুনা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকট, পরিবহন ও লাইব্রেরী সংকট, উন্নত মানের ল্যাবের অভাব, সেসন জট ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির মডারেশন নেই, ইন্ডাস্ট্রি সাথে ছাত্রদের গ্যাপ বেশি, আদিম কালের নোটপত্র বিতরন, ডিজিটাল প্রযুক্তির কম ব্যবহার, ক্লাসে প্রয়োগিক ও গবেষণাধর্মী জ্ঞানের বাস্তবায়ন কম, বীমার প্রচলন নেই, ক্যারিয়ার ক্লাবগুলো পরিচালনার জন্য আর্থিক সংকট, একাডেমিক কাউন্সিলের নামে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অতিরিক্ত কোর্স ক্রেডিট চাপানো, শিক্ষা লোনের প্রচলন নেই এবং একাডেমিক কাজে কিছু শিক্ষক ও ছাত্রদের পরিশ্রমের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তবে এটি সত্যি যে, বাংলাদেশের বাইরে কোন বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায় না যেখানে এই সকল সমস্যা নিয়ে কথা হয় না। এ সকল সমস্যা নেই তাদের ওইখানে। বরংচ একাডেমিক এবং গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত তারা এবং এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা হয় বেশি।

আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কী শিখল বা না শিখল, তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে একশ’ নম্বরের মধ্যে কত নম্বর পেল সেটি। বিষয়টি আমরা স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কালচারে পরিণত করে ফেলেছি যা খুবই দুঃখজনক বিষয়। এভাবে আসলে উচ্চ শিক্ষার মান নির্ধারন হয় না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন পরে একাডেমিক কাউন্সিল হয় যার ফলে অনেক সময় ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রত্যেকটি অনুষদের বিষয়ের ভিন্নতা থাকায় একাডেমিক কাউন্সিলের পরিবর্তে ফ্যাকাল্টি এক্সেকিউটিভে কাউন্সিল করে সমস্যার সমাধান দ্রুত করা যেতে পারে এবং মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।

আমি একবার সকাল ৯টায় ক্লাশ রুমে লক্ষ্য করলাম কিছু ছাত্র সবসময় অনুপস্থিত থাকে। ক্লাসের বাইরে তাদের জিজ্ঞাস করলাম তারা কেন সকালের ক্লাস ধরতে পারে না? কিছু কিছু ছাত্রের ক্লাসে না আসার কারণগুলো ছিল ভীষণ অদ্ভুত। তাদের সরল স্বীকারোক্তি, রাতে ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আর পাবজি নিয়ে তাদের বড় সময় কাটে, ঘুমাতে ঘুমাতে রাত গভীর হয়ে যায়। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর ক্লাসে এলেও মনোযোগ বসাতে পারে না। আমরা কি তাহলে তবে একটা গ্যাজেট আর ফেসবুক মহামারিতে আক্রান্ত দিবা স্বপ্নচারী জাতিতে পরিণত হচ্ছি? আরও কিছু ছাত্রের উত্তর ছিল বেশ ভয়ংকর। তারা রাজনীতি করে এবং তাদের বড় ভাইদের দেখে এসেছে কিংবা শুনে এসেছে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি জোগাড় করা যায় সহজেই।

তবে একটি দিক থেকে আজকাল ছাত্রদের স্ট্রেস কম, হলের ছাত্ররা সকলে সরকার দলীয় রাজনীতি করেন যা আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুবই বিরল ঘটনা ছিল। তবে শুধুমাত্র কেউ যদি সিনিয়রদের কথা না শুনে তাহলে অন্য দল বলে চাপানো হয় যা হিংসাত্বক। আজকাল ছাত্র রাজনীতি দেখে মনে হয় বিএনপি সরকারের আমলে আমরা যারা ছাত্র লীগ সমর্থন করেছি সে কি স্ট্রেস ছিল? স্রোতের প্রতিকূলে টিকে থাকলেও আমাদের ছাত্র জীবনে সাহস ও আনন্দ ছিল।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, দেশের যে কোন সঙ্কট উত্তরণে নেতৃত্ব দেয়ার কথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে। যদিও এখন এবং আগামী দিন হচ্ছে প্রযুক্তির। আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল, এখনো সময় আছে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছা করে শতভাগ না হলেও ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অনলাইনের আওতায় আনতে পারবে এবং শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। শিক্ষকগণের সদিচ্ছা থাকলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনলাইন থিউরি ও প্রাকটিক্যাল ক্লাস এবং পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। বুয়েট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) অনলাইন কার্যক্রমের উৎকৃষ্ট উদাহরন। আর কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ দেখে মনে হয়েছে এরা সব কিছু থাকার পরও শপথ নিয়েছে কখনো অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যাবে না যা সত্যিই খুবই দুঃখজনক।

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের জন্য দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা মান সম্মত না পেলে জাতীগতভাবে সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হবে না। এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরের পর বছর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী না হলে তারা ধীরে ধীরে দেশের সব ধরনের চাকরি-বাকরি, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে হারিয়ে যাবে। দেশে তৈরি হবে বেকার গ্রাজুয়েট ও সামাজিক অস্থিরতা। আর দেশ হারাবে তার খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের। সকল ধরনের সহযোগিতার জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মধ্যে সেতু বন্ধন খুবই প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করি।

তবুও এখানে টিকে আছে নেতৃত্ব, বেঁচে আছে আশার প্রদীপ। এখানকার ছাত্ররা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর, স্বপ্ন দেখায় সুন্দর আগামীর বাংলাদেশের। অবশেষে আমার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্রাচার্যের ছাড়পত্র’ কবিতার দুটি লাইন দিয়ে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হবার জন্য অনুরোধ করছিঃ

বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

উচ্চ শিক্ষায় অবহেলার ৫০ বছর: গবেষণা নাকি রাজনীতি? পর্ব-২

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গত ২৫ জুন, ২০১৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাতটি প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধসহ ৭২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এই গবেষণায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাতটি প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধের নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ার কথা বলা হয়।

ওই গবেষণা সম্পর্কে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী ও অতিরিক্ত সচিবের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ জুলাই, ২০১৯ আবারও একটি গবেষণায় একই সংখ্যক দুধের নমুনায় চারটি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার কথা জানানো হয়। এই বাস্তবধর্মী গবেষনার ও জনবান্ধব গবেষনার জন্য তাকে সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সকল পক্ষের চাপ ও তাপ সহ্য করতে হয়েছিল। স্যারের ক্রান্তিকালীন সময়ে তাকে মেরুদন্ডহীন কিছু সহকর্মী লিখিত চিঠি দিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে যা খুব দুঃখজনক বিষয় ছিল। আমার মনে আছে ঐ সময় আমার ৭-৮ জন স্যারকে সাহস যোগাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। অথচ স্বাধীন দেশে একজন শিক্ষকের স্বাধীনতা রয়েছে গবেষণাকে জনকল্যাণমুখী করার।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে একটি পূর্বাভাষ রিপোর্ট তৈরিতে অংশগ্রহণ করায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ তাদের সবচেয়ে প্রথিতযশা গবেষকদের একজন মলয় কান্তি মৃধার বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডীন বলেন, “জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে কোন গবেষণা করেনি, প্রকাশ করেনি, কাউকে দায়িত্বও দেয়নি।” তাদের দোষ প্রকৃত গবেষণা করা। তাই প্রকৃত গবেষণা করার জন্য অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের এবং মলয় কান্তি মৃধার জীবনের হুমকি এবং সকল পক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। তবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইভেট হওয়ায় মলয় কান্তি মৃধার উপর ঝড় একটু বেশি গেছে বুঝা যাচ্ছে।

এজন্য হয়তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গবেষণার ফলাফল দেশে বাস্তবায়ন করতে চায় না। ভাবতে অবাক লাগে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ২টির পিএইচডি রয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন। সেও বাংলাদেশে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরুদন্ডহীন ব্যবস্থাপনার কাছে হেরে গেছেন ভাবা যায়। তার সাথে এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাংঘর্ষিক এবং তার সাথে যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকের তিনটি কাজ: ১. নিজে গবেষণা করা; ২. অন্যকে গবেষণায় সহায়তা করা এবং ৩. পাঠদান করা।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শুধু পাঠদান করলেই চলে। একজন কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে একজন বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকের পার্থক্যটা এখানেই। শিক্ষকতা, কারিকুলাম, পাঠ্যক্রম, পাঠদান থেকে শুরু করে আমাদের প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষকদের যাবতীয় আচরণ ও কর্মকালে স্কুল -কলেজ শিক্ষকের মানসিকতা প্রতিফলিত হয়। মাস্টার্স পর্যায়েও তাঁরা সেমিনারের কথা ভাবতে পারেন না, কোর্স দিতে চান।

রাজনীতি-দুষ্টু শিক্ষাব্যবস্থায় ‘গবেষণার চেয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থান দেয়ায় দিন দিন সুনাম হারাতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও গবেষণার ক্ষেত্রে কম বরাদ্দ, গবেষণা কেন্দ্রগুলোর পরিচালকের দায়িত্ব রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য মহলের হাতে অর্পণ, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের মার প্যাঁচে প্রকৃত গবেষকদের ডিগ্রি প্রদানে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় গবেষণার মানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা হলো স্বাধীন পেশা। তাছাড়াও দেশের একজন শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের স্বার্থে আপনি যে কোন বিষয়ে মতামত দিতেই পারেন। অনেক শিক্ষক আছেন কোন বিষয়ে মতামত না দিয়ে সকলের কাছে ভাল থাকতে চায়। এটাই তারা জীবনে একমাত্র সফলতা মনে করে। আসলে এটি মানুষের মেরুদন্ডহীন মানসিকতা পরিচয় বটে। এখন আসছি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি প্রসঙ্গে।

বাস্তবক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি আমার কাছে ৫ (পাঁচ) ধরনের ১. মূল রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিমূলক রাজনীতি। ২. প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আঞ্চলিক রাজনীতি ৩. বিশ্ববিদ্যালয়টি যে জেলায় অবস্থিত যে জেলার শিক্ষকদের আধিপত্যের রাজনীতি ৪. প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ছাত্রজীবনে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ৫. নিজে পদ-পদবি বা সুবিধা পাওয়ার জন্য সকলকে তৈল-বাজি করার রাজনীতি।

বিশ্ববিদ্যালয় কতিপয় শিক্ষক আছেন কিভাবে প্রশাসনিক পদের জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব পাবেন? কিভাবে অনিয়ম করে নিজে একটি বড় বাসা পাবেন? এটার জন্য কর্তাব্যক্তিদের প্রতিদিন অফিসে ধরনা দিয়ে তৈলমর্দন করা। তবে এটার জন্য যে জান-প্রান দিয়ে দেয়, তারা গবেষণায় যদি সময় এর তিন ভাগের ১ ভাগ দিত। তাহলে আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার চিত্র পাল্টে যেত।

একজন শিক্ষকের বুঝা উচিত-শিক্ষকতা একটি ১ম শ্রেণির পেশা, তার আর চাওয়া পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। তাকে মাসে ২ বা ৩ হাজার টাকা বাড়ানোর ভাতা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনিক কর্মকতা হিসেবে ৩য় শ্রেণির পোস্ট নেওয়ার জন্য অনেকের ব্যাকুল হওয়া উচিত কিনা?

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাউকে প্রশাসনিক পদের জন্য যোগ্য মনে করলে কাউকে দিলে সেটি ভিন্ন কথা। তবে আমার জানা মতে, সেটি কখনোই হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যদি সকল শিক্ষকদের স্বার্থে নেতৃত্ব দিত তাকে অবশ্যই তারা পেশাজীবি হিসেবে এগিয়ে যেত। তারা কখনোই জাতীয়ভাবে অবহেলিত থাকতো না। সেটি না করে ব্যক্তিস্বার্থের পদ-পদবির রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাডেমিক পরিবেশ বিঘ্ন ঘটে। এমনকি জাতীয় রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অংশগ্রহন নাই বললে চলে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আভ্যন্তরীন রাজনীতিকে কেউ রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলতে পারেন। তবে বর্তমানে প্রেক্ষিতে রাজনীতি শব্দটি সমাজে পজিটিভ নয় এটাও অনেকে বলেন।

৫ মার্চ, ২০২০ইং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গবেষণা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এনএসটি) ফেলোশিপ এবং বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে শুধু গবেষণা করলেই হবে না। গবেষণার জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তার ফলাফলটা কী সেটাও জানাতে হবে।” তবে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে বিশেষ অনুরোধ করছি ফলাফল প্রকাশ বা গবেষণাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যাতে ফারুক স্যার বা মলয় কান্তি মৃধা স্যারের মতো গবেষকগণ নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে আপনাকে সেটাও নিশ্চিত করাও জরুরি।

তবে এটাও ঠিক অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু গবেষণা করে নিজের পদোন্নতি পাওয়ার জন্য। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লান্তিহীন আর্টিকেল লিখে যাচ্ছে একের পর এক কিন্তু এটি সমাজে বাস্তবায়নে করেন না; যার ফলে অর্জিত গবেষণার জ্ঞান জনকল্যাণে কাজে লাগছে না। তাই উভয় গবেষকের কাছে সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছ থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। তবে কতিপয় পিএইচডিধারী এমন গবেষকও আছে, গবেষণার ধারে কাছেও যান না, দেশ-দশ কিংবা মানবকল্যাণ তো দূরের কথা, নিজের শিক্ষার্থীদের জন্যও এক বিন্দু গবেষণা তারা করেন না।

এটাও সঠিক যে, বিদেশ থেকে অনেক শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো মানের ল্যাব না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণায় অর্ন্তভুক্ত করতে পারছে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও অনেকে গবেষক আছেন, সারাদিন গবেষণা করে এর বাস্তবায়নের জন্য মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, আজকে স্ট্রবেরি বাংলাদেশে উৎপাদন করা হচ্ছে। আজকে খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, সেটাও কিন্তু গবেষণার ফসল। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি এখন পুষ্টির নিশ্চয়তা নিয়ে কাজ চলছে। মাছ, সবজি উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসবই হয়েছে গবেষণার জন্য।

সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উচিত তাদের গবেষণাকে নিজের কাছে না রেখে এটি জনবান্ধব করা। আসলে কোনো একটি বিষয় কী জন্য সংঘটিত হয়েছে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, এর পেছনের কারণগুলো কী, এটি কীভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, কোন কোন ধরনের মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, কীভাবে এটিকে আরও ব্যাপক কল্যাণের কাজে ব্যবহার করা ইত্যাদির জন্যই কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণা প্রয়োজন। সেটি নিজের, পরিবারের, প্রতিষ্ঠানের, দেশের এবং সার্বিকভাবে মানবকল্যাণে কতটা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেজন্যই মূলত গবেষণা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক ভাল মানের পিএইচডি গবেষক রয়েছে তাদেরকে আমরা গবেষণার অপ্রতুল টাকার জন্য কাজে লাগাতে পারছি না। যার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারছে না। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নামকাওয়াস্তে গবেষণা পরিচালনা করছে। ২০১৮ সালে চালু থাকা ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টি গবেষণা খাতে কোনো ব্যয়ই করেনি। আর সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত গবেষণায় ব্যয় করেছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়।

এমনকি ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকাশনাই নেই। তবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যতসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আছেন সে তুলনায় গবেষণা খাতে ব্যয় খুবই নগণ্য বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এক বছরে ২০ লাখ টাকা গবেষণায় ব্যয় করা আসলে কোনো গবেষণাই নয়। দেশে মোট বাজেটের শূন্য দশমিক ২ শতাংশ টাকা গবেষণা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। যা ভালো গবেষণার জন্য অপ্রতুল। গবেষণা মানুষের চিন্তাধারাকে মুক্ত করতে সাহায্য করে। এর সবচেয়ে বড় অবদান মানুষের মধ্যের ধূম্রজাল ও কুসংস্কার দূর করে।

বাস্তবতার নিরীখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অপরাজনীতিমুক্ত করার জন্য গবেষণাধর্মী পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে প্রভাষক পদ বাদ দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থীকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তা আছে। সত্যি বলতে কী? বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনোও শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট জিপিএ ৫ চেয়ে বসে আছি আমরা যা হাস্যকর। কোন আবেদন প্রার্থীর গবেষণার মান দেখা হয় না। এই ব্যবস্থায় আপনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না। আবার ধরেন, আপনার শিক্ষা জীবনে সকল ডিগ্রিতে ফাস্ট ক্লাস কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যুক্ত নন। তাহলেও নিয়োগ পাবেন না।

সুতরাং সরকারি কর্তৃপক্ষকেও বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণাধর্মী করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। আর বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে চলছে এভাবে চললে এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে। এখান থেকে রাজনৈতিক নেতা ও বিসিএস ক্যাডার এবং কিছু বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি হবে। কখনোই কোন গবেষক তৈরি হবে না। যার ফলে আমরা করোনায় বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে অবদান রাখছে, আমরা হাত-পা গুটিয়ে পঙ্গুত্ব বরন করে বসে আছি। আগামীতে দেশের ক্রান্তি লগ্নে কোন অবদান রাখতে পারবনা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমবিন্যাস করা লন্ডনভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন নামে এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের এশিয়ার ৪৮৯টি সেরা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের তালিকা তৈরি করেছে, তাতে এশিয়ার ৪ শত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালেয়ের নাম নেই। আগামিতে হয়তো ৪ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না এটাই স্বাভাবিক। এটি নিয়ে আমাদের নীতি নির্ধারকদের সকলের ভাবা উচিত।

বাংলাদেশে গবেষণা খাত অবহেলিত। শিক্ষা ও গবেষণা খাত গুরুত্ব পেলে দেশ অনেক এগিয়ে যেত। শিল্পায়ন দ্রুততর এবং এর ভিত্তি মজবুত করতে হলে গবেষণা দরকার। আর গবেষণার পীঠস্থান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু অর্থাভাবে এবং প্রায়োগিক সাফল্য যাচাইয়ের সুযোগের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা আলোর মুখ দেখছে না। দেশের স্বার্থে গবেষণা কাজে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়ে দেশ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই সে গবেষণা সার্থক। আমাদের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রেই গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

আমরা ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছি, আর বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের চলতে হবে। দেশের মানুষ যেন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, সেজন্য বিজ্ঞানমনস্কভাবেই আমাদের গবেষণাধর্মী মানবসম্পদ প্রয়োজন।

কোনো জাতি শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে থাকলে সে জাতি অন্যান্য যে কোনো খাতে পিছিয়ে যাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারকে অচীরেই শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে-যেন আমরা বিশ্ব দরবারে আপন পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

অদূরদর্শীতা আর সেচ্ছাচারিতার পরিণাম: তৈরি পোশাক শিল্প

ফখরুল ইসলাম হিমেল
আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গার্মেন্টস অনেকটা আবেগীয় জায়গায়, তাই এই ব্যাপার নিয়া জাতির সামনে আলোচনা করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে,ব্যবসায়ের ছাত্র হিসেবে আমরা বিষয়টিকে একটু ক্রিটিক্যালি দেখি।

আচ্ছা, ৪০ বছর পুরনো শিল্পের অবস্থা এই যে, বন্ধ হবার প্রথমেই তাহারা ৫ হাজার কোটি টাকা প্রোণোদনা নিলেন,তখন এর রুগ্ন দশা আর লুকানোর কিছুই থাকে না!

অর্ডার নাই এই অসহায়ত্ব দেখিয়ে শ্রমিকের বেতন দেয়ার জন্য সরকারের নিকট থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা মাত্র ২% সুদে পেয়ে তারপর ফ্যাক্টরি খোলার তোড়জোড় শুরু হলো । এর মাঝে শ্রমিকদের নিয়ে আনা-নেওয়ার নির্মম অনেক নাটক দেখেছে এ জাতি।বহু মানুষ লিখেছে, কথা বলেছে, তারপরও মেনে নিয়েছে এই ভেবে যে দেখি দেশের যদি কিছু হয়,এই গরিব শ্রমিকদের যদি পেট বাঁচে!

বর্তমানে আমাদের দেশের পোশাক কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করে ৪ থেকে ৭ নং গ্রেডে। ফলে গড়ে একজন শ্রমিকের মূল বেতন দাঁড়ায় মাসে ৮৯০০ টাকার মতো। সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার পরেও অনেক ফ্যাক্টরি ঠিকমতো বেতন দেয়নি, আবার ঘোষণা দিয়ে এপ্রিল মাসের বেতন ৬০% দেয়া হয়েছে।

এখন বিজিএমইএ সভাপতি বলছেন জুন মাস থেকে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে, মালিকদের নাকি কিছুই করার নাই (সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)। সাথে একটা মোটিভেশনাল স্পিচ মেরে দিলেন,গরিবদের একটা আলাদা শক্তি আছে,যার ফলে তাদের আক্রান্তের হার কম!!বাহ! বাহ!

সরকারের প্রণোদনার অর্থ শেষ তো আপনাদের সব পথ বন্ধ?গত ৪০ বছর যখন এই শিল্পে শীর্ষে ছিলেন, তখনকার অর্থ কই গেলো? টেকসই উন্নয়নের কথা বলতে দেখছি আপনাদের বিভিন্ন সভায়!এই নমুনা টেকসই উন্নয়নের?

এবার একটু ভিন্ন আলোচনাই যাই,থিওরি অফ কন্সপাইরেসি তে বলা হয় একটা গ্রুপ আপনার চিন্তাভাবনা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের কন্সপাইরেসি বাস্তবায়ন করতে।আমিও এটা এই শিল্পের পাইরেটস’দের ক্ষেত্রে!পাইরেটস বলছি বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দ্বিতীয়,তৃতীয় হোম বানিয়েছেন দেশে দেশে,তাদের সম্পত্তির খোঁজ নেন তারা কি বানিয়েছে শ্রমিকদের ঘামকে শুকিয়ে! আমার কাছে এটাকে রাবার শিল্পের মত মনে হয়।রাবার শিল্পে ঠিক রাবার গাছকে কেটে তার আঠা বের করে তাকে রুপান্তর করা হয় অর্থকরী ফসল হিসেবে,তেমনি শ্রমিকদের ঘাম শুকিয়ে এক শ্রেণী গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ!

আমাদেরকে মুখস্থ করানো হয়েছে,উন্নয়নের হাতিয়ার আমাদের এই গার্মেন্টস, তারা পূজনীয়। আমাদের দেশটাই দাঁড়িয়েছে এই গার্মেন্টস শিল্পের উপর। আসলে কি তাই? এই একটা শিল্পেই আমাদের উন্নয়নের জয়যাত্রা চালু রেখেছে? আর, এই ধরনের শিল্প কি উন্নয়নকে টেকসই করে?

আচ্ছা, এবারের সাধারন প্রশ্ন করি,ইউরোপ-আমেরিকা পৃথিবীর এত কিছু আবিষ্কার করতে পারে বা বানাতে পারে,তারা প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারে না? হ্যাঁ, আপনারা আবার তোতা পাখি হয়ে গেছেন,বলবেন শ্রম সস্তা আমাদের এখানে, তাই এরা এখানে এগুলো তৈরি করে!

এইতো আপনার প্রশ্নের মাঝেই আমার উত্তরটি লুকিয়ে আছে! আপনি সস্তা জিনিস করলে আপনার দামটা সস্তায় হবে তাই নয় কি?একটা মানুষ সারাদিন মাটি কাটলে,সে পায় ৪০০ টাকা,আর এই একটা দিন যদি একটা ডাক্তার শ্রম দেয়,সে কত পাবে? অবশ্যই বেশি!তারা কেন আপনাকে প্যান্ট শার্ট আর জাঙ্গিয়া বানাইতে দেয়?

কেন তারা আপনাকে বিমান শিল্প,গাড়ি শিল্পের মত ভারী শিল্পগুলো করিয়ে নেয় না? আসলে তারা বুঝে ওগুলো টেকসই উন্নয়নের মাধ্যম!এগুলোর মাধ্যমে তারা দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে,আর দাম পায় সেই শ্রমিকরা, আর এভাবেই তাদের শ্রম দামী হয়!

অর্থনৈতিক মন্দায় হয়তো তারা আমাদের গার্মেন্টসগুলোয় অর্ডার দিবেন না? তবে তারা কি উলঙ্গ থাকবে আপনার সহযোগীতা ছাড়া! নাহ্,আপনার এই সেবা তারা ঘরে একটা সেলাই মেশিন এনে ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবে,অবশ্য আপনার ওই ট্যাগটি ছাড়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। তাতে অবশ্য তার শরমের কোন কিছু নেই!

তাই, আপনার ‘দক্ষ’ শ্রমিকেরা যেখান থেকে এসেছিলো সেইখানেই ফিরে যাবেন! সাথে তাদের বায়বীয় দক্ষতা!যে ক্ষেতমজুর থেকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি শ্রমিক হয়েছিলো, সে আবার ক্ষেত-মজুরি করবে,যে গৃহপরিচারিকা ছিলো সে আবার তার আগের শ্রমেই ফিরে যাবে!!

কিন্তু আপনি কি তাদের গাড়ি ইউটিউবে ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে বানাতে পারবেন? নাহ্,তাহলে তাদের শ্রমের দাম কমবে? আপনিই বললেন,কারা এগুলো বানায়? আমরা না ওরা! ওদের প্রয়োজনেই! এখন করোনা পরিস্থিতিতে ওদের ডিমান্ড নেই,ওরাপ বানাবে না,কেল্লা ফতে! আপনার হাতে আর কি করার আছে! ক্রেতা কিনবে না, আপনি আপনার মেশিন,মানুষ আর ফ্যাক্টরি নিয়া যাদুঘর বানান!

ছোটবেলায়, আমরা যখন দামি কিছু হাতে নিয়ে খেলতাম,তখন আমাদের বড়রা হাতে সামান্য লজেন্স বা অর্থহীন কিছু দিয়ে ওই দামী জিনিসটি আমাদের বুঝিয়ে নিয়ে নিতেন তাদের হাতে! আপনার হাতে তখন শুধুই লজেন্স!


লেখক


ফখরুল ইসলাম হিমেল
সহকারী অধ্যাপক
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।



আবু জাফর আহমেদ মুকুল
সহকারী অধ্যাপক
ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চ শিক্ষার অবহেলার ৫০ বছর: স্বায়ত্তশাসিত নাকি সরকারি? পর্ব-১

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গত ২০ অক্টোবর ২০১৮ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের মত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষকগণ ভেবেছিল, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের প্রয়োজনের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো বলার সুযোগ পাবেন।

শিক্ষকদের চাহিদা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ কোন লিখিত আবেদন না করায় বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে উল্লেখ করেন এবং শিক্ষকবৃন্দ সম্মেলন কক্ষে বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তবে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে রক্ষার্থে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি সম্মেলনের কোন বিকল্প নেই।

বর্তমানে সারা দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। আর ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন আরও পৌনে চার লাখ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে আছেন আরও বিপুল শিক্ষার্থী।

করোনাকালীন সময়ে দেখেছি বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা বিষয়ে গবেষনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আর আমাদের দেশের ২/৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিসিআর মেশিন দিয়ে টেস্ট এবং অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা নিচ্ছে যা বাহাবা পাবার যোগ্য।

সাম্প্রতিককালে, করোনাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস চালুর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬২ শতাংশের স্মার্টফোন রয়েছে। যদিও অনেকের ইন্টারনেট খরচসহ নানা সমস্যা রয়েছে।

করোনার কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) উচ্চশিক্ষায় অনলাইনে শিক্ষার জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট খরচ দিতে চায়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অনলাইন ক্লাস না করার পেছনে বাধা- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মানসিকতা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম বন্ধের জন্য যত তৎপর ছিল, সেরকম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাসের জন্য তৎপর হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়নি।

উল্লেখ্য যে, পার্শবর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকায় বাজেটের শতকরা ১৬-২০ ভাগ বরাদ্দ দেয়া হয়। ইউনেস্কো-আইএলও যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি নীতিমালা ঘোষণা দেন এবং সেই রেজুলেশনে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করেছিলেন।

সেখানে বলা আছে, জিডিপির ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে শিক্ষাখাতে। গত ৪৯ বছরে, বাংলাদেশে বাজেটে জিডিপিতে শিক্ষাখাতে ২% এর কম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ দুটি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

ইউনেসকোর গবেষণায় দেখা গেছে যে আফ্রিকার দেশগুলোতে গড় উচ্চশিক্ষা এক বছর বাড়ানো সম্ভব হলে এ অঞ্চলের জিডিপি ০.৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেত।

আজকে বলা হচ্ছে, শিক্ষায় অর্থ ব্যয় খরচ নয়, বিনিয়োগ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যুনতম সুবিধাদি নিশ্চিত করা এবং উচ্চশিক্ষায় বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা কোনোমতেই অর্থের অপচয় হবে না; লাভজনক ও সর্বোত্তম বিনিয়োগ হয়ে বরং তা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বিশেষ ফল বয়ে আনবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ থেকে ২৭ বছর আগে তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন- ‘আমরা যদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সার্বিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করি, তাহলে শিক্ষাই হচ্ছে তার পূর্বশর্ত। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সাধনা ছিল বাংলার মানুষের স্বাধীনতা।

তিনি বলেছেন- আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকার পায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর তাঁর কন্যার অদম্য কর্মপ্রয়াসে বাংলাদেশ আজ শিকড় থেকে শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে। আর এ অগ্রযাত্রাকে টেকসই রূপ দিতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, প্রত্যাশা, চাহিদা আর প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে।

তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দ্যুতিময় অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়া অত্যাবশ্যক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত সে লক্ষ্য পূরণেই কাজ করা। তবে করোনাকালীন ও পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য পৃথক বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। তবে শিক্ষার বাজেট যায় হউক না কেন গুনগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতা এবং সুশাসনের জন্য বাজেট বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রয়োজন।

লন্ডন‌ভি‌ত্তিক সাপ্তা‌হিক ম্যাগা‌জিন ‘টাইমস হায়ার এডু‌কেশন’ সম্প্রতি এ‌শিয়ার বিশ্ব‌বিদ্যালয়গু‌লো‌কে নি‌য়ে এক‌টি জ‌রিপ চা‌লি‌য়ে‌ছে। যা‌তে এ‌শিয়ার ৪৮৯টি সেরা বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের নাম প্রকাশ পে‌য়ে‌ছে।

গত বছর এ তা‌লিকায় বাংলা‌দে‌শের কোন বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা ক‌রে নি‌তে না পার‌লেও এবার রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তা‌লিকায় অবধা‌রিতভা‌বে সর্বাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আ‌ছে জাপা‌নের ১১০টি, চী‌নের ৮১টি, ভার‌তের ৫৬টি, বিশ্ববিদ্যালয় তুর‌স্কের ৩৪টি, পা‌কিস্তানের ১৪টি এবং মা‌লয়েশিয়ার ১৩টি।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের ১৩১তম অবস্থানসহ ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‍্যাংকিং-এ ৪০০-র মধ্যে আছে। আর বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানও ৪০০-র মধ্যে নাই। এমনকি নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয় ২৫১ থেকে ৩০০-র মধ্যে আছে। অনেক লোক, র‌্যাংকিং বিশ্বাস না করলেও এটা সত্যি যে, র‍্যাংকিং-এ থাকার সাথে একটি দেশের উচ্চ শিক্ষার মান ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব বোঝা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক যখন তাদের অধিকারগুলোর বিষয়ে সরকারি সকল ‍সুবিধার পাশাপাশি যেমন- শিক্ষকদের দ্রুত আপগ্রেডেশন বাস্তবায়ন, পৃথক বেতন স্কেল, গবেষনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট, প্রভাষক নিয়োগের জন্য পৃথক কর্ম কমিশন এবং শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউটসহ শিক্ষকদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য প্রকাশ্যে কথা বলেন। অনেক শিক্ষকগণ জাতীয়ভাবে এ বিষয়টির নেতৃত্ব না দিতে পারলেও তারা ঠিক নিজ ক্যাম্পাসে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দমানোর জন্য সরকার বিরোধী বা প্রশাসন বিরোধী বলে অপব্যাখ্যা করে যা খুবই দুঃখজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই অনেক শিক্ষক এ বিষয়ে কথা বলতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যার ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে শিক্ষক রাজনীতিতে। অনেকের মনে শিক্ষক নেতৃত্ব সম্পর্কে থাকা যেসব সুপ্ত গুঞ্জন, অনাস্থা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ, সেগুলো আরও শক্তভাবে দানা বাঁধবে- এতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।

বর্তমানে শিক্ষক সংগঠনগুলো সরকারের প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ না করার কারন তাদের নিজেদের পদ-পদবির লোভ। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের মেয়াদ উত্তীর্ন হলেও তারা পদ দখল করে আছে এবং এমনকি র্শীষ পদ একই লোকের কাছে বার বার বন্দী হওয়ায় উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় কাঙ্খিত পরিবর্তন আসছে না ।

কয়েকবছর আগে একজন রাজনৈতিক নেতা একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আগে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণেত কাছে পরামর্শ নিতে যেত। আর এখন শিক্ষিকাগণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার জন্য সুপারিশ নেন।”

তিনি আরও বলেন, “কোন প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি থাকলে মনে হয় তারাই আমাদের থেকে বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি। তারা সরকারের গুনগান করার জন্য এতো লম্বা রাজনৈতিক ভাষন দেন যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তেমন কোন ভাষন দেওয়া লাগে না।”

সুতরাং যারা শিক্ষাবিদ হিসেবে বড় পদ দখল করে আছেন প্রকৃতপক্ষে তারা সাধারন শিক্ষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন না। বরংচ তারা ব্যস্ত পদ ধরে রাখতে বা পদের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেজুড়-ভিত্তিক দলকানা রাজনীতি অনুশীলন চর্চা নিয়ে ব্যস্ত।

তাই তারা সাধারণ শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আর একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, আর কতিপয় শিক্ষাবিদ ভুরি ভুরি অন্য বিষয়ের কলাম লিখলেও শিক্ষকতা পেশা বিষয়গুলো খুব সহজে এগিয়ে এড়িয়ে যায় বলেও এতো বছরে দেশের উচ্চ শিক্ষা আগায়নি।

মোহাম্মদ শাহজালাল মোহাম্মদ শাহজালাল নামের একজন সহকর্মী গতকাল ইউট্যাবে একটি স্টাটাসে লিখেছিলেন যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-“আমাদের সবচেয়ে বড় গজব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সুযোগ করে দিয়ে , অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে , শিক্ষকের কাজ শিক্ষা দেয়া , গবেষণা করা , জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেয়া , এই কাজ বাদ দিয়ে দলীয় প্রধানদের স্তাবকতা করানো , মানুষের সৃজনশীল চিন্তাকে দলীয় দৃষ্টিতে বন্ধী করে গণমানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া।

দলে দলে এজেন্ট খুলে বিশ্ববিদ্যালয় আজকে দলদাস তৈরির কারখানা , একজন শিক্ষক জনগণের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি নৈতিক হক এবং সত্য কথা বলবেন , এই জাতির মুক্তি নিহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের দলীয় রাজনীতি বন্ধে , রাজনীতি যে কেউ করতে পারে , কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দলীয় ব্যানারে রাজনীতি করতে পারেন না , এই দলীয় রাজনীতি আমাদের অন্ধকারে নিয়ে গেছে, আমাদের অনতিবিলম্বে জাতির স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি থেকে ইস্তফা দেয়া, সক্রিয় রাজনীতি করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে করেন , আল্লাহর ওয়াস্তে এইসব ক্ষুদ্র স্বার্থের রাজনীতি বন্ধ করেন , নিজের শিক্ষা আর বিবেককে এইভাবে বিক্রি করবেন না , অগণিত মানুষের স্বপ্নের সাথে প্রতারণা করবেন না , জেগে উঠুন। নিজের বিবেককে অমানবিক করবেন না , সত্য ন্যায় আর কল্যাণের পথে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা জাগ্রত রাখুন।

মহান আল্লাহ আপনাদের সহায় হন.” কথাগুলো খুবই সত্যি। তবে সেটি রাজনীতি নয় অপরাজনীতি বা দল কানা রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতি করলে সেটা তো জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে এর কোন প্রভাব দেখি।

আমাদের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিং বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রকৃত গবেষক তৈরির করার পরিবর্তে গাইড মুখস্থ করার বিসিএস ক্যাডার বা ছাত্র নেতা বা একাডেমিক পড়া মুখস্থ ভাল রেজাল্টধারী দক্ষতাবিহীন লাখ লাখ বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি হচ্ছে যা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে অন্যতম একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো- একাডেমিক কাউন্সিল। এটিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বলতে পারেন। আমি দেখেছি শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব এমনকি সরকারের অনেক ভাল ভাল প্রস্তাবও কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষকদের জন্য বাতিল হয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ২য় শিল্প বিপ্লবের উপযোগি বেকার গ্রাজুয়েট তৈরি করছি । অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করা, যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণেত সদিচ্ছা অভাবের পাশাপাশি এটার জন্য অনেকাংশে দায়ী একাডেমিক কাউন্সিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-বিভাগ কোন একাডেমিক বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিল প্রস্তাব দিলে এর সমর্থন প্রয়োজন অন্য বিভাগের শিক্ষিকাগণ যা হাস্যকরও বটে। এ ধরনের একাডেমিক কাউন্সিল জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। শিক্ষা যদি জাতীর মেরুদন্ড হয় আমার তো মনে হয় এই মেরুদন্ডে আমাদের প্রধান সমস্যা ।

বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা জন্য যখন দাবি করে তখন তাদেরকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ফমুর্লায় রেখে আর্থিক সুবিধা বঞ্ছিত করা হয়। আবার যখন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বের অন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা চিন্তা করে পৃথক বেতন স্কেলের বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয় তখন সরকারি কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি বলে অবহিত করা হয়।

স্বাধীনতার এতো বছর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি নাকি সরকারি কর্মচারি দিধা দ্বন্দ্বে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। উল্লেখ্য, সরকার কিন্তু সামরিক বাহিনীর পৃথক বেতন স্কেল ঠিকই বাস্তবায়ন করেছেন। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করতে অসুবিধা কোথায়? সত্যি কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্বের বিদ্যালয় এটা অনেকে বুঝেও না বোঝার ভান করে।

বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে কোন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে এখন পর্যন্ত কোন রেকর্ড নাই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করে উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সদিচ্ছা এবং সরকারের সহযোগিতা মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। তবে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার জন্য কোন মতেই শিক্ষকদের দায়ী করা সমীচিত হবে না।

অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি, জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা। আর শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তুলতে অপরিহার্য একটি জনবান্ধন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। সুতরাং প্রত্যেকটি খাত একটি আরেকটির পরিপূরক। আমাদের মাঝে মতবিরোধ থাকবে, থাকবে নেত্রীত্বের প্রতিযোগিতা, কিন্তু উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে যেতে হবে।

আশা করি, সরকার উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকারি সকল সুবিধা দেওয়ার নিশ্চয়তা, প্রভাষক জন্য নিয়োগের পৃথক কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, পৃথক বেতন স্কেল এবং গবেষনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবেন।

অন্যথায় উচ্চ শিক্ষা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা ন্যায়সঙ্গত বিষয়াদি মেনে নেবেন এবং শিক্ষকদের অবস্থান ও মর্যাদার কথা ভেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ এমন কি প্রতিবেশি দেশের তুলনায় সকল প্রার্থিত সুবিধাদি নিশ্চিত করবেন।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বাজেট ব্যবস্থাপনায় টাকা বৃদ্ধির চেয়েও সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গত বুধবার আমি রিকশায় করে আমার বোনের বাসা মোহাম্মদপুরের চাঁন মিয়া হাউজিং যাচ্ছিলাম। রিকশাওয়ালার নাম ইয়াছীন মিয়া, বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর। আমি সবসময় চেষ্টা করি রিকশা উঠে রিকশাওয়ালার সাথে টুকটাক কথা বলতে।

কথার এক পর্যায়ে হঠাৎ রিকশাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো স্যার আগামি মাসে চালের দাম কী বাড়বে? আমি বললাম, কেমন বাজেট চান? জবাবে তিনি উত্তর দেন, ‘পেট ভইরা খাইতে পারলেই হয়, বাজেটের খোঁজ রাখি না। করোনায় তেমন আয় নেই। পরিবারের অনেক লোক বেকার হইয়া গেছে।’ এটা শুধু ইয়াছীন মিয়ার কথা হয় করোনাকালীন সকল নিম্ন ও মধ্যবিত্তলোকের অধিকাংশ লোকের এটাই স্বাভাবিক কথা।

বাংলায় একটি কথা আছে যত গর্জে তত বর্ষে না। এটি বাংলাদেশের বাজেটের ক্ষেত্রে এটা সত্যি যে, বাজেট নিয়ে সংসদে ও সংসদের বাইরে এতো আলোচনা-সমালোচনা করে নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে আমজনতা সবাই ক্লান্ত হয়ে যায়। আর দেশে বাজেটের অনেক আলোচনা হলেও প্রান্তিক মানুষের সমস্যার তেমন সমাধান হয় না বললেই চলে। বাজেটে কৃষকের সমস্যা তেমন দেখা হয়নি। যাদের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হয়ে থাকে, তাদের জন্য কতটা সুবিধা নিশ্চিত হচ্ছে তা দেখা দরকার।

দেশের উন্নয়নের জন্য বাজেটে সাধারণ জনগণের জন্য কিছু থাকবে না– এটা হতে পারে না। বাজেটে সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকা দরকার। যার মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান করতে পারি। দরিদ্র মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।

সূত্রগুলো বলছে, প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হারে। গত ১০ বছরে তা বেশ কয়েকবার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ হারেও বেড়েছে। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে।

করোনা ভাইরাসের আঘাতে প্রায় সবকিছু স্থবির থাকলেও আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ ঠিকই চলছে। আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের। সংবাদপত্রের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। আগামী বাজেটেও এডিপির আকার ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো।

চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় তা মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। তবে শেষ মুহূর্তে এ আকার আরও বাড়তে পারে। তবে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদগন, করোনাকালীন ১ বছরের পরিবর্তে প্রথম ৬ মাসের জন্য বাজেট চেয়েছেন। এতে একটি সুবিধা হবে, প্রথম ৬ মাস পর্যবেক্ষন করে পরবর্তী ৬ মাস একটি কার্যকরি বাজেট দেওয়া যাবে।

আমি চেষ্টা করছি দেশের কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনামূলক চিত্র ‍তুলে ধরার জন্য।


কৃষি খাত

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে কৃষিখাতের উপর। তাই এদেশের বাজেটে প্রাধান্য দিতে হবে কৃষি খাতকে। দেশের মানুষের দারিদ্র্য মোচন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট সবসময়ই আমাদের কাম্য। বর্তমান সরকারের আমলে বাজেটের আকার বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষি বাজেট।

কৃষি খাতে সমস্যাসমূহ

কৃষকদের কোন সুনির্দিষ্ট ডেটাবেজ নেই, এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রে পেশা উল্লেখ নেই এবং কৃষকদের অন্য কোন প্রকার ডিজিটাল কার্ডও নেই। যার ফলে অনেকাংশে কৃষির ভর্তুকি সুবিধা সাধারণ কৃষক পান না। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া,দেশে শস্য বীমার প্রচলন নেই, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কৃষিতে ঝুঁকির পরিমাণ বেশি, শ্রমিক সংকট, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা পরিকল্পনার অভাব, কৃষি গবেষণার বাজেট প্রতুলতা, কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে কোন প্লাটফর্ম না থাকা, কৃষি বিপনন অধিদপ্তরে দক্ষ লোকবলের অভাব, জাতীয় কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠনে জটিলতা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের অভাব, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণে স্বীকৃতি প্রদানসহ স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানে ব্যবস্থার অভাব।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষি খাতে ৭ হাজার ৬১৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বা ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ ধরা হয়েছে।

আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এ খাতে এডিপি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ফলে বরাদ্দ বাড়ছে ২৬ শতাংশ বা প্রায় ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।


স্বাস্থ্য খাত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। গত ৪৯ বছরে, বাংলাদেশে বাজেটে জিডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে ১%ও কম ধরা হয় যা সেটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এবার আসি দেশের স্বাস্থ্য খাতে।

২ জুন ২০১৮ যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মান-সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবার নিচে। গবেষণায় যে ১৯৫টি দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩।

স্বাস্থ্য খাতে সমস্যাসমূহ

ডাক্তার-নার্স-এর পেশাদারিত্বের অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ক্যাডার বৈষম্য, সেকেলে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মেডিক্যাল টেকনোলজি ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি, স্বাস্থ্য সেক্টরে জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব, হাসপাতালের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পেশাজীবীদের সংগঠনের অপরাজনীতি চর্চা।

নেপালের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির কত জানেন? ২.৩%, পরিমাণে যা খুব বেশি নয়। তবে নেপালের অর্থনীতির চেয়ে তা কমও নয়। আলাদা করে নেপালের কথা বলছি, কারণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ০.৯%।

নেপালের চেয়ে বাংলাদেশের ১.৪% কম। মালদ্বীপ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপির ১০.৮%। শ্রীলঙ্কা ২%, ভিয়েতনাম ৩.৮ %। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাংলাদেশে ৩২ ডলার, ভারতে ৬১ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭২০ ডলার, শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১০০০ ডলার। যার ফলে বাংলাদেশে বাজেট স্বল্পতা ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় আজকের স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর অবস্থা।

কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখেছি, দুই সেক্টরে শতকরা হার বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তি মিলে একসাথে টাকার পরিমান দিয়ে বাজেট ঘোষনা করা হয়েছিল। কারো যদি স্বদিচ্ছা না থাকে সেই সেক্টর কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। তবে জাতীয় ব্যর্থতার জন্য কোন মতেই ডাক্তার ও শিক্ষকদের এককভাবে দায়ী করা যাবে না। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনভাবে জড়িত যে তারা অবিচ্ছেদ্য। অল্পস্বল্প যতটুকুই এই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি, স্বাস্থ্যখাতে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে তারও বড় অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট করছে। করোনার চেয়েও বেশি মারাত্নক ভাইরাসে আক্রান্ত স্বাস্থ্যখাত। সম্প্রতি দুদক স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১ উৎস চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ না করে বাজেট বাড়ালেও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন হবে না। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে ৪৩ জন দলীয় কর্মী, সংসদ সদস্য, মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিলেন দুর্নীতি আর অযোগ্যতার কারণে। আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য কঠোরভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক হিসাব মতে, বিদেশে চিকিৎসা করাতে বাংলাদেশিরা বছরে ২.০৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।আমরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে আমরা নিজেরাই নিজেদের তৈরী ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল না। তার প্রমাণ হলো আমরা সন্তানের শিক্ষার প্রশ্ন যখন আসে তখন আমাদের তৈরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাই না। আমাদের পরিবারের স্বাস্থ্যসেবার প্রশ্ন আসলে আমাদের তৈরী সরকারি হাসপাতালে আমরা যেতে চাই না। সুতরাং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দেশে স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত না করা গেলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র কখনোই পরিবর্তন হবে না।


শিক্ষা খাত

ইউনেসকো ও বিশ্বব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। গত ৪৯ বছরে, বাংলাদেশে বাজেটে জিডিপিতে শিক্ষাখাতে ২% এর কম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এ দুটি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জিডিপি নেপালের বরাদ্দ ৩.৭% যা বাংলাদেশের চেয়ে ১.৭% বেশি। পাকিস্তানের বরাদ্দও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ২.৬ %। মালদ্বীপ শিক্ষা খাতে ব্যয় করে ৫.২%, ভারত ৩.৮%, শ্রীলঙ্কা ২.২%, ভিয়েতনাম ৫.৭%।

২০১৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেটের শতকরা হার কমানো হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশই ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে, আর এক-তৃতীয়াংশ হয় শিক্ষার উন্নয়নে। আমরা যদি সত্যি সত্যি শিক্ষার উন্নয়ন চাই, তাহলে বেতন-ভাতার চেয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বেশি রাখতে হবে।

শিক্ষা খাতে সমস্যাসমূহ

স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত অনেক বেশি এবং আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষার অভাব, ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া, স্কুলগুলোর ম্যানেজিং কমিটিতে অপরাজনীতি এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভাব, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন সমস্যা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের প্রাথমিকের শিক্ষকতায় অনাগ্রহ।

দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য নিয়োগের পৃথক কর্ম কমিশন নেই, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোন ট্রেনিং ইন্সটিটিউট নেই এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল নেই, গবেষনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট নেই, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং স্থানীয় অঞ্চলের শিক্ষকদের অতিরিক্ত সুবিধা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন ব্যবস্থা চালু হয়নি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম ও পরীক্ষা ব্যবস্থা ধীরগতি, ছাত্রদের ৪র্থ শিল্প বিপ্লব অনুযায়ী দক্ষতার অভাব, পাবলিক ছাত্রদের উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ফান্ডিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উল্লেখ্য, ২০ বছর আগেও মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থী পড়তে আসত বাংলাদেশে। বর্তমানে বাংলাদেশের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এখন মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করে। ১৯৮৯ সালেও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ছিল না মালয়েশিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা। এখন মালয়েশিয়া মেডিকেল ট্যুরিজমের বিজ্ঞাপন করে জানান দেয়, চিকিৎসা সেবায় তারা পৃথিবীতে তৃতীয়।

আমাদের প্রচুর পরিমাণে হিউম্যান ক্যাপিটাল দরকার। যেটা আসবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য থেকে। অর্থনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের গবেষকরা মনে করেন, যদি এই দুই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকে তাহলে একটি কর্মক্ষম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা কোন মতেই সম্ভব নয়। (MDG) এর সফলতার ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের অবস্থানে থাকার সময় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে। তার সুফল এখন তারা পাচ্ছে। আমরা মুখে বলছি, বাস্তবে প্রয়োগ করছি না। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়েনি। তবুও যা দিয়েছে তা দিয়ে জিপিএ ৫ না বাড়িয়ে, ৪র্থ শিল্প বিপ্লব অনুযায়ী কর্মসংস্থানের উপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য বাজেট বাস্তবায়নে জোর দেওয়া উচিত।


লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

মালিকদের বাস ভাড়া বৃদ্ধির চাপে তাপে কেন গলে BRTA?

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আজ বাসা থেকে বের হয়ে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট বাজার করার জন্য যাচ্ছিলাম। রিকশা চালক ছিলেন বাবুল মিয়া। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। লক ডাউনে অসুস্থতার কারণে তাঁর বাড়ি যাওয়া হয়নি এবং ধার দেনা করে ঢাকায় থেকেছেন।

গত ৭ দিন যাবৎ আবার রিকশা চালাচ্ছেন। কিছু দিন ঢাকায় কাজ করে বাড়িতে যেয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে আম বাগানে কাজ করবেন বলে পরিকল্পনা করেছিলেন। সে গতকাল শুনছে ১লা জুন থেকে অর্ধেক সিট খালি রাখার শর্তে বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাড়া নির্ধারণ কমিটি।

আমাকে বললো, স্যার আমার পক্ষে ধার দেনা পরিশোধ করে প্রায় ডাবল টাকা বাস ভাড়া দিয়ে বাড়িতে যাওয়া কী সম্ভব? বাস সার্ভিস চালু হলে ঢাকা থেকে লাখ লাখ দিন মজুর ঢাকা ছাড়বে এবং গ্রাম থেকে ঢাকা আসবে।

সত্যিই আজ পরিবহন মালিকদের প্রভাবে বিআরটিএর মতো দুনীর্তিবাজ প্রতিষ্ঠান বাবুল মিয়ার মতো দিনমজুরের কথা ভুলে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

বিআরটিএ কী ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিষ্ঠান হলে বাস ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা যাত্রীদের উপর চাপিয়ে মালিকদের ভাড়ার নেওয়ার লাইসেন্স দেয়? এমনকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে—এইটার নিশ্চয়তা দেয়নি বিআরটিএ। বাস ভাড়া একবার বাড়ালে দেশের ইতিহাসের কমানোর কোন নজির আমি দেখি নাই। সুতরাং কোন রকম পর্যবেক্ষন ছাড়া কতিপয় প্রভাবশালী পরিবহন মালিকদের চাপে শুরুতেই বাস ভাড়া বাড়িয়ে বিআরটিএ প্রমান করলো। সাধারন যাত্রীদের কথা ভুলে তারাও ভাড়া বৃদ্ধির চাপে ও তাপে গলে যেতে পারে।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে সরকার। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক আদেশে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়। এরপরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনা নিয়ে গতকাল শুক্রবার বাস ও লঞ্চ মালিকদের নিয়ে আলাদা বৈঠক করে বিআরটিএ ও বিআইডব্লিউটিএ। তবে বিআইডব্লিউটিএ ও রেলপথ মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য যে, তারা যাত্রীদের কোন ভাড়া বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়নি।

খবরে কাগজে পড়লাম বিআইডব্লিউটিএ বলছে, লঞ্চমালিকেরা কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছেন, তাঁরা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করছেন—এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি আসে। হুট করে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হলো আর তাঁরা গাদাগাদি করে যাত্রী তুললে তো কোনো উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না। এই সিদ্ধান্তটি বিআরটিএ নিতে পারতো। মালিকেরা তা মানছেন কি না, সেটা দেখে ভাড়া বাড়ানো যেত কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) এ বিষয়ে কবির মতো নীরব ছিলেন বলে সংবাদ মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি।

বিআরটিএ যে, হিসাব করে ভাড়ার খসড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখলেও লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পরিবহন মালিকেরা ‘সিটিং সার্ভিস সহ নানা নামে আগে থেকেই শতভাগ বা এরও বেশি ভাড়া আদায় করে আসছেন।

রসিক যাত্রীরা ‘সিটিং সার্ভিসকে বলেন ‘চিটিং সার্ভিস। নতুন করে ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া সেই আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গেই যুক্ত করে আদায় করবেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।

অন্যদিকে দূরপাল্লার বাসের মধ্যে সরকার শুধু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণবিহীন (নন-এসি) বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। বিলাসবহুল ও এসি বাসের ভাড়া মালিকেরা নিজেরাই ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা-জোগানের ওপর ভাড়া নির্ভরশীল। এসব বাসের ভাড়া আগে থেকেই এত বেশি যে কখনো কখনো ২০-৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকলেও তাঁদের লোকসান গুনতে হয় না। সবার জন্য ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া দূরপাল্লার পথের নন-এসি বাসগুলোও সব সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে। ফলে এখন ৮০ শতাংশ বাড়তি মানে হচ্ছে আগের বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও ভাড়া বাড়ানো।

বিআরটিএ সূত্রে আমি যতটুকু জানি, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস ক্রয়, ব্যাংক ঋণ, জ্বালানি খরচসহ ২০ ধরনের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো একটা উপকরণের ব্যয় বাড়লেই ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ডিজেলসহ কোনো কিছুর ব্যয় বাড়েনি বরংচ কমেছে। এ ছাড়া বাসের ভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ করার রীতি আছে। সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে ভাড়া কম বাড়িয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ কমানো যেত।

পরিবহন মালিকদের কাছে মনিটরিং থাকায় এখন যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হতে পারে। এমনকি বাসে বাড়তি যাত্রী পরিবহন করা হতে পারে। কারণ, অতীতেও তা-ই হয়েছে। জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার আগেই বাসের ভাড়া বেড়ে যায়। কিন্তু তেলের দাম কমলে বাসের ভাড়া কমে না। ফলে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শুধু যাত্রী কম বহনের আশ্বাসের ভিত্তিতে সেটির কোন ভিত্তি নেই বললেই চলে।

করোনাকালে যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অনেক দেশে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে লন্ডনে বাস সেবা চালু রয়েছে। অথচ সেখানেও বাস চালকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়েছে কিন্তু বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন সেক্টরে বেসরকারি সংস্থার ওপর ভরসা করেই জনসাধারণকে চলাচল করতে হয়। বেসরকারি খাতের অধীনে চললেও গণপরিবহন হওয়ার কথা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের আওতায়।

কিন্তু এখন তা ব্যক্তিপর্যায়ে চলে যাওয়ায় রয়েছে অসংখ্য মালিক-শ্রমিক। গঠন হচ্ছে নানা সংগঠন। এর ফলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, পেশি-শক্তি ও অবৈধ লেনদেনের পথ তৈরি হয়েছে। এই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মালিক বেশির ভাগই প্রভাবশালী নেতা। কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়। তাঁরা খুব কম সংখ্যক বাস নামিয়ে কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে যান। এরপর সাধারণ মালিকেরা তাঁদের অধীনে বাস চালাতে দেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে দৈনিক ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এটাকে জিপি বা গেট পাস বলা হয়। এভাবে পরিবহন খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। চাঁদাবাজি বন্ধ না করা গেলে ভাড়া বাড়িয়ে লাভ হবে না। কারণ, লাভের টাকা থাকে চাঁদাবাজদের পকেটে। চাঁদাবাজি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভাড়া না বাড়িয়ে লাভ করা সম্ভব ।

গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার জন্য মূলত দায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষ। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে নতজানু নীতির কারণে পরিস্থিতি এখন সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যে কোনো অন্যায় দাবি আদায় করে আন্দোলনের মাধ্যমে। এ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। গণপরিবহন এখন গণ-মালিক। এটি বড় সমস্যা। সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি যাত্রী চাহিদা পূরণে অপ্রতুলতা একটি অন্যতম কারণ। এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা ডাবল ডেকার ছিল সাধারণ যাত্রীদের প্রথম পছন্দের যান।

অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে অনেক রুটে বিআরটিসির বাস বন্ধ করা হয়েছে। আন্ত:জেলা রুটে বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করলেও সেগুলোতে সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতির অংকই বেশি। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিতে পারে। এখন যে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে, তা আর কোনো দিন কমানো যাবে না। এছাড়া পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা তথা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পেশাদারিত্ব, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। রেগুলেটরি কমিটিতে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বা ধারণা নেই। এসব কারণেই পরিবহন খাতকে গ্রাস করছে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম।

অনেক আগে থেকেই সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতারা যা দাবি করেন সরকারকে তাই মেনে নিতে দেখে আসছি। পরিবহন সেক্টরের কথা আসলেই মনে পড়ে যায় কবি শামসুর রাহমানের কবিতার লাইনের মতো ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। রাজনৈতিক বেশধারী পরিবহন মালিকরা নিজেদেরকে মনে করছেন তারা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। এবার যেন এটি না হয়ে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আর এবারও করোনার মহামারিতে যদি মালিকরা নিজেরাই বাস ভাড়া নির্ধারন করে। তাহলে যাতে ফসলের দাম নির্ধারন করার জন্য কৃষকদেরকেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

স্কুল জীবনে পড়েছিলাম পদার্থের সংজ্ঞা- যার আকার আছে, আয়তন আছে, স্থান দখল করে এবং বল প্রয়োগ করে বাধার সৃষ্টি করে।

আজকে তাই মনে হয়েছে পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয় নামের আকার ও আয়তন আছে, সরকারি সংস্থাকে চাপ দিতে পারে ও বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং পরিবহন সেক্টরে স্থান দখল করে আছে তারাই আজ সমাজের পদার্থ। আমরা সাধারন জনগন পদার্থের সংজ্ঞা ও ধরন পড়ে আজ নিজেরাই বায়বীয় পদার্থ। জনগন বিচ্ছিন্ন থাকে সর্বদা যাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে কোন ধরনের অবস্থান নেই। এক্ষেত্রে কেউ আমাদের অপদার্থ বললেও মাইন্ড করবো না।

আরেকটি বিজ্ঞানের কথা মনে আছে, পদার্থ ও শক্তি একটি অন্যটিতে রূপান্তরযোগ্য, সুতরাং এগুলি একই সত্তার দুই ভিন্ন রূপ। বর্তমানে বাস মালিকগণ পদার্থ হিসেবে রাজনৈতিক পরিচয়ে সর্বোচ্চ শক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে। নিউটনের গতিসংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী, জড়তা হল পদার্থের সেই ধর্ম যার কারণে বাইরে থেকে এর স্থিতিশীল বা গতিশীল অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে পদার্থটি তৎক্ষণাৎ অবস্থা পরিবর্তন করে না। আর সেটি হলো আমরা সাধারন জনগন। যারা চিৎকার করতে পারি দূর থেকে কিন্তু পরিবহন সেক্টরের অরাজকতা পরিবর্তন করতে পারি না।

পদার্থের আর বিষয় হলোঃ বায়ু মন্ডলে তাপ ও চাপ বৃদ্ধি পেলে নির্দিষ্ট একটি পদার্থ গলে যায়। সেই পদার্থের সাথে অন্য উপাদান মেলালে এর গলনাংক কমানো-বাড়ানো যায়। সুতরাং আজকেও দেখছি মালিক পক্ষের অপরাজনীতির চাপ ও তাপে বিআরটিএ গলে দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে হারে বাস ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ করে যাত্রীদের উপর চাপানোর চেষ্টা করছে।

কিন্তু এভাবে বাস ভাড়া বৃদ্ধি করে আর কতদিন যাত্রীদের জিম্মি করবে মালিক ও কর্তৃপক্ষ?


লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ।

স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: কর্মজীবী নারীদের জন্য করণীয়

আবু জাফর আহমেদ মুকুল
ইসরাত জাহান ইতি


স্ট্রেস এক ধরনের শারিরীক, মানসিক ও আবেগ সংক্রান্ত ফ্যাক্টর যা শারিরীক কিংবা মানসিক টেনশনের সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি এমন কিছু হয় যা সম্ভবত আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। দুর্ভাগ্যবশত স্ট্রেস অনেক মানুষের জীবনের নিয়মিত অংশে পরিণত হয়েছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে জানিয়েছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্ট্রেসকে “একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্য মহামারী” বলে অভিহিত করেছে।

দ্য আমেরিকান মনস্তাত্ত্বিক এসোসিয়েশন রিপোর্ট যে ৫০% এরও বেশি আমেরিকান চাপে ভুগছেন বিভিন্ন কারণে. উপরন্তু, প্রাপ্তবয়স্ক অস্ট্রেলিয়ানদের ৯১% তারা রিপোর্ট করেছেন যে মানসিক চাপ অনুভব করেন, তাদের জীবনের কমপক্ষে একটি ক্ষেত্রে। প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নির্বাহী, কাজের-যুক্ত চাপের কারণে যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর ১২.৫ মিলিয়ন কর্ম দিবস হারাতে হয়। এই অবিরাম মানসিক চাপ সঠিকভাবে পরিচালনা না করা হলে হার্ট অ্যাটাক বা আলসার হতে পারে।

স্ট্রেস কখনও কখনও করতে পারেন অব্যবস্থাপনা কারণ এটি তখন স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে শক্তির উত্সকে লক করে দেয়। খারাপ চাপ থেকে প্রতিক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত মাথাব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের সমস্যা এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা। সেখানে তিন ধরণের চাপ, যার প্রত্যেকের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, উপসর্গ এবং সময়কাল রয়েছে; তীব্র চাপ, এপিসোডিক তীব্র চাপ এবং দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস। বাস্তব ক্ষেত্রে, স্ট্রেস ব্যক্তির পারিবারিক ইতিহাস, আর্থিক স্ব-ক্ষমতা ও আয়ের বিন্যাস এবং সামাজিক মর্যাদার উপর নির্ভর করে।

স্ট্রেসের কারণেও কর্মজীবি নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত ছয় বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে , ঢাকা শহরে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে ডিভোর্সের আবেদন করা হচ্ছে অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হিসাবে প্রতি দুই ঘণ্টায় সেখানে একটি করে ডিভোর্সের আবেদন করা হচ্ছে । ডিভোর্সের আবেদন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়-প্রায় ৭৫ শতাংশ আর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে ডিভোর্সের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে ডিভোর্সের আবেদন বাড়ছে। উত্তর ও দক্ষিণে ডিভোর্সের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে। শিক্ষিত ও কর্মজীবীদের মধ্যে বিচ্ছেদের হার তুলনামূলক বেশি। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরার অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি ডিভোর্সের আবেদন করছেন। দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কাওরান বাজার এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি ডিভোর্স দিচ্ছেন।

এক হিসাবে দেখা যায়, বিভাগীয় শহরে বিচ্ছেদের হার ৪৯.০৩ শতাংশ আর জেলা শহরে ৩৫.৫ শতাংশ। এ ছাড়া একক পরিবারে থাকা দম্পতিদের যৌথ পরিবার থেকে আসা দম্পতিদের তুলনায় ডিভোর্সের হার বেশি। ডিভোর্সের আবেদনকারীদের মধ্যে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন তাদের সংখ্যা বেশি (হাজারে এক দশমিক ৭ জন)। আর অশিক্ষিতদের মধ্যে এই হার হাজারে শূন্য দশমিক ৫।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেকে নিজের পেশাজীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে আগের চেয়ে বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক কারনের পাশাপাশি আছে অনেক ধনীর দুলালীর আত্মঅহমিকাও।

নারীরা সংসারের বিপুল ঝক্কি সামলান বিনামূল্যে। যে কাজে কোনো অর্থ দেওয়া হয় না, সেটা জিডিপিতে যুক্ত হবে না। এটাই নিয়ম এর বাইরে অর্থের বিনিময়ে বাজারজাতযোগ্য উৎপাদন ও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। নারী-পুরুষের অবদান আলাদাভাবে দেখানো হয় না সরকারি কোনো তথ্যে। তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষের অবদান পৃথকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

এরই অংশ হিসেবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের করা গবেষণা ‘রিয়ালাইজিং দ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রমোটিং ফিমেইল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন’-এ বের করেছে, জিডিপিতে নারীর ভূমিকা ২০ শতাংশ। এটি একজন নারী বছরে যত কাজ করেন, তার মাত্র ১৩ থেকে ২২ শতাংশের হিসাব। বাকি ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ কাজের বিনিময়ে কোনো মূল্য পান না তারা। তাই ওই কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটি যুক্ত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান হতো পুরুষের সমান।

উদাহরণ বলা যায় ‘এখন নারী বাসায় যে কাজ করছে, যেমন কাপড় ধোয়া, সেটা হিসাবে আসছে না। যদি লন্ড্রির দোকানে ধোয়া হতো, তাহলে তার জন্য দোকানদারকে টাকা দিতে হতো। এখন গৃহস্থালি বা গৃহস্থালির বাইরেও নারী অনেক কাজ করছে, যেটা হিসাবে আসছে না।

আমরা অন্য একটি গবেষণায় দেখেছি, নারীরা পারিবারিকভাবে যে সহিংসতার শিকার হয়, তাতে তারা অনেক কাজ করতে পারে না। ফলে মোট জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা কমাতে পারলে এই ক্ষতিটা হতো না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নারীকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও কাজের আরও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ যত বাড়বে, উন্নয়নের গতিও তত বাড়বে। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাছাড়া বর্তমান টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) এর ৫ নম্বর লক্ষ্য- লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সব নারী ও মেয়ের ক্ষমতায়ন করা। সে পথ ধরে তর তর করে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার দাঁড়াবে ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। এর ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে চলতি জিডিপিতে নারীর গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। দক্ষতার অভাব, পারিবারিক কাজের চাপ ও নিয়োগকর্তাদের মানসিকতার কারণে নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বড় পদে আসতে পারছেন না বলে দাবি করেছে বিবিএস।

সংস্থাটি বলেছে, কৃষি খাতের ১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ৯৬ লাখ ৪৪ হাজার, যা মোট কৃষিশ্রমিকের ৪৯ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুসারে গৃহস্থালির কাজে একজন পুরুষ যেখানে দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে, সেখানে একজন নারী ব্যয় করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে যে প্রতিদিন একজন নারী গড়ে একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় এমন কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। সুতরাং অর্থ রোজগারের জোরে পুরুষ যে ক্ষমতা চর্চা করেন, তা কতটা যুক্তিসংগত?

ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই দেশের নারীরা। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এমআরআই) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জুনে দেশে ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার। এর ৯০ শতাংশই নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। একটি দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে কতজন নারী এ হিসাবে বিশ্বের ৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ৬ নম্বরে।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তার সংখ্যা ২৩ লাখ।

জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। জিডিপিতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান শতকরা ৩৪ ভাগের বেশি। সেই তৈরি পোশাক শিল্পে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ নারী কর্মী কাজ করছে। বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ১০ কোটি ৯১ লাখ মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটি। মোট কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেকের বেশি নারী হলেও কর্মবাজারে আছেন মাত্র ২ কোটি।

এ হিসাবে নারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ সরাসরি কর্মবাজারে আছেন। বাইরে থাকা সাড়ে ৩ কোটি নারী কাজে যোগ দিলে দেশের মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে- এ কথা বরাবর বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব ও পারিবারিক কাজের চাপে তাদের বড় অংশ শ্রমবাজারের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গৃহস্থালির কাজ নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার পথে বড় বাধা। কর্মবাজারে যোগ না দেওয়া নারীর ৮১ দশমিক ১০ শতাংশই এর জন্য ঘরের কাজের চাপকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে একই কারণে কর্মবাজারে প্রবেশে বাধা পাচ্ছেন ৮ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ। উপযুক্ত কাজ পেলে শ্রমবাজারে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন নারীর সংখ্যাও পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে শ্রমবাজারে যোগ দেবেন আরো ১৫ লাখ ৮৭ হাজার নারী। আর কাজ পেলে যোগ দেবেন এমন পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ৪৬ হাজার।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ব্যবস্থাপক পর্যায়ে শ্রমজীবীদের মাত্র ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী। এ ছাড়া পেশাজীবীদের ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, কারিগরি সহযোগীদের ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ, পাইকারি বাণিজ্যে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ নারী। শীর্ষ ব্যবস্থাপক পর্যায়ে নিয়োজিতদের মাত্র ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী। দায়িত্বের পাশাপাশি বেতনের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার।

সম্প্রতি উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ প্রতি মাসে গড়ে ১৩ হাজার ৫৮৩ টাকা বেতন পেলেও নারীরা পান ১২ হাজার ২৫৪ টাকা। ব্যবস্থাপক পর্যায়ে পুরুষরা গড়ে ৩৬ হাজার ১৩৩ টাকা বেতন পেলেও নারীরা পান ৩২ হাজার ৫৮৮ টাকা।

এ ছাড়া পেশাজীবীদের মধ্যে মাসিক আয়ে ২ হাজার ২৮ টাকা, টেকনিশিয়ানদের ৮৭২ টাকা, করণিক পর্যায়ের সহযোগীদের ১ হাজার ৪৭৯ টাকা, পাইকারি সেবায় ৭৯৪ টাকা, কৃষি ও বনায়নে ১ হাজার ৭০৬ টাকা, খুচরা ব্যবসায় ৮৫৩ টাকা, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় ৯০৯ টাকা ও অন্যান্য কাজে ৩ হাজার ৭৫৪ টাকা কম পাচ্ছেন নারীরা। গৃহস্থালি কাজেও নারীরা তুলনামূলক কম বেতন পাচ্ছেন। এ খাতে পুরুষের গড় বেতন ৯ হাজার ৪৪১ টাকা। আর নারীর ৭ হাজার ৬৪৪ টাকা।

কর্মজীবী নারীদের নিরাপত্তার জন্য আবাসন, পরিবহন ও বাচ্চাদের ডে-কেয়ার সেন্টারের অপ্রতুলতা। তাদের চলাচলের পথে নারীদের জন্য পৃথক ওয়াশরুম, নামাযের ঘর ও বাচ্চাদের খাওয়ানোর পৃথক ব্রেস্ট ফিডিং রুম নেই বললেই চলে। খোদ রাজধানীতেই নারীদের ব্যবহার উপযোগী মাত্র ২৬টি টয়লেট রয়েছে।

সাম্প্রতিককালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৩.৩ শতাংশ কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী বান্ধব টয়লেট এক শতাংশও নেই। যার ফলে সর্বোপরি অনেক ক্ষেত্রে ঢাকা শহরেও নারী বান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়নি। অনেক নারী নানারকম জটিল রোগে ভুগছেন।

উল্লেখ্য যে, সরকার মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস নির্ধারন করে দিলেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৩ মাসের বেশি ছুটির অনুমোদন দেয় না। গত ১০ই মে, ২০২০ইং সারা বিশ্বে মা দিবস পালন করা হয়। মা শব্দটি ছোট হলেও এর পরিধি বিশাল। নিষ্ঠা সহকারে দায়িত্ব পালনে মায়েরা থাকেন সন্তানদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মা হিসেবে একজন নারীকে যেমন আমরা সকলে শ্রদ্ধা করি। তেমনি সকল নারীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা আমাদের দায়িত্ব। যার ফলে পরিবারে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

সুতরাং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে বৃহত্তর স্বার্থে উভয়কে ত্যাগ স্বীকার করে এগিয়ে চলা প্রয়োজন। পাশাপাশি কর্মজীবি নারীদের জন্য কর্মজীবনের সহকর্মীদের হিংসা-বিদ্বেষ বাদ দিয়ে পারস্পরিক সহানুভূতিশীল মনোভব পোষণ করাও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মজীবনে নারীরা হতাশায় ভোগেন, তার বড় একটা কারণ হচ্ছে পরিবারের অসহযোগিতা।

ফলাফল, হয় ব্যক্তিগত জীবনে টানা অশান্তি, নয় শেষমেশ কাজটাই ছেড়ে দেয়া। ভাবুনতো, একজন পুরুষকে তো তার বাইরের কাজের জন্য এত ভেবে চিন্তে পা ফেলা লাগে না, তবে একজন নারীকে কেন ভাবতে হবে প্রতি পদে? অথচ, চাইলেই পরিবার সবচেয়ে বড় সমর্থন হয়ে উঠতে পারে মেয়েদের কাজের ক্ষেত্রে। বিষয়টা খুব কি কঠিন?


লেখকবৃন্দঃ আবু জাফর আহমেদ মুকুল, পিএইচডি গবেষক ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এবং ইসরাত জাহান ইতি তরুণ নারী উদ্যোক্তা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের ভূমিকা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


একটি দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে উদ্যোক্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-২০১৯ উপাত্ত অনুযায়ী, ১৬ কোটি ৫৭ লাখ, মোট জনগোষ্ঠীর ২১.৪% শহরে বাস করে, বাকি ৭৮.৬% গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। জাতীয় বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক বিকাশের জন্য গ্রামীণ উদ্যোক্তা বিকাশ প্রয়োজনীয়।

একজন উদ্যোক্তা মূলধন গঠনের প্রচার করে এবং সমাজে সম্পদ তৈরি করে এবং প্রক্রিয়াটিতে বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য হ্রাস করে। গ্রামীণ উদ্যোগকে গ্রাম পর্যায়ে উদীয়মান উদ্যোক্তা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যা বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা যেমন শিল্প, শিল্প, কৃষিকাজ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের শক্তিশালী উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে। তারা দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করে যা স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এবং স্থানীয় জীবনযাত্রাকে উন্নত করে।

এটি সাধারণত গ্রাম পর্যায়ে উদ্ভূত উদ্যোক্তা হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয় যা বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা যেমন শিল্প, শিল্প, কৃষির মতো উদ্যোগ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের শক্তিশালী উপাদান হিসাবে কাজ করতে পারে। গ্রামীণ অঞ্চলের বিকাশকে পূর্বের তুলনায় আরও বেশি উদ্যোগের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নত করার জন্য এবং একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি ও পরিবেশ বজায় রাখার জন্য উদ্যোক্তা একটি বাহন হিসাবে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামীণ উদ্যোক্তা কৃষি, কৃষির সাথে সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ, ক্ষুদ্র শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসায়, গ্রামীণ কারিগর এবং অন্যান্যগুলিতে বজায় রাখে। তবে, সচেতনতা, উত্সাহ এবং প্রশিক্ষণের অভাবে গ্রামীণ উদ্যোক্তা সুপ্ত পর্যায়ে রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দেশজ মোট উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান ২৫ ভাগ, সেখানে সব শিল্প খাতের রয়েছে ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ৭৮ লাখ উদ্যোক্তাই জিডিপিতে এ অবদান রাখছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়লেই দেশের অর্থনীতির পরিধি বড় হবে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনা দরকার ।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের। শহরের পাশাপাশি এখন গ্রামেও বাড়ছে নারী উদ্যোক্তা। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, গ্রামীণ পরিবহন ও যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হওয়ায় স্বল্প আকারে হলেও বাড়ছে নারী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়াতে অকৃষি খাতের অবদানও বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রামীন সেবা খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বিউটি পার্লার, বিকাশ, নাগাদ, এজেন্ট ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য ও ফার্মেসী সেবা, ফটো স্টুডিও, সার্ভিসিং ভিত্তিক কার্যক্রম পাম্প মেরামত ও সার্ভিসিং সহ জ্বালানী ইঞ্জিন পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত , মোবাইল, রেফ্রিজারেটর যানবাহন মেরামত, খুচরা বা পাইকারের দোকানে সরবরাহকৃত পরিষেবা, মুদ্রণ, হোটেল এবং রেস্তোঁরা, চা স্টল, সার, কীটনাশক এবং বীজ বিক্রির দোকান, সাপ্তাহিক টুপি, মাছের ব্যবসা , টেক্সটাইল ভিত্তিক কাজগুলির মধ্যে বুনন, কাটা, এবং টেইলারিং এবং মেরামত এর অন্তর্ভুক্ত।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৯ বছর। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আর এই এগিয়ে যাবার পেছনে অন্যতম প্রধান শক্তি হচ্ছে-তরুণ সমাজ। জাতীয় যুব নীতি অনুসারে বাংলাদেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্টিকে যুব হিসেবে সংঞ্জায়িত করা হয়েছে। এ বয়সসীমার জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, যা আনুমানিক ৫ কোটি। তরুণরাই দেশের সম্পদ। পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবর্তনের সকল ধারায় তরুণদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। এমনকি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেবার জন্য তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।

তরুণরাই পারে দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে। আর দেশের উন্নতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য তরুণ উদ্যোক্তা বাড়াতে হবে। তরুণদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে ঈর্ষণীয় এই অগ্রগতির মূলমন্ত্র শিখিয়ে গেছেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বারবার বলে গিয়েছিলেন, আজ আমরা সেই মুক্তি অর্জনের পথে।

বঙ্গবন্ধু প্রায় বক্তব্যে বলতেন, ‘দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। একটি দেশের সমস্যা এবং সম্ভাবনা দুটিই তরুণ সমাজের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তরুণরা বেকার থাকলে তারা বিপদগ্রস্ত হয়, দেশের জন্য ক্ষতিকর বোঝায় পরিণত হয়। আর কোনো দেশের তরুণ সমাজ যদি কর্মঠ হয় এবং কাজের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, তাহলে ওই দেশের দ্রুত উন্নতি কেউ আটকাতে পারে না। তরুণদের দীপ্ত মেধা এবং সতেজ জ্ঞানের গতি এই সবুজ-শ্যামল বাংলাকে প্রকৃত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারে।’

২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে প্রফেসর ড. আতিউর রহমান স্যারকে নিয়োগ প্রদান করেন। ড. আতিউর রহমান স্যার গভর্নর থাকাকালীন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক স্বয়ংক্রিয়তা ও ডিজিটাইজেশন এনেছিলেন এবং তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য ১ লাখ কোটি টাকা লোন দিয়ে এসএমই খাতকে পুর্নবিন্যাস, কৃষককে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ, স্কুল ব্যাংকিং, গ্রিন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, উন্নয়ন ও মানবিক ব্যাংকিং ধারনা প্রবর্তন, পদ্মাসেতুর অর্থায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন ও
সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসাসহ নানাবিধ কাজে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন । এর সুবিধা আজকে ভোগ করছেন গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি।

গত অর্থ বছরের বাজেটে প্রথমবারের মত নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য ১শ’ কোটি টাকা ‘স্টার্ট আপ ফান্ড’ বা ‘নতুন উদ্যোক্তা তহবিল’ গঠন করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণ যুবসমাজ:‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’কথা তুলে ধরেছেন। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে এবং স্বাবলম্বী তরুণ সমাজ গঠন করতে ২০২১ সালের মধ্যে ‘তরুণ উদ্যোক্তা নীতি’, একটি দক্ষ ও কর্মঠ যুবসমাজ তৈরি করতে ২০২৩ সালের মধ্যে ‘কর্মঠ প্রকল্প’ এবং প্রতি উপজেলায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে স্বল্প ও অদক্ষ তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নেয় সরকার।

যে সোনার বাংলার স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, যে অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন মানুষের, যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন সবার জন্য, তাঁরই সুযোগ্য কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সে পথেই তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এসডিজির প্রথম লক্ষ্যটি নিয়েই যদি বলি, তাহলে দারিদ্র্য দূরীকরণের মোক্ষম উপায় হচ্ছে মানুষের আয় বৃদ্ধি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৬ লাখ তরুণ বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, সেখানে প্রথম লক্ষ্য পূরণই কি বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়? উত্তরটি হচ্ছে ‘না’। এসডিজির লক্ষ্য ৯-এ বলা আছে শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা। এ উন্নয়ন কাদের হাত ধরে হবে? এ দায়িত্বের ভার নেওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য তো তরুণেরাই।

একজন উদ্যোক্তা তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন উপায়ের জানান দেন, যা সমাজকে একটি ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাহলে এই যে শিল্প বা কৃষি খাত কিংবা রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এই প্রতিটার জন্যই এমন মানসিকতার মানুষ লাগবে, যাঁরা উদ্যোগী। এসডিজির প্রথম লক্ষ্যটি শহর ও মানুষের বসবাসকে একীভূত, নিরাপদ, প্রাণবন্ত এবং টেকসই করা সম্ভব কেবলমাত্র গ্রামীন উদ্যোক্তাদের অর্থনীতিতে অর্ন্তভুক্ত করে।

জাতিসংঘের দেওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তরুণ উদ্যোক্তারা। সামাজিক উদ্যোক্তা আন্দোলন থেকে শুরু করে লাভজনক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে হলে তরুণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ ভূমিকাই তাই প্রত্যাশিত।

এসএমই ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) পরিচালিত ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে নারী উদ্যোক্তা : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত ২০১৭’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ২০০৯ সালে শিক্ষিত ২০ শতাংশ নারী ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশের ৮৬ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাই বিবাহিত। তাদের ৬৫ শতাংশেরই আবার পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে। ৭৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার বয়স ৩১ থেকে ৫০ বছর। তরুণ নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা মাত্র ১৩ শতাংশ (২১ থেকে ৩০ বছর)। শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। ঋণ প্রাপ্তি, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতায় অবিবাহিত নারীরা এখনো উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হতে পারছেন না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের ইশতেহারে নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে গ্রামকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রাম হবে শহর। আমার গ্রাম-আমার শহর’ : প্রতি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধার সম্প্রসারণ- এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে তিনি গ্রাম উন্নয়নের পথ-নকশাও উপস্থাপন করেছেন। তারপর থেকে এ বিষয়টি আমাদের উন্নয়ন আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।

অতঃপর সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতায়নের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার জন্য গ্রহণ করা দরকার সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি। এর জন্য প্রয়োজন গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তর।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতার পর থেকেই নিরন্তর কাজ চলছে- বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১০ বছরের শাসনামলে এ কার্যক্রম অনেক বেশি বেগবান হয়েছে।


লেখকঃ উদ্যোক্তা গবেষক ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ; এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়