অনলাইন ক্লাস ও শিক্ষক ড. মাহাদীর ভাবনা 

করোনা মহামারীর ভয়াল থাবায় থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। এর মধ্যে সব শ্রেণির মানুষের মতো খারাপ অবস্থার সম্মুখীন শিক্ষার্থীরা। তবে অনলাইন ক্লাস সমস্যা সমাধান দেখাতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

অনলাইন ক্লাস নিয়ে দ্য ক্যাম্পাস টুডের কুবি প্রতিনিধি রুদ্র ইকবালের সাক্ষাৎকারে থাকবেন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মাহাদী হাসান।

অনলাইন ক্লাসের জন্য কতটা উপযুক্ত বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা?

বাংলাদেশের বেশিরভাগ জায়গা (বিশেষকরে নগরগুলোতে) থেকে এখন ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যায়। তবে এটাও সত্য যে কোন কোন এলাকায় ইন্টারনেটের অবস্থা ভালো না।

এর চেয়ে বড় সমস্যা হলো ইন্টারনেটের মূল্য অনেক বেশি যার জন্য অনেক শিক্ষার্থী হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর অর্থনীতির এই খারাপ সময়ে পাবলিক ও প্রাইভেট সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যই শিক্ষাখাতে বাড়তি ব্যয় কষ্টসাধ্য।

আপনি কি মনে করেন, পরিকল্পিত ভাবে ব্যবস্থা নিলে অনলাইন ক্লাস সফল হবে?

হ্যাঁ, বাস্তবমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস সম্ভব। সরকার চাইলে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা ও প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য শিক্ষার্থীদের দিতে পারে। অথবা সরকার শিক্ষা লোনও দিতে পারে শিক্ষার্থীদের।

তারা চাকরি জীবনে গিয়ে বা সুবিধামত সময়ে তা পরিশোধ করতে পারবে। এই লোন-কে ব্যয় না মনে করে দেশের জন্য বিনিয়োগ মনে করতে হবে। এর জন্য অল্পসময়ের মধ্যে একটা ডাটাবেইজ তৈরি করে সত্যিকারভাবে যাদের প্রয়োজন তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারে।

আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে আমরা যেন পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে দীর্ঘমেয়াদী সেশন জ্যামে ফেলে না দেই। পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি কেবল সবল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব। তাছাড়া SDG4 অর্জন করতে হলে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই।

আপনি জানেন যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সফল হতে পারবে?

অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সফল হতে পারবে। প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা দেখা দিবে সত্য। তবে পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে গেলে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমাধান সম্ভব। যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সফলভাবে একটা সেমিস্টার অনলাইনে শেষ করে নতুন সেমিস্টার শুরু করতে যাচ্ছে, এ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রেরণা পেতে পারে।

তবে এটাও সত্য যে কিছু কিছু শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাস করাটা দুঃসাধ্য হবে যদি ফ্রি ইন্টারনেট ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস সরবরাহ করা না হয়। আমি মনেকরি সরকার এ বিষয়ে সমাধানের পথ খুঁজছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনলাইনে ক্লাস দেয়াটা শিক্ষকদের জন্য জটিল হবেনা যদি ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ উদ্যোগে শিক্ষকদের জন্য অনলাইন ক্লাস বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করে।

আমার জানামতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষক আছেন যারা অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে পারবেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস মনিটরিং সেল স্থাপন করা এখন অপরিহার্য।

উল্লেখ্য যে ইতোমধ্যে বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন এবং অনলাইন ক্লাস মনিটরিং সেল টিম রেখেছেন যাতে করে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমেই ভালোভাবে মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব হয়। গুনগত শিক্ষাই শক্তি।

করোনার আগেও প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট ছিল। অনলাইন ক্লাস যদি সমাধান হয়, আগের সেশনজটের কারণ কি?

আমি পাবলিক ও প্রাইভেট দুই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। এখন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট নেই। আমি মনে করি যেখানে সেশনজট বিদ্যমান সেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক – উভয়পক্ষের দায় আছে। তবে এটাও সত্য যে শিক্ষক যদি পারফেক্ট মডেল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও গতিশীলতা আসবে।

একজন শিক্ষক যদি তার রুটিনের সবগুলো ক্লাস না দেন, পরীক্ষার উত্তরপত্র সময়মত এক্সামিন না করেন এবং ফলাফল তৈরিতে গড়িমসি করেন, তাহলে সেশনজট তো বেড়েই যাবে। এমন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে একটা সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশ করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই দায়বদ্ধতার জায়গায় শিক্ষকদের না আনতে পারলে অনলাইন বা ফেইস-টু-ফেইস উভয় পদ্ধতিতেই সেশনজট থাকবে।

শিক্ষকের কাজ শিক্ষাদান ও গবেষণা করার মাধ্যমে সমাজের জন্য নতুন নেতৃত্ব তৈরি করা। কিন্তু ক’জন শিক্ষক তা করছেন, এর হিসেব আমার জানা নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জবাবদিহিতার জায়গাটা আছে কারন এখানে শিক্ষার্থীরা প্রত্যক্ষভাবে টিউশন ফি প্রদান করে থাকে।

আমার প্রশ্ন হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অর্থ সরকার ব্যয় করে থাকে সেই অর্থ তো জনগণের-ই। তাহলে সেখানে শতভাগ জবাবদিহিতা তৈরি করতে সমস্যা কোথায়?

আমাদের সকল শিক্ষকদের ভাবতে হবে- আমরা কারো না কারো ট্যাক্সের টাকায় বেতন পাই। আমরা যেন আমাদেরকে শিক্ষক ও দেশের সেবক ভাবতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, অন্য কিছু নয়।

সর্বোপরি ড. মাহাদী অনলাইন ক্লাস নিয়ে আপনার বক্তব্য কি? কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

আমি মনে করি অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই। অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু করতে হবে যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে। আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে

অনলাইন ক্লাসে যেন কোয়ালিটি এডুকেশন পায় শিক্ষার্থীরা। কারন কোয়ালিটি এডুকেশন ব্যতিরেকে নামকাওয়াস্তে ক্লাস উল্টো আমাদের পিছিয়ে দিবে। চেষ্টা করতে হবে শিক্ষার্থীরা যেন ম্যাক্সিমাম বেনিফিট পায় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে। Google Classroom, Google Meet, Zoom সহ অনেক new media tools রয়েছে অনলাইন ক্লাসের জন্য।

প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক তার পছন্দসই tool এর মাধ্যমে ক্লাস দিতে পারেন। উত্তরপত্র মূল্যায়নও অনলাইনে সম্ভব যদি সেভাবে পরিকল্পনা করা যায়। এখন Emergency Education এর পরিস্থিতি তাই শিক্ষার্থী ও শিক্ষক- উভয়পক্ষের উচিত কালবিলম্ব না করে ক্লাসে ফিরে যাওয়া। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকলে মানসিকভাবে পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী। আর এসব শিক্ষার্থীদের পুনরায় ক্লাসে ফিরিয়ে আনা আরো কঠিন হয়ে যাবে।

তাই এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিভাবে অনলাইন ক্লাস শুরু করা যায়। আমাদের শিক্ষার্থীদের যারা মানসিকভাবে অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রস্তুত নয়, তাদেরকে বুঝানোর দায়িত্ব শিক্ষক হিসেবে আমাদের-ই কারন শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সাথে সাথে আমি আমার শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্বও নিয়েছি।

ক্লাসরুম ও ক্লাসরুমের বাইরেও আমার শিক্ষার্থীদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব রয়েছে আমার। আর এই সংকটে আমি এগিয়ে না গেলে আমার শিক্ষার্থীরা কার কাছ থেকে প্রেরণা পাবে শিক্ষাগ্রহণের?

পাশাপাশি আমাদেরকে ভাবতে হবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে। দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে নিয়ে বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।

করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে যে দেশ এগিয়ে থাকবে, তারাই বিশ্ব অর্থনীতি ও অন্যান সূচকে এগিয়ে থাকবে আগামীতে।

Scroll to Top