ডঃ শেখ মাহাতাবউদ্দিন
বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থীর জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর ধাপ হল এস এস সি এবং এইচ এস সি পরীক্ষা। এই দুইয়ের তুলনাতে আবার এইচ এস সি কেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলতে হবে। অনেকই দ্বিমত করতে পারেন কিন্তু আমেরিকা জাপান ঘুরে এসেও এই এইচ এস সি এর ফলাফল নিয়ে আমাদের যে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকে এইচ এস সি কে ছোট করে দেখা মানে বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে স্বল্প জানা সমার্থক শব্দই হবে।
তাই এই পরীক্ষা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের খুব সাবধানে নিতে হবে। তা না হলে আমরা ২০০১ এস এস সি এবং ২০০৩ এইচ এস সি ব্যাচ যেভাবে বিনা দোষে আজও অপরাধবোধের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে পথ চলছি তেমনি এইচ এস সি ২০২০ ব্যচও তাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নীতিনির্ধারকগণের করা ভুলের মাশুল গুণতে বাধ্য হবে।
২০০১ সালে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার হলে গিয়ে জানতে পারি যে আমাদের ফলাফল গ্রেডিং সিস্টেমে হবে। উহা কি বা কিভাবে ভালো গ্রেড পাওয়া যাবে তা তো অলীক কল্পনার বিষয় ছিল, এমনকি আমাদের শিক্ষকগণও গ্রেডসিট দেখে ফলাফল ঘোষণা করতে হিমসিম খেয়েছিলেন! যে পেয়েছে “এফ”গ্রেড তাকেও দেখেছি“এ+” পেয়েছে মর্মে ঘোষণা শুনে মিষ্টি বিলানোর পরেই জানতে পারল যে সে আসলে দুই বিষয়ে ফেল করেছে! একটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের পদ্ধতি বদলের পূর্বে আমাদের কত পরিপূর্ণ প্রস্তুতি ছিল এই ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয়!
সে যাই হোক, আমরা ২০০১ সালে সারা বাংলাদেশে ৭৬ জন এ+ এবং ২০০৩ এইচ এস সি তে মাত্র ২০ জন এ+ প্রাপ্ত ব্যাচ। যে ব্যাচে বরিশাল বোর্ডে কেউই এ+ তো পায় নাই বরং যতদূর মনে পরে ৩.০০ পর্যন্ত পেয়েছিল মাত্র ৪৮৫ জনের মত! অথচ একটা বোর্ডে এরে চেয়ে বেশী স্টার মার্কস ও পেত নাম্বার সিস্টেমে!
ফলাফল যা হবার তাই হল, ২০০৭/০৮ সালের দিকে দেখি সবাই ৫.০০ স্কেলে ৪/৪.৫ কে প্রথম শ্রেণী বলে চাকুরির বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করল। আমাদের ঢাকা কলেজের বন্ধুরা শুরু করল আন্দোলন কারণ এই ৪.০০/৪.৫০ স্কেল থাকলে আমাদের ব্যাচের ৯০% শিক্ষার্থী কোন চাকুরিতে আবেদন করতেই পারবে না! আন্দোলনের দিনই আমাদের ঢাবি এর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন এ বাংলাদেশের প্রাইমারী, সেকেন্ডারি এবং টারসিয়ারি লেভেলে রসায়ন শিক্ষা নিয়ে আয়োজন করা ওয়ার্কশপ ছিল।
সেখানে তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব কোনভাবে জানতে পারলেন আমরা ২০০১ ব্যাচ এবং আমাদের দুই তিনজনকে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের দাবী কি এবং এর যৌক্তিকতা কি? আমরা সব বুঝিয়ে বলার পর উনি কথা দিলেন উনি এই বিষয়টি গুরুত্ব সহ দেখবেন। উনি উনার কথা রেখেছিলেন এবং আমাদের ও আমাদের পরের ব্যাচের জন্য ৩.০০ কে প্রথম বিভাগ ফলাফলের মর্যাদা দেয়া হয়। পরিতাপের বিষয় ঐ প্রজ্ঞাপন কেবল সরকারী কাগজ হিসেবেই রয়ে গেছে অদ্য পর্যন্ত, কোথাও এই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিজ্ঞাপন হয় না কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যতীত!
সুতরাং, একটি ব্যাচের পাবলিক পরীক্ষা বা এই সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তনের পূর্বে আমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া একান্ত কর্তব্য। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম পরিস্থিতি খারাপ হলে এইচ এস সি পরীক্ষা বাতিলও হতে পারে। আবার দীপ্ত টিবির লাইভে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বললেন ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থী কম হয়াতে ওদের পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। খুবই যৌক্তিক কাজ এবং পরীক্ষা বাদে গ্রেডিং করার মত অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে এর চেয়ে ভালো কোন মাধ্যম নেই। অর্থাৎ এইচ এস সি পরীক্ষাও নিতেই হবে এবং সেটা কার্যকর স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হতে হবে।
আমি নীতিনির্ধারকগণের কেউ নই। এর পরেও নিজের ৪ বছর সক্রিয় স্কুল কলেজের শিক্ষকতা এবং ৭ বছরের অধিক বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের শিক্ষা এবং গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে একটি কার্যকর পদ্ধতি প্রস্তাব করতে চাচ্ছি। যা অন্তত ২০২০ ব্যাচকে আমাদের মত সারাজীবন ব্যাপী এক অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের বলী হওয়া থেকে রক্ষা করতে সহযোগিতা করবে বলেই বিশ্বাস করি।
যে যুক্তিতে বা যে বিষয়ের উপর ভরসা করে আমরা এ এবং ও লেভেলের পরীক্ষার অনুমতি দিচ্ছি সেই যুক্তিকেই যদি কাজে লাগাই তবেই যৌক্তিক সমাধান সম্ভব হবে। আমরা সকলেই জানি আমাদের প্রায় সকল কলেজ গুলো সুসংগঠিত। প্রতিটি কলেজে অন্তত প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা থাকছে। সুতরাং এই অবকাঠামো ব্যবহার করেই আমরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা নিয়ে নিতে পারি এবং তা শীত আসার পূর্বেই। পরীক্ষা নিতে আমাদের নিচের বিষয় গুলো নিশ্চিত করতে হবে-
১। সামাজিক দূরত্ব এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা: যেই কলেজের শিক্ষার্থী সেই কলেজেই পরীক্ষা দিবে ফলে এক বেঞ্চে একজন বা নিরাপদে ৪ ফিটের মত দূরত্ব রেখে বসতে পারবে। কোন অভিভাবক পরীক্ষার হলে আসবেন না, ভীর কমে যাবে।
২। প্রশ্নপত্রের বৈষম্য এবং সহজলভ্যতাঃ প্রতি বোর্ডের জন্য পূর্বের নিয়মেই প্রশ্ন তৈরি হবে। এর মধ্যে কোন সেটে পরীক্ষা হবে তা কেবল পরীক্ষার দিন সকালেই বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয় দৈবচয়ন ভিত্তিতে ঠিক করবেন এবং পরীক্ষা শুরুর ৩ ঘণ্টা পূর্বে সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউ এন ও সাহেব কে জানিয়ে দিবেন। উনার দেয়া তথ্যে পূর্বে পাসওয়ার্ড প্রটেক্ট করা ফাইলের পাসওয়ার্ড থাকবে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঐ পাসওয়ার্ড দিয়ে ফাইল খুলে প্রশ্নের প্রতিটি কপি নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট পূর্বে প্রতিটি কলেজের অধ্যক্ষের নিকট হস্তান্তর করবেন।
৩। একই কলেজে পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীদের অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়ঃ যদিও এমন একটি পয়েন্ট লিখতে নিজে শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত। এরপরেও বাস্তবতা অস্বীকার করে চলা যাবে না, যেহেতু আমাদের এই পেশাতে ইদানিং নৈতিকতার ঘাটতি দিনের আলোর মত পরিস্কার সেহেতু পরীক্ষা নিজ নিজ কলেজে হলেও গার্ড হবেন অন্য কলেজের শিক্ষকগণ।
এর পরেও আরও কোন ব্যাবস্থা থাকলে আমরা নিতে পারি এবং নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। পরিশেষে বলব যেকোনো মুল্যেই এই পরীক্ষা হোক এবং আমাদের ব্যচের মত ২০২০ ব্যচকেও বলিদান থেকে বিরত থাকুক আমাদের সমাজ।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, ফুড এন্ড নিউট্রেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।