মালিকদের বাস ভাড়া বৃদ্ধির চাপে তাপে কেন গলে BRTA?

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আজ বাসা থেকে বের হয়ে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট বাজার করার জন্য যাচ্ছিলাম। রিকশা চালক ছিলেন বাবুল মিয়া। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। লক ডাউনে অসুস্থতার কারণে তাঁর বাড়ি যাওয়া হয়নি এবং ধার দেনা করে ঢাকায় থেকেছেন।

গত ৭ দিন যাবৎ আবার রিকশা চালাচ্ছেন। কিছু দিন ঢাকায় কাজ করে বাড়িতে যেয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে আম বাগানে কাজ করবেন বলে পরিকল্পনা করেছিলেন। সে গতকাল শুনছে ১লা জুন থেকে অর্ধেক সিট খালি রাখার শর্তে বাস-মিনিবাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভাড়া নির্ধারণ কমিটি।

আমাকে বললো, স্যার আমার পক্ষে ধার দেনা পরিশোধ করে প্রায় ডাবল টাকা বাস ভাড়া দিয়ে বাড়িতে যাওয়া কী সম্ভব? বাস সার্ভিস চালু হলে ঢাকা থেকে লাখ লাখ দিন মজুর ঢাকা ছাড়বে এবং গ্রাম থেকে ঢাকা আসবে।

সত্যিই আজ পরিবহন মালিকদের প্রভাবে বিআরটিএর মতো দুনীর্তিবাজ প্রতিষ্ঠান বাবুল মিয়ার মতো দিনমজুরের কথা ভুলে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

বিআরটিএ কী ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিষ্ঠান হলে বাস ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা যাত্রীদের উপর চাপিয়ে মালিকদের ভাড়ার নেওয়ার লাইসেন্স দেয়? এমনকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে—এইটার নিশ্চয়তা দেয়নি বিআরটিএ। বাস ভাড়া একবার বাড়ালে দেশের ইতিহাসের কমানোর কোন নজির আমি দেখি নাই। সুতরাং কোন রকম পর্যবেক্ষন ছাড়া কতিপয় প্রভাবশালী পরিবহন মালিকদের চাপে শুরুতেই বাস ভাড়া বাড়িয়ে বিআরটিএ প্রমান করলো। সাধারন যাত্রীদের কথা ভুলে তারাও ভাড়া বৃদ্ধির চাপে ও তাপে গলে যেতে পারে।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে সরকার। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক আদেশে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়। এরপরই স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনা নিয়ে গতকাল শুক্রবার বাস ও লঞ্চ মালিকদের নিয়ে আলাদা বৈঠক করে বিআরটিএ ও বিআইডব্লিউটিএ। তবে বিআইডব্লিউটিএ ও রেলপথ মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাবার যোগ্য যে, তারা যাত্রীদের কোন ভাড়া বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়নি।

খবরে কাগজে পড়লাম বিআইডব্লিউটিএ বলছে, লঞ্চমালিকেরা কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছেন, তাঁরা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করছেন—এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি আসে। হুট করে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হলো আর তাঁরা গাদাগাদি করে যাত্রী তুললে তো কোনো উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না। এই সিদ্ধান্তটি বিআরটিএ নিতে পারতো। মালিকেরা তা মানছেন কি না, সেটা দেখে ভাড়া বাড়ানো যেত কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) এ বিষয়ে কবির মতো নীরব ছিলেন বলে সংবাদ মাধ্যমে আমি জানতে পেরেছি।

বিআরটিএ যে, হিসাব করে ভাড়ার খসড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখলেও লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পরিবহন মালিকেরা ‘সিটিং সার্ভিস সহ নানা নামে আগে থেকেই শতভাগ বা এরও বেশি ভাড়া আদায় করে আসছেন।

রসিক যাত্রীরা ‘সিটিং সার্ভিসকে বলেন ‘চিটিং সার্ভিস। নতুন করে ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া সেই আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গেই যুক্ত করে আদায় করবেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।

অন্যদিকে দূরপাল্লার বাসের মধ্যে সরকার শুধু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণবিহীন (নন-এসি) বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। বিলাসবহুল ও এসি বাসের ভাড়া মালিকেরা নিজেরাই ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা-জোগানের ওপর ভাড়া নির্ভরশীল। এসব বাসের ভাড়া আগে থেকেই এত বেশি যে কখনো কখনো ২০-৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকলেও তাঁদের লোকসান গুনতে হয় না। সবার জন্য ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া দূরপাল্লার পথের নন-এসি বাসগুলোও সব সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে। ফলে এখন ৮০ শতাংশ বাড়তি মানে হচ্ছে আগের বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও ভাড়া বাড়ানো।

বিআরটিএ সূত্রে আমি যতটুকু জানি, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস ক্রয়, ব্যাংক ঋণ, জ্বালানি খরচসহ ২০ ধরনের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো একটা উপকরণের ব্যয় বাড়লেই ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ডিজেলসহ কোনো কিছুর ব্যয় বাড়েনি বরংচ কমেছে। এ ছাড়া বাসের ভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ করার রীতি আছে। সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে ভাড়া কম বাড়িয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ কমানো যেত।

পরিবহন মালিকদের কাছে মনিটরিং থাকায় এখন যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হতে পারে। এমনকি বাসে বাড়তি যাত্রী পরিবহন করা হতে পারে। কারণ, অতীতেও তা-ই হয়েছে। জ্বালানী তেলের দাম বাড়ার আগেই বাসের ভাড়া বেড়ে যায়। কিন্তু তেলের দাম কমলে বাসের ভাড়া কমে না। ফলে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শুধু যাত্রী কম বহনের আশ্বাসের ভিত্তিতে সেটির কোন ভিত্তি নেই বললেই চলে।

করোনাকালে যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ অনেক দেশে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে লন্ডনে বাস সেবা চালু রয়েছে। অথচ সেখানেও বাস চালকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়েছে কিন্তু বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন সেক্টরে বেসরকারি সংস্থার ওপর ভরসা করেই জনসাধারণকে চলাচল করতে হয়। বেসরকারি খাতের অধীনে চললেও গণপরিবহন হওয়ার কথা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের আওতায়।

কিন্তু এখন তা ব্যক্তিপর্যায়ে চলে যাওয়ায় রয়েছে অসংখ্য মালিক-শ্রমিক। গঠন হচ্ছে নানা সংগঠন। এর ফলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, পেশি-শক্তি ও অবৈধ লেনদেনের পথ তৈরি হয়েছে। এই বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মালিক বেশির ভাগই প্রভাবশালী নেতা। কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়। তাঁরা খুব কম সংখ্যক বাস নামিয়ে কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে যান। এরপর সাধারণ মালিকেরা তাঁদের অধীনে বাস চালাতে দেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে দৈনিক ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এটাকে জিপি বা গেট পাস বলা হয়। এভাবে পরিবহন খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। চাঁদাবাজি বন্ধ না করা গেলে ভাড়া বাড়িয়ে লাভ হবে না। কারণ, লাভের টাকা থাকে চাঁদাবাজদের পকেটে। চাঁদাবাজি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভাড়া না বাড়িয়ে লাভ করা সম্ভব ।

গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলার জন্য মূলত দায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষ। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে নতজানু নীতির কারণে পরিস্থিতি এখন সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যে কোনো অন্যায় দাবি আদায় করে আন্দোলনের মাধ্যমে। এ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। গণপরিবহন এখন গণ-মালিক। এটি বড় সমস্যা। সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি যাত্রী চাহিদা পূরণে অপ্রতুলতা একটি অন্যতম কারণ। এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা ডাবল ডেকার ছিল সাধারণ যাত্রীদের প্রথম পছন্দের যান।

অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে অনেক রুটে বিআরটিসির বাস বন্ধ করা হয়েছে। আন্ত:জেলা রুটে বিআরটিসির কিছু বাস চলাচল করলেও সেগুলোতে সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতির অংকই বেশি। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিতে পারে। এখন যে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে, তা আর কোনো দিন কমানো যাবে না। এছাড়া পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা তথা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পেশাদারিত্ব, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। রেগুলেটরি কমিটিতে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বা ধারণা নেই। এসব কারণেই পরিবহন খাতকে গ্রাস করছে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম।

অনেক আগে থেকেই সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী নেতারা যা দাবি করেন সরকারকে তাই মেনে নিতে দেখে আসছি। পরিবহন সেক্টরের কথা আসলেই মনে পড়ে যায় কবি শামসুর রাহমানের কবিতার লাইনের মতো ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। রাজনৈতিক বেশধারী পরিবহন মালিকরা নিজেদেরকে মনে করছেন তারা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। এবার যেন এটি না হয়ে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। আর এবারও করোনার মহামারিতে যদি মালিকরা নিজেরাই বাস ভাড়া নির্ধারন করে। তাহলে যাতে ফসলের দাম নির্ধারন করার জন্য কৃষকদেরকেও নির্দেশ দেওয়া হয়।

স্কুল জীবনে পড়েছিলাম পদার্থের সংজ্ঞা- যার আকার আছে, আয়তন আছে, স্থান দখল করে এবং বল প্রয়োগ করে বাধার সৃষ্টি করে।

আজকে তাই মনে হয়েছে পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয় নামের আকার ও আয়তন আছে, সরকারি সংস্থাকে চাপ দিতে পারে ও বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং পরিবহন সেক্টরে স্থান দখল করে আছে তারাই আজ সমাজের পদার্থ। আমরা সাধারন জনগন পদার্থের সংজ্ঞা ও ধরন পড়ে আজ নিজেরাই বায়বীয় পদার্থ। জনগন বিচ্ছিন্ন থাকে সর্বদা যাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে কোন ধরনের অবস্থান নেই। এক্ষেত্রে কেউ আমাদের অপদার্থ বললেও মাইন্ড করবো না।

আরেকটি বিজ্ঞানের কথা মনে আছে, পদার্থ ও শক্তি একটি অন্যটিতে রূপান্তরযোগ্য, সুতরাং এগুলি একই সত্তার দুই ভিন্ন রূপ। বর্তমানে বাস মালিকগণ পদার্থ হিসেবে রাজনৈতিক পরিচয়ে সর্বোচ্চ শক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে। নিউটনের গতিসংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী, জড়তা হল পদার্থের সেই ধর্ম যার কারণে বাইরে থেকে এর স্থিতিশীল বা গতিশীল অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে পদার্থটি তৎক্ষণাৎ অবস্থা পরিবর্তন করে না। আর সেটি হলো আমরা সাধারন জনগন। যারা চিৎকার করতে পারি দূর থেকে কিন্তু পরিবহন সেক্টরের অরাজকতা পরিবর্তন করতে পারি না।

পদার্থের আর বিষয় হলোঃ বায়ু মন্ডলে তাপ ও চাপ বৃদ্ধি পেলে নির্দিষ্ট একটি পদার্থ গলে যায়। সেই পদার্থের সাথে অন্য উপাদান মেলালে এর গলনাংক কমানো-বাড়ানো যায়। সুতরাং আজকেও দেখছি মালিক পক্ষের অপরাজনীতির চাপ ও তাপে বিআরটিএ গলে দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে হারে বাস ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ করে যাত্রীদের উপর চাপানোর চেষ্টা করছে।

কিন্তু এভাবে বাস ভাড়া বৃদ্ধি করে আর কতদিন যাত্রীদের জিম্মি করবে মালিক ও কর্তৃপক্ষ?


লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ।