ইতিহাসে আজকের এই দিনে: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করা হয়

নুর নওশাদ, চবি প্রতিনিধি


শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২২কি.মি দূরে অবস্থিত চির সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর তারিখে যাত্রা শুরু করে ৫৫ তে পা রাখলো দেশের একমাত্র শাটল ট্রেনের ক্যাম্পাস।এই দীর্ঘ সময়ে নানা অর্জন,আর্থসামাজিক উন্নয়ন,জ্ঞান বিজ্ঞান অবদানের মাধ্যমে গৌরব উজ্জ্বলভাবে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কি.মি. দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিউনের পাহাড়ি ও সমতল ভূমির উপর অবস্থিত দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ।আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ (২১০০একর) ক্যাম্পাস এটি।দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৬৬ সালে চারটি বিভাগ ( বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি ইতিহাস) নিয়ে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে ৪৮ টি বিভাগ,৬টি ইন্সটিটিউট, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র,১৩টি হল,৯২০ জন শিক্ষক এবং ২৪ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত।

শহর থেকে ২২ কি.মি. দূরে হওয়ায় ১৯৮০ সাল থেকে চালু হয় শাটল ট্রেন যা চবি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের প্রধান বাহন।ফলে পৃথিবীর একমাত্র শাটলের ক্যাম্পাসও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।শিক্ষার্থীর দিক থেকে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ক্যাম্পাস।প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী ট্রেনে যাতায়াত করে।

মুক্তিযুদ্ধের ৫ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠা হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান পর্বততূল্য।ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান,বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো।মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে শহীদ হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১জন শিক্ষার্থী,১জন শিক্ষক,৪জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী।মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার যা দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম।এই গ্রন্থাগারে বর্তমান সংগ্রহ সংখ্যা প্রায় ৩.৫ লক্ষ যার মধ্যে রয়েছে বিরল বই, জার্নাল, অডিও-ভিজ্যুয়াল উপাদান, পাণ্ডুলিপি এবং অন্ধদের জন্য ব্রেইল বই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তিনটি জাদুঘর।১৯৭৩ সালের ১৪ জুন, মধ্যযুগের চারটি কামান নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ভবনটি পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্ত। যেখানে রয়েছে: প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামিক আর্ট গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি এবং সমসাময়িক আর্ট গ্যালারি।এছাড়া রয়েছে প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর,সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর।

অনন্য সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জীব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকেও অন্যতম।দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, হেলিপ্যাড,কলা ফেকাল্টি পেছনের ঝর্ণা, ঝুলন্ত ব্রিজ, চালন্দা গিরিপথ, জীববিজ্ঞান অনুষদ পুকুর, প্যাগোডা, স্লুইস গেট, ভিসি হিল, টেলিটক হিল, হতাশার মোড়, দোলা সরণী, ফরেস্ট্রি ও বিশাল সেন্ট্রাল ফিল্ড।জীব বৈচিত্র‍্যের মধ্যে রয়েছে মায়া হরিণ,সজারু,নান রঙের পাখি,বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সহ রয়েছে অনেক প্রজাতির প্রাণী।আরও রয়েছে জয় বাংলা ভাস্কর্য, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল, স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ, মাস্টার দা সূর্যসেন স্মৃতিস্তম্ভ, বঙ্গবন্ধু চত্বর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্তনদের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছে জামাল নজরুল ইসলাম (পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, বিশ্বতত্ত্ববিদ), সবচেয়ে কম বয়সে ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়া বিজ্ঞানী সাজীদ আলী হাওলাদার,আলাউদ্দিন আল আজাদ(ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, গবেষক),আনিসুজ্জামান (শিক্ষাবিদ ও লেখক। প্রাক্তন অধ্যাপক,বাংলা বিভাগ), ড.মুহাম্মদ ইউনূস (অর্থনীতিবিদ,২০০৬ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী), সৈয়দ আলী আহসান (জাতীয় অধ্যাপক),ড.আব্দুল করিম (প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য), দেবদাস চক্রবর্তী(চিত্রশিল্পী), জনপ্রিয় রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু (এলআরবি ব্যান্ড),ময়ুখ চৌধুরী (কবি, গবেষক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ),মুর্তজা বশীর (চিত্রশিল্পী), মাহফুজা খাতুন শিলা (এসএ গেমসে স্বর্ণপদক বিজয়ী ক্রীড়াবিদ), আবুল মোমেন (একুশে পদক বিজয়ী সাহিত্যিক, কলামিস্ট), ভূইয়া মো. মনোয়ার কবির (বিশিষ্ট পররাষ্ট্র ও সীমান্ত সমস্যা গবেষক, রাষ্টবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠাতা: সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ),অনুপম সেন(সমাজবিজ্ঞানী, লেখক এবং দার্শনিক), সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ (ভাস্কর, অপরাজেয় বাংলার নির্মাতা)।

হুমায়ুন আজাদ (কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী; প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ), মনজুরুল কিবরিয়া (হালদা নদী গবেষক),আজিজ আহমেদ(সেনাপ্রধান), আবুল হোসেন (জেনারেল, বিজিবি প্রধান), শফিউল আলম (মন্ত্রিপরিষদ সচিব), মোমিনুর রশিদ আমিন (অতিরিক্ত সচিব,শিক্ষা মন্ত্রণালয়), ফজলে কবির (বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর), আনিসুল হক (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন মেয়র), মোহাম্মদ আবদুল মোবারক (নির্বাচন কমিশনার), মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী(দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক), রাজিয়া বেগম(বাংলাদেশের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক), সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ এবং ২১-তম প্রধান বিচারপতি),বিমল গুহ (কবি), হরিশংকর জলদাস(ওপন্যাসিক), মাহবুবুল হক(প্রবন্ধকার),আলতাফ হোসেন (কবি), মহিবুল আজীজ (কথাসাহিত্যিক), ময়ূখ চৌধুরী (কবি), বিখ্যাত চিত্রশিল্পী উত্তম সেন (একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী), উত্তম গুহ (৭ বার বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ শিল্প নির্দেশক ), জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ,পার্থ বড়ুয়া (সঙ্গীত শিল্পী ও অভিনেতা), নকীব খান (রেঁনেসা ব্যান্ড),বাপ্পা মজুমদার(দলছুট), এস.আই.টুটুল (সঙ্গীত শিল্পী), মোশারফ হোসেন শরিফ (ইসলামী সঙ্গীত শিল্পী), বিখ্যাত অভিনয় শিল্পী মাসুম আজিজ, চিত্রলেখা গুহ, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর , হাসান মাসুদ, সোহেল খান, জিয়াউল হাসান কিসলু সহ আরও অনেক জ্ঞানি গুণীজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা সমহিমায় এগিয়ে যাবে চবি।জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে যাবে প্রত্যহ। বিশ্ব র‍্যাংকিং এ শক্ত অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।