বিদেশি শিক্ষার্থীরা যখন গবেষনায় ব্যস্ত, আর আমরা লাইব্রেরীতে প্রেমে ব্যস্ত


জাকির রহমান


ইজরাইলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন নতুন মৌল আবিস্কার করে, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রেম করে! বিশ্বের ১ নম্বর হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছরে কোন কনসার্টের খবর পাওয়া যায় না।

আর আমাদের ভার্সিটিতে কত কত কনসার্ট… এল.আর.বি, জেমস, শিরোনামহীন, অ্যাশেজ, তাহসান, ওয়ারফেজ.-একটার পর একটা প্রোগ্রাম হয়।নাচ, গান, হোলি উৎসবও হয় এখন। ফাক ইউ, হট বেবি, ক্রাশ খাইছি, মাস্তি, ইয়াবা, বিয়ার, গাজা এই শব্দগুলো এখন ছেলে-মেয়েদের কাছে অতি পরিচিত।

অন্যান্য দেশে জ্ঞানী মানুষরা, বিজ্ঞানীরা কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বেশ কয়েকবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেটে অংশগ্রহণ করেন।
আর আমাদের?

বিজ্ঞানী মকসুদুল আলম কয়টা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যেতেন? আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আশরাফুল আলম কয়টি সমবর্তন অনুষ্ঠানে যান? (যিনি ব্যাক্টেরিয়া শনাক্তকরণের সেন্সর তৈরি করেছেন. “যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স” জার্নাল এ তার গবেষণা ছাপা হয়েছে)বা ‘জিন’ ত্রুটি নির্ণয়ে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশের যে তিন গবেষক।

তারা হলেন— ডা. কেএম ফোরকান উদ্দিন ও ডা. মোঃ রোবেদ আমিন ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান বৈজ্ঞানিক ডক্টর মোহাম্মদ উদ্দিন ড্যাফিল। তারাও কি ভার্সিটির কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাবেন? তাদেরকে কি বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকা হবে?

তাদের কাউকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকবে না। কারণ- নাইলা নাঈম আর সানি লিওনদের দাম এখানে বেশি অথবা দালালী আর দাসত্বের বীজ বহনকারী মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীরা – যারা এদেশের মানুষকে রোহিঙ্গার মতো করতে চায়। স্টিভ জবসের স্পিচ পাওয়া যায় ইউটিউবে। সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।

বিলগেটস একজন ভালো বক্তা। মার্ক জুকারবার্গও একজন মোটিভেশনাল স্পীকার!
আজকে চীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। ইন্ডিয়া আইটি সেক্টরে ডমিনেট করছে। তাদের ছেলে মেয়েরা গুগলে কাজ করে। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা মাস্তি করে আর মেয়েরা হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় পার করে।

ভারত যখন বসে বসে সিইও তৈরি করে আমরা তখন বসে বসে ক্যাম্পাসে ক্যাডার তৈরি করি। আমেরিকা যখন নতুন নতুন ফাইটার জেটের নকশা করে, তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যখন প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা মেলার আয়োজন করে আমরা তখন ক্যাম্পাসে মিথিলার – তাহসান ডিভোর্স নিয়ে আন্দোলন করি এবং ইউটিউবে লুল ভিডিও দেখি।

মায়ানমার যখন প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের যন্ত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে – তখন আমাদের ছেলেমেয়েরা বোটানিক্যল গার্ডেনে বসে প্রেম করছে।আমাদের দেশে প্রেমের নাটক করে হিট হওয়া ছেলেটা হলো বড় সেলেব্রেটি। আর ময়দা সুন্দরী হচ্ছেন হট কেক।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষার্থীরা মেধাবী নাকি সংগ্রামী, রাষ্ট্রই কি সংগ্রামী বানাচ্ছে?

ইকবাল মুনাওয়ারঃ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ। পলাশীর আমবাগান থেকে আজ পর্যন্ত বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে মানচিত্রের বুকে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার আগে যখন পুরো দেশ পরাধীন ছিল তখনকার সমসাময়িক পরিস্থিতির নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রসমাজ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আগে বিভিন্ন অধিকার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে আদায় করার জন্য একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করে ছাত্রসমাজ। যদি স্বাধীনতার আগের কথা বলা হয়, এই জাতি পরাধীন ছিল তখনকার অধিকার চিনিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম যথার্থই যুক্তিযুক্ত।

৭১ এর পর থেকে যদি স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে চোখ দিই এবং ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাইলে স্পষ্টত দেখা যায় একটা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ক্ষতি পূরণ করার জন্য চূড়ান্ত কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। অন্যান্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে বিষয়ে বিশেষ করে নজর দেয় তাহলো পরিশ্রম এবং শিক্ষা।

প্রবাদ আছে, “শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড”। যদি আমরা ভালভাবে অনুধাবন করি তাইলে স্পষ্টতই দেখতে পাই স্বাধীনতার পরে ছাত্ররা গবেষণা কিংবা শিক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে তার চেয়ে বেশি অবদান রেখেছে আন্দোলন সংগ্রামে। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চান্স পাওয়ার পরে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের শুরু হয়ে যাই অন্যায় কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুংকার তোলার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি.সি. থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের ব্যক্তিদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হয়।



বশেমুরবিপ্রবির ভি.সি বিরোধী আন্দোলন, জাবির ভি. সি বিরোধী আন্দোলন, ববির ভি.সি বিরোধী আন্দোলন এবং বুয়েটে আবরার হত্যার বিচারের আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে ঘটে যাওয়া নানা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের এক প্রকার মুক্তির আন্দোলন।



যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে পড়াশোনা করতে তাদের কাজ হয়ে দাড়ায় তাদেরকে পড়াশোনা করার দায়িত্ব নেওয়া শিক্ষকদের শিক্ষা দিতে। বিগত দু-এক বছরের কথা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রাম মেধাবী বানানো তো দূরের কথা বানাচ্ছে সংগ্রামী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের কথা ছিল গবেষণা কিংবা শিক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রাখা।

বশেমুরবিপ্রবির ভি.সি বিরোধী আন্দোলন, জাবির ভি. সি বিরোধী আন্দোলন, ববির ভি.সি বিরোধী আন্দোলন এবং বুয়েটে আবরার হত্যার বিচারের আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে ঘটে যাওয়া নানা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের এক প্রকার মুক্তির আন্দোলন। নাসায় ইনভাইট পাওয়া ছাত্রদের নিয়ে যে প্রতারণা রাষ্ট্রযন্ত্র তার ফল একদিন ভোগ করতে হবে। দেশের অবস্থা দেখে উদীয়মান বহু বিজ্ঞানী পাড়ি জমায় ভিনদেশে। বহু শিক্ষকের চারিত্রিক ত্রুটির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি হয়ছে বহু শিক্ষার্থী।

যদি প্রশ্ন করা হয়, স্বাধীনতার পরেও কেন একের পর এক ছাত্র আন্দোলন? হয়তো রাষ্ট্র ভিন্ন উত্তর দিবে কিন্তু ভালভাবে দেখলেই অনুভূত হয়, শিক্ষার্থীদের নানা রকম ঠকানো, দলীয় লোভী রাজনৈতিক শেল্টারে নিয়োগপ্রাপ্ত সব শিক্ষকদের নানা রকম অপকর্ম, শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, আঞ্চলিক নেতাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে একচ্ছত্র প্রভাব এবং তাদের অনুগত করতে বাধ্য করা, গবেষণার যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানকরনে ব্যর্থ হওয়া সহ নানা কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের দেশ মেধাবীদের সম্মান করতে জানেনা, বহু মেধাবী মেধার যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় পাড়ি জমায় ভিনদেশে।

দেশকে বাস্তবিক উন্নত বানাতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সর্বপ্রথম লোভী এবং দুর্নীতিগ্রস্থ কর্তাব্যক্তিদের পরিবর্তন করতে হবে যাতে মেধাবীদের রাজপথ বাদ দিয়ে লাইব্রেরিতে স্থান করে নিতে পারে। দেশেই প্রতিষ্ঠিত হোক বড় বড় গবেষণাগার। শিক্ষার্থীরা আরো হয়ে উঠুক মেধাবী।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

ধর্মীয় অনুশাসন, শিক্ষাঙ্গন ও বাস্তব জীবন

ফাতেমা সুলতানাঃ ছোটবেলায় আমরা যখন আমাদের বাচ্চাকে ধর্ম শিক্ষা দিতে যায় (সেটা নৈতিকতার শিক্ষা হোক, নামাজের শিক্ষা হোক, বা কোরআনের শিক্ষা হোক) ঠিক তখনই আমাদের মাথায় আসে- আরে! ও’র তো সামনে পরীক্ষা! এই তো সামনে ‘সমাপনী’ না হয় ‘জেএসসি’ নতুবা ‘এস এস সি’!

এভাবে চিন্তা করে আমরা অনেক দেরী করে ফেলি। আমাদের যেন আর সময় হয়ে ওঠে না; পাছে আমাদের বাচ্চারা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় পিছিয়ে পড়ে! আর যদি হোম টিউটর এবং গানের টিচার এর পাশাপাশি ধর্মের টিচার ও রাখা হয়, সেটাও কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই রাখা হয়-এই ভেবে যে আমার বাচ্চাটা যাতে হোম টিউটর এর গণনায় পিছিয়ে না পড়ে। ওখানেই আমাদের বাচ্চারা শিখে যায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

আমার প্রশ্ন হলো, ছেলে মেয়েরা ঘর থেকে এমন উপলব্ধি নিয়ে বিদ্যাপীঠ গিয়ে প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কি-ই বা শিখবে? এই শিক্ষার প্রতিফলন ঘটে তাদের বিদ্যা পিঠেও। জেএসসি অথবা এসএসসি পরীক্ষায় সবগুলা বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীও ‘ইসলাম শিক্ষা’ বিষয় টির জন্য গোল্ডেন এ প্লাস পায় না এমন নমুনা আমি অনেক দেখেছি।

তারা মনে করে ‘ইসলাম শিক্ষা’ ই তো,পরীক্ষার আগের দিন পড়ে নিব। আর পড়া টাও হয় শুধুমাত্র জিপিএ অর্জনের জন্য। জীবন চলার জন্য ইসলাম কি ধরনের দিক নির্দেশনা দিয়েছে সেটা আর জানা হয় না, অবহেলায় একটি কোণে চাপা পড়ে থাকে।

আর যদি ইউনিভার্সিটি লাইফের কথা বলি ‘আবরার’ ও ‘অনিক সাহা’ এদেরকে আপনারা সবাই জানেন। যে ছাত্ররা আজ বাদে কাল দেশের হাল ধরবে, তারা কেন খুনি হবে! তারা কেন খুন হবে! আর কেনই বা জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গঠনে অন্তরায় হবে?

আমি বলি, একজন শিশু তার পরিবার থেকে যদি ধর্মীয় অনুশাসন, বাধা-নিষেধ, করণীয়, বর্জনীয় সবকিছুর শিক্ষা ভালোমতো নিয়ে তারপর বিদ্যাপীঠে পদার্পণ করে, তবে তার এই বীজ জ্ঞান তার সমগ্র বিদ্যার্জনের পথে সহায়ক হবে। প্রতিযোগিতার আগে, ভালো এবং মন্দের কড়া তার হৃদয়ে নাড়া দিবে।

আজকে আমি শুধু শিক্ষার্থীদের কথা বললাম। সমাজে আরও এক শ্রেণির পিশাচ মানব বিকট আকার ধারণ করেছে যারা কিনা বিশেষভাবে বিদ্বান কিন্তু নিকৃষ্টতম দুর্জন; যার শিকার আমাদের ‘নুসরাত’। তাদের জন্য রয়েছে ভিন্ন মতামত। এই ভিন্নতায় এখন আর আসতে চায় না, তাদের জন্য শুধু শাস্তিই কাম্য।

শুধু এটুকু বলেই শেষ করব যে, আপনার, আমার ধর্ম যেটাই হোক, তা কিন্তু শুধু শান্তি-ই চাই। নিজের ভিতরে এই ধর্মের শিক্ষা ধারণ করুন তাহলে আপনাকে আর খুনি হতে হবে না এবং আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস ও প্রার্থনা করি- খুন ও হতে হবে না।

লেখকঃ প্রভাষক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বুয়েটের ছাত্র হত্যা প্রসঙ্গে: শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা

আরিফুজ্জামান রাজীবঃ বুয়েটের একজন ছাত্রকে গত ৬ তারিখ রাতে হত্যা করা হলো।এ ঘটনা সারা বাংলার মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। আমরা যারা প্রবাসে আছি দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশের এরূপ মর্মান্তিক ঘটনা অামার মতো আরও অনেকেরই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। কি বিভৎস ঐ ঘটনা! কি মর্মান্তিক!

হলের ২০১১ কক্ষে রাত আনুমানিক ৮:৩০ থেকে ৩টা পর্যন্ত চললো অমানুষিক নির্যাতন। কেউ এগিয়ে এলো না? কেউ তাকালোও না? মরার পরেও কেউ ঘুরে দাঁড়ালো না? খুনিরা হল প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করলেন, কীভাবে আলামত নষ্ট করা যায়? কীভাবে এই ঘটনাটাকে অন্যদিকে নেয়া যায়?

এই পুরো ঘটনার জন্য কে বা কি দায়ী হতে পারে? আমাদের শিক্ষকদের এখানে দায় কতটুকু?

আমার ৩.৫ বছর শিক্ষকতা আর ৬ বছরের পড়াশুনার জীবনে একটা জিনিস খেয়াল করেছি, ছাত্র-ছাত্রীদের এই অন্যায় করা, অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকা, নিজের স্বার্থের দিকে আগে নজর দেয়া, এগুলোর জন্য মূল দায়ী শিক্ষক সমাজ আর কিছুক্ষেত্রে পরিবার। ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক বিকাশের পেছনেও মূল অন্তরায় শিক্ষকদের মানসিক সমস্যা, সাথে পরিবারিক অসঙ্গতি।

আবরারের ঘটনা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কটা আসলে স্বার্থের, ভীষণ দুর্বল ও মেকি। একটি ছাত্রকে হলে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হলো অথচ হল প্রভোস্ট জানেনই না তার হলে কী হচ্ছে বা জেনেও মাথা ঘামায় না। এ দায় কার??

শুধু শিক্ষকরা বললে কিছুটা ভুল হবে মোটামুটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটা প্যারামিটারে আমরা মেপে থাকি, তা হলো রেজাল্ট ভিত্তিক পড়াশুনায় ভালো ছাত্র-ছাত্রী আর খারাপ ছাত্র-ছাত্রী। যার সিজিপিএ বেশি সে ভালো ছাত্র আর যার সিজিপিএ কম সে খারাপ ছাত্র বা ছাত্রী। এই শ্রেণী বিন্যাসের পর, শুরু হয় আসল খেলা।

এই সিজিপিএ বেশি পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রীটিকে মানসিকভাবে বিকালঙ্গ, স্বার্থপর, লেজুড়বৃত্তিক মানুষ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। সে যেন বই ছাড়া অন্য কিছু না বুঝে, তাকে অমুক হতে হবে, তমুক করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে সুবিধা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ বা অন্য কোন সামাজিক অসংগতি নিয়ে যদি কোন ছাত্র আন্দোলন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝের সারির ছাত্র-ছাত্রীরা সামনে চলে আসে, শেষের সারির গুলো ব্যবহার হয় রাজনৈতিক দল বা বড় ভাই দ্বারা, আর ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র-ছাত্রীরা হয় মাথা লুকিয়ে রাখে, নয়তো কোনো অংশগ্রহনই থাকে না। আর যদি ভুল করে সামনের সারির কোন ছাত্র বা ছাত্রী সামনে চলে আসে, তখন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তাকে একা একা ডাকে। তাকে বুঝানো হয়, এই আন্দোলন তোমার জন্য না, তুমি পড়বে, তুমি আমাদের সম্পদ, তোমাকে সেটা অনুধাবন করতে হবে, ব্লা ব্লা ব্লা।

এসব বলে ছেলেটার/মেয়েটার যে কি উপকার হলো, আমি জানি না। কিন্তু ছেলেটার/মেয়েটার সমাজের, আমাদের যে কি ক্ষতি হলো তা আমি বুঝতে পারি। ঐ ছেলেটা মানসিকভাবে শেষ, স্বাভাবিক ভালো মন্দ বুঝার জ্ঞান সে হারিয়ে ফেলে। গুরুর সাথে তার একটা স্বার্থের সম্পর্ক তৈরি হয়। তার মাথায় ঢুকে গেল, যদি এসব কাজে না যাই, ঐ শিক্ষক আমার জন্য সুপারিশ করবে চাকরি বা অন্য কোথাও। সে আবার শিক্ষক হলে আবারো এমন বহু ছাত্রকে মানসিক বিকালঙ্গ করে ফেলবে। এভাবে পুরো সমাজে অাজ তিন ভাগে বিভাজিত হয়ে গিয়েছে । এক তথাকথিত খারাপ ছাত্র, অল্প সংখ্যক মানুষ যারা এধরনের শিক্ষক বা পরিবারের বলয় থেকে বের হতে পারছে, আর ঐ শ্রেণীর যারা বিকালঙ্গ বানাচ্ছে সেটা শিক্ষক ও পরিবারের সদস্য দুইই হতে পারে।

এবার আমরা আবরারের ঘটনার দিকে চোখ ফেরাই। হলের ঐ ঘটনা নতুন না, সবাই জানতো কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনি। শিক্ষকদের বলা হলে তারা বলতো, এ নিয়ে তোমরা কেন চিন্তা করছো, তোমরা ভালো ছাত্র, বুয়েটে পড়ো। কিছু ছাত্র নষ্ট হয়ে গেছে, ওদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করো না। বরং আরো দুইটা নতুন প্রোজেক্ট বা কাজ করো, দেখবে এগুলো আর মনে থাকবে না।

এভাবে দিনে দিনে পুরো হলের ছাত্রদের মানসিক বিকালঙ্গ করা হয়েছে। আর ঐ অল্পকয়জন গুণধর দেখেছে, তাদের পেছনে বিশাল সাপোর্ট আছে। এই মানসিক অবসাদের যেই বেড়া তা অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রী ভাংতে পারে। সংখ্যায় কম বিধায় তারা সপ্তাহে ১-২ জনকে এভাবে পিটাতে দেখেও তাদের বলার সুযোগ ছিল না, আর যাদের কিছুটা বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো তারা নানাবিধ কারণে জেগে ওঠার আগেই স্তমিত হয়ে যেত।

তাই অামার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এই আপদ দূর করার উপায় হলো মেধাবীদের রাজনীতি সচেতন করে তুলতে হবে। ভালো মন্দ বুঝার মত মনন সৃষ্টি করতে হবে। পুস্তকের জ্ঞানের পাশাপাশি মননের জ্ঞান আহরণ করতে হবে। যখন একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী নেতৃত্বে আসবে, তখন ঐ না জানা ইতর রাজনৈতিক দর্শন জানালা দিয়ে পালাবে।

শিক্ষকদের আরও অনেক বেশি সহনশীল হতে হবে, কোন ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে গেলেই সে বখে যায় না, এটা অনুধাবন করতে হবে। আমার মতাবলম্বি বলেই তার জন্য সুপারিশ করতে হবে, আর না হলেই তার পদেপদে কন্টক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করতে হবে, এই চিন্তা ধারা থেকে বের হয়ে অাসতে হবে। শিক্ষকদের এটা অনুধাবন করতে হবে, শুধু পুস্তকের শিক্ষাই আসল শিক্ষা না, মননশীলতার, মানবিক শিক্ষাই আসল শিক্ষা। ভালো কাজে সাহস দিতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে, সেটা কঠিন পথ হলে কাঁধে কাঁধ রাখতে হবে।

শিক্ষকদের পাশাপাশি পরিবার, সমাজকেও একই ধারণা ধারণ করতে হবে। ভালো কাজে পাশে থাকতে হবে, মানসিক বিকাশের জন্য, মননের বিকাশের জন্য। তাদেরকে বুঝাতে হবে, নিজের জন্য না অন্যের জন্য বাঁচো। যেই বাঁচায় আনন্দ আছে, অন্যের ভালোবাসা আছে।



লিখেছেনঃ সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষাছুটি), ইটিই বিভাগ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।



কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? পর্ব-১

হানিফ সিদ্দিকীঃ নাবিক যদি না জানে সে কোন বন্দর খুঁজছে, তাহলে যে কোন বাতাসই তার কাছে সঠিক। রোমান দার্শনিকের বিখ্যাত উক্তিটির মধ্যে নিহিত আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধীরে ধীরে দিকভ্রান্ত হবার নিগুঢ় রহস্য। কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? কে চান? কারা চান? নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির চাওয়া? নাকি গোষ্ঠীর চাওয়া?

আমরা প্রায়শই এই জায়গাটিতে ভুল করি। চাপিয়ে দেই। এই চাপিয়ে দেওয়া থেকে তৈরি হয়- ব্যক্তি তুষ্টি, কিন্তু সামগ্রিক অপ্রাপ্তি ও অসন্তোষ। অবশেষে বিস্ফোরণ। তখন আবার সংস্কার করি। তাৎক্ষণিক সংস্কার। সংস্কার করি অন্যদেশের মডেল বা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি-বিশেষের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে। আবার সেই চক্র- অপ্রাপ্তি এবং অসন্তোষ। এই চক্রের মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি।



বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদান (Stakeholder) হলেন- শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিল্পকারখানা, সাধারণ জনগণ, সরকার, অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মকর্তা। এর মূলে কেন শুধু শিক্ষার্থী?



বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। কথাটি বলার পরে আমার সহকর্মী আমার উপর যেমনভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন, তখনি বুঝেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিয়ে হবে! বিশ্ববিদ্যালয় কেন শিক্ষার্থীদের জন্য- তা একটু খোলাসা করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ অংশীদান (Stakeholder) হলেন- শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিল্পকারখানা, সাধারণ জনগণ, সরকার, অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মকর্তা। এর মূলে কেন শুধু শিক্ষার্থী?

অভিভাবকগণ সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান তাঁদের সন্তান মানুষের মত মানুষ হবে বলে। পরিবারের দায়িত্ব নেবে বলে। এখানে অভিভাবক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সন্তানের মাধ্যমে যুক্ত। শিল্পকারখানাগুলো তাকিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে যেন তারা উপযুক্ত মানবসম্পদ পায় যার দ্বারা কলকারখানাগুলো সচল থাকবে। সমাজের চাহিদা মিটবে। এই চাহিদা মেটানোর কেন্দ্রে অবস্থান শিক্ষার্থীদের। সাধারণ জনগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কিভাবে সংযুক্ত?

একটি গল্প শুনুনঃ এক দেশে ছিলেন এক দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত দম্পতি। দিন আনে, দিন খায়। তাঁদের এক সন্তান। পড়াশুনা করে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্তানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে বাবামার কাছে ফেরত যায় এবং বলে- তোমরা আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছো। বড় করেছো। আমি কৃতজ্ঞ। এখন আমার জীবন চালানোর জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করে দাও। প্রিয় পাঠক বাবামার মনের অবস্থা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন? কে কার দায়িত্ব নেবার কথা ছিল?

বিষয়টি খোলাসা করা যাক। এই বাবামা হলেন আমাদের দরিদ্র-ঋণগ্রস্ত প্রিয় জন্মভূমি। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পেছনে বেশ কয়েক লাখ টাকার উপরে খরচ করে রাষ্ট্র যা সাধারণ জনগণের টাকা অথবা ঋণের টাকা। সাধারণ জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা স্পষ্ট। শিক্ষার্থীরা নিজেরা বোঝা না হয়ে অন্যদের বোঝা লাঘব করবে। জনগণের এই প্রত্যাশাটাও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। সরকার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের কথা ভেবে তার দক্ষ জনবল তৈরি করে।



কোন শিক্ষার্থী বলতে পারে নাই- বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সে কী ভাবছে। অভিভাবকের সাথে যোজন যোজন দূরের সম্পর্ক।শিল্পকারখানাগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে বলেন, তাদের চাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় প্রতিফলিত হয় না। সাধারণ জনগণের কোন মতামত প্রাধান্য পেতে কখনো শুনি নাই।



যেমন বর্তমানে আমাদের সামনে ভিশন ২০২১, এসডিজি ২০৩০, রূপকল্প ২০৪১ বা ডেল্টা ২১০০। আমরা তৈরি হচ্ছি। কাদেরকে তৈরি করছি? নিশ্চয় শিক্ষার্থীদের। তাহলে কী শিক্ষকদের ভূমিকা অস্বীকার করবো? মোটেও তা নয়। এই মহা কর্মযজ্ঞের কারিগর শিক্ষক। শিক্ষকের পেশা মানুষ বানানো। এটা তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্ব। কিন্তু রসদ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মানুষ করতে হবে বলেই শিক্ষক নিয়োজিত। কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষার্থীদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনায় মানুষ করার মধ্যেই নিহিত আছে রাষ্ট্রের কল্যাণ।

কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয় সমাজকে গতিশীল করার জন্য। কিন্তু কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? এর প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য জানতে হবে যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা আরও প্রতিষ্ঠান থাকে। যারা প্রত্যক্ষভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকে। তারা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অংশীদার হলেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিল্পকারখানা, সাধারণ জনগণ, সরকার, অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মকর্তা ইত্যাদি।

প্রথমতঃ তাঁরা কী চান? সমাজে ভবিষ্যতের চাহিদা কি? আমরা কোথায় পৌঁছতে চাই? এটি একমাত্রিক নয়। বরং বহুমাত্রিক। জরিপ, রাষ্ট্রের দিকদর্শন এবং বিভিন্ন নথি থেকে এটি পাওয়া যেতে পারে। একজন যোগ্য-বিজ্ঞ শিক্ষানুরাগী একটি বডির মাধ্যমে সমস্ত অংশীদারের উপর পরিচালিত জরিপ এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভাবনা বা দিকদর্শন রোমন্থন করে নির্যাস বের করবেন। সেই নির্যাসই হলো একটি প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন বা সংক্ষিপ্ত দর্শন। এটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু সম্পূর্ণ। থাকবে সময় অভিক্ষেপ এবং ভবিষ্যতের দিকদর্শন। যেমন দশ বছর পরে আমরা আমাদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কোথায় দেখতে চাই?

এটি হতে হবে নির্দিষ্ট কিন্তু চ্যালেঞ্জিং। এটি একটি সম্মিলিত স্বপ্ন। যাকে অর্জন করার জন্য সম্মিলিত এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা লাগবে। এমনি এমনিতে অর্জিত হবে না। যুদ্ধে সেনাপতি যোদ্ধাদের যেমন উদ্দীপিত করে, ভিশন কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের তেমনি উদ্দীপ্ত রাখে। এখন ভাবুন, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন কি আপনি জানেন? মানসিকভাবে ধারণ করেন? আপনাকে উদ্দীপ্ত রাখে? বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন নিয়ে কখনো ভেবেছেন?

এই ভিশনকে অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু সুপরিকল্পিত কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। যাকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করার মাধ্যমে তৈরি হয় মিশন। বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রকৃতি, সম্পদ ও বিশ্বাস অনুযায়ী এই মিশন তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠান কেন টিকে আছে- তার মর্মকথা থাকতে হয়। ৩টি প্রশ্নের উত্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় এই মিশন। ভিশন অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠান কি করছে? কার জন্য করছে? কিভাবে করছে?

এটি যেমন সকল অংশীদারের জন্য বোধগম্য হতে হয়, তেমনি হতে হয় উদ্দীপনামূলক। সকল অংশীদান অনুপ্রাণিত হবে। এর মধ্যে থাকবে ভিশন কেমন করে বাস্তবায়িত হবে। শব্দচয়নে থাকে প্রতিষ্ঠানের প্রমূল্য (মূল্যবোধ), প্রোডাক্ট, সার্ভিস, ভাবমূর্তি এবং কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার ইত্যাদি বিষয়াদি। এটি সংক্ষিপ্ত এবং স্বাতন্ত্র। আমার জানামতে, কিছুদিন পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাড়াহুড়া করে ভিশন ও মিশন তৈরি হয়েছে, কিন্তু বস্তুতপক্ষে অংশীদারদের মতামত সেখানে কোনভাবেই নেয়া হয় নাই। প্রতিফলন তো অনেক দূরের কথা।

কোন শিক্ষার্থী বলতে পারে নাই- বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সে কী ভাবছে। অভিভাবকের সাথে যোজন যোজন দূরের সম্পর্ক।শিল্পকারখানাগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে বলেন, তাদের চাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় প্রতিফলিত হয় না। সাধারণ জনগণের কোন মতামত প্রাধান্য পেতে কখনো শুনি নাই।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিষ্ঠানের (বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) মূল্যবোধ বা প্রমূল্য (Core Values)। এই মূল্যবোধ থেকেই মানুষ তৈরি হয়। মানবিক গুনের উন্মেষ ঘটে। মননশীলতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। রাষ্ট্র তথা সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলে। প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাস থেকে মূল্যবোধ বা প্রমূল্য তৈরি হয়। এটি একটি সংস্কৃতি বা কালচার তৈরি করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাগবিহীন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই সততার অনুশীলন করে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের যে কোন সমস্যাতে সাধারণ জনগণের মঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক মধুর। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ বিতর্ক হয়, এমনকি শিক্ষকগণও সেই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে। কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের কাছে হেরে শিক্ষার্থীর পিঠ চাপড়ে বলে- যোগ্য বাছা। শিক্ষার্থী আমাদের বহুকালের সংস্কৃতি অনুযায়ী মাথা নিচু করে সালাম করে- সমস্ত আপনার জন্যই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টি করে। এগুলোই মূল্যবোধ। যেখান থেকে অহংবোধের সৃষ্টি। এটিই প্রমূল্য।

প্রতিষ্ঠানের প্রমূল্য স্থাপন বা খুঁজে বের করে আনতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লালন করতে হয়। সবার সামনে উপস্থাপন করতে হয়। এটি যেমন প্রতিষ্ঠানের মৌলিকত্ব প্রকাশ করে তেমনি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্ব করে। সকল অংশীদার এই প্রমূল্যের জন্য গর্ব করে, তেমনি এটিকে লালন করে। লালন করতে হয় যেন বিনষ্ট না হয়। তিল তিল করে গড়ে তুলা এই প্রমূল্য প্রতিষ্ঠানকে স্বতন্ত্রভাবে সমাজে এবং বিশ্বপরিমন্ডলে পরিচিত করে তুলে। সাধারণত প্রমূল্য হিসেবে কী কী থাকতে পারে?

যেমনঃ বিষয়ভিত্তিক চরম উৎকর্ষতা বা গুণ, সততা ও নিষ্ঠা, মননশীলতা ও মানবিকগুণ, সৃষ্টিশীলতা ও সংস্কৃতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা, শ্রদ্ধাবোধ, টীমওয়ার্ক ইত্যাদি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও প্রমূল্য লিখিত আছে শুনি নাই। কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে আলোচিত হয়- জানিনা। তার মানে কি আমাদের গর্ব করার মত কিছু নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে সকল অংশীদার তা জানিনা বলেই লালন করতে পারি না বা চর্চা করার ব্যাপারে মনের ভেতর থেকে চাপ অনুভব করি না। অর্থ্যাৎ আমাদের বিবেককে শানিত করতে পারি না।

শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করতে সহায়তা করে। সর্বোপরি, নিজস্ব প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকে নিজেদের সমস্যা সমাধানের যে শিক্ষা তা হলো আমাদের জমিত শিক্ষা। আমাদের নিজস্ব বা সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা সমাধান করার ব্রত তৈরি হয় জমিত শিক্ষায়।

শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান দোষের নয়। কিন্তু শুধুমাত্র বিদেশী চাহিদা পূরণ করার জন্য যে শিক্ষা তা আমাদের বিশেষ উপকারে লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশ্বের বিশেষ জ্ঞান আহরণ করে দেশের সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে বিশ্বসমাজে নিজেদের উপস্থাপন এবং নিজেদের ও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা। যুক্তি আমাদের সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিকে শানিত করে।

পরমতসহিষ্ণুতা আমাদেরকে সঠিক পথ বেছে নিতে সহায়তা করে। যুক্তি ও পরমতসহিষ্ণুতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ। উপরন্তু, মৌলিক জ্ঞানের উৎপত্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় উদ্দেশ্য। কিন্তু যুক্তি ও পরমতসহিষ্ণুতা ব্যতিরেকে মৌলিক জ্ঞানের উৎপত্তি যেমন সম্ভব নয় তেমনি প্রমূল্য বা মূল্যবোধ তৈরি হতেও পারে না।

লিখেছেনঃ অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, সিএসই বিভাগ, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ মুক্তি পাক

আবরার ফাহাদ! বুয়েট ক্যাম্পাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর একজন ছিলো সে। কাল থেকে দেশের মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত নাম। কিন্তু কেনো? কারন তার উপর করা বর্বরোচিত আঘাত এবং তারই ফলশ্রুতিতে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে প্রস্থান ঘটেছে ছেলেটির।

কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, নটরডেম থেকে বুয়েটের ইইই। দেশসেরা ছাত্রদের একজন। বুয়েটের মত প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য তার নিজের, বাবা-মা’র, শিক্ষক সহ কতজনের কত শ্রম ছিলো, সবকিছু মাত্র ক’ঘন্টার ব্যবধানে পন্ড হয়ে যাবে কে ভেবেছিলো! কি দুর্ভাগা তার বাবা-মা!



বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ মুক্তি পাক


কত স্বপ্নের বীজ বপন করে রেখেছিল পরিবারটি। ভেবেছিলো এইতো কিছুদিন পর পরিবারের হাল ধরবে, সবার মুখে হাসি ফোটাবে। নরপিশাচরা একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে অতি জঘন্য ভাবে সব স্বপ্ন শেষ করে দিলো।

আবরারের বাবার স্টেটমেন্ট শুনলাম। যেখানে উনি বলছেন “আমাদের পরিবার আগাগোড়া নৌকায় ভোট দেই!”

মাত্রই মারা যাওয়া পুত্রশোকে কাতর বাবাকে পরিবারের রাজনৈতিক সমর্থনের পরিচয় দিয়ে বিচার চাইতে হয়! হায়! কোন দেশে আমরা আছি! কেনো শুধুমাত্র ভিন্নমত ধারণ করার কারনে কারোর জীবন চলে যাবে? কেনো এসব দিনেদিনে বাড়ছে? স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতকের কাছাকাছি সময়ে এসে এমন পরিনতি কি আমাদের কাম্য ছিলো? সত্যিকার অর্থেই ভাষাহীন হয়ে গেছি!

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের দেশের ক্যাম্পাস গুলোতে অহরহ ঘটেছে। বিচারের জন্য অনেকেই হন্যে হয়ে ঘুরেও ন্যায়বিচার পায়নি।



ছেলেটি বুয়েটের না হয়ে গ্রামের কোনো এক কলেজের হলে কি এমন শোরগোল শোনা যেতো? এতো লিখালিখি বা নিউজ হতো? আমি নিশ্চিত হতো না।


কেনো ঘটছে এমন ঘটনা। সমাজে মানুষ বড় হয় মানবিকতা ও যুক্তিতর্কের মাঝে। আজকাল এই দুটি গুণ অনেকের মধ্যে দেখা যায় না। কণ্ঠরোধের সংস্কৃতি একটা দেশকে দিনকে দিন পিছিয়ে দিতে পারে কারন যেখানে তর্ক নেই সেখানে উন্নয়নের সুযোগ সীমিত। মানবিকতা গড়ে ওঠে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। অর্থ উপার্জন ও সামাজিক স্ট্যাটাস অর্জন মূখ্য উদ্দেশ্য হতে পারেনা। প্রতিষ্ঠান মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। যার ফলশ্রুতিতে মানসিক বিকারগস্ত মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। সাথেসাথে ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার ও শো-অফ মানসিকতাও অনেকাংশে দায়ী।

শুনলাম অমিত সাহা নামের একজনের রুমে অবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যায় সবচাইতে নিষ্ঠুর ভূমিকা পালন করে বলে খবরে এসেছে। কিন্তু তার নাম এজাহার থেকে বাদ, গ্রেফতারও হয়নি, ছাত্রলীগ ১১ জনকে বহিষ্কার করেছে, সেখানেও তার নাম নেই। হয়তো আরেকটি বিচারহীনতা দেখতে যাচ্ছে দেশ। এমন তো হবার কথা নয়।

আজ ছেলেটি বুয়েটের না হয়ে গ্রামের কোনো এক কলেজের হলে কি এমন শোরগোল শোনা যেতো? এতো লিখালিখি বা নিউজ হতো? আমি নিশ্চিত হতো না। তার অর্থ একটা ঘটনা যতক্ষণ না দেশের সবার কাছে পৌঁছাতে পারছে ততক্ষণ সবাই নিরব থাকছি, ততক্ষণ বিচার ঠিকমত হবে কি না তা নিয়ে আশংকায় থাকছি।

কিন্তু আমরা আশাকরি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশ মুক্তি পাক। দেশের বিরাজমান বিচারব্যবস্থায় যে শাস্তির বিধান রয়েছে তার সবকিছুর প্রয়োগ হোক। আমরা চায়না এমনভাবে আর কোনো মা’য়ের কোল খালি হোক। ক্যম্পাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চরিত্র ফিরে পাক। সুষ্ঠু লেখাপড়া ও গবেষণার পরিবেশ দ্রুতই নিশ্চিত হোক।

লেখকঃ নাসির উদ্দিন, প্রধান সম্পাদক, দ্য ক্যাম্পাস টুডে।

পরিবারই হচ্ছে ভালো-মন্দের চাবিকাঠি

ফাতেমা সুলতানাঃ উঁচু দালানে বসবাস, সুন্দর পোশাক, খুব ভালো কোনো ইন্সটিটিউট থেকে পড়া, কথার মাঝে কিছু ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ এই হলো আজকের দিনের মানুষের ভালো বা মন্দ হওয়ার মাপকাঠি ; স্মার্ট বা আনস্মার্ট হাওয়ার মাপকাঠি।

আমি বলি কি মানুষ ভালো বা মন্দ যা কিছু হয় তার পরিবার থেকেই হয়। জন্মের পর থেকে প্রথম তিন বছর তার ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট হয়(কিছু রিসার্চে এসেছে) এরপর সে ষোলো বা আঠারো বছর পর্যন্ত পরিবার থেকে যা শিখে সারাজীবন ওটাই ভিতরে ধারণ করে। হুম, কিছু পরিবর্তন হয় ইউনিভার্সিটি লাইফে কিন্ত সেটা দিয়ে এক ছাঁদের নিচে থাকার যে অভিজ্ঞতা, তা যাচাই করা যায় না।

মানুষ বাইরে তার বন্ধুদের সাথে যেমন আচরণ করে, বাসায় তার মা/বাবা, ভাই -বোন, স্বামী/স্ত্রীর সাথে তেমন আচারণ কখনোই করে না। কারন বাইরের শিক্ষা আর ঘরের শিক্ষা কখনোই এক না। ফলে আচারণ ও এক না। পরিবার, বিশেষ করে বিবাহিত জীবন সম্পুর্ণ ভিন্ন একটি অভিজ্ঞতা। তাই আমার মতে একটা মানুষের ভালো মন্দ যাচাই শুরু করা উচিত তার পরিবার থেকে, তার সার্টিফিকেট বা আউটফিট দেখে নয়।

আমার কথায় অনেকেই দ্বিমত পোষন করতে পারেন কিন্তু নিজেই একবার ভেবে দেখুন আপনার নিজের সাথে কথাগুলি মিলে যাচ্ছে!! উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে আমার মঝেই একটা খুব খারাপ গুণ আছে। হুম, আমি গুণটা কেই খারাপ বলছি (তার ও অনেক ব্যাখ্যা আছে) সেটা হলো মিশুক হওয়া ; আর একটা খারাপ অভ্যাস ও আছে তা হলো রাগ! এই দুটাই উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবার থেকে পেয়েছি যেটা আমার সার্টিফিকেট আর অনেক সেল্ফ সেন্টার্ড সারাউন্ডিং ও চেন্জ করতে পারিনি।

লেখকঃ প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি)