ঐতিহ্য ও গৌরবের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ঐতিহ্য ও গৌরবের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

তাসনিমুল হাসান প্রান্ত


ঐতিহ্য ও গৌরবের চার দশক পেরিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এখন আন্তর্জাতিকীকরণের স্বপ্ন লালন করছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্যবর্তী শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুর নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ। নানা চাড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ৪০ বছর পেরিয়ে ৪১ বছরে পদার্পণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করে আসছে।

ইসলামী বিদ্যাপীঠ স্থাপনের উদ্যোগ অনেক প্রাচীন । সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের পটিয়ায় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ফান্ড গঠন করেন। ১৯৩৫ সালে মাওলানা শওকত আলি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৪১ সালে মাওলা বক্স কমিটি ‘ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক লার্নিং’ প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৪৬-৪৭ সালে সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দীন কমিটি এবং ১৯৪৯ সালে মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ কমিটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করে। ১৯৬৩ সালের ৩১ মে ড. এস. এম. হোসাইন-এর সভাপতিত্বে “ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন” গঠন করা হয়।দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এটিই ছিল স্বাধীন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম ঘোষণা।

এরপর ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এ বারীকে সভাপতি করে সাত সদস্য বিশিষ্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে রিপোর্ট পেশ করে।পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশে ৩টি অনুষদ, ১৮টি বিভাগ, ৩টি ইনস্টিটিউট ও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

তবে ১৯৭৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে। এসময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি কুষ্টিয়া থেকে গাজীপুরের বোর্ড বাজারে স্থানান্তর হয়। পরে ১৯৯০ সালে সরকারি আদেশে আবার কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। গাজীপুরে থাকা অবস্থায় ১৯৮৫ সালে দু’টি অনুষদের অধীনে ৪টি বিভাগে ৮ জন শিক্ষক ও ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।১৯৯২ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়ার পিটিআই এবং প্যারামেডিক্যাল ভবনে অস্থায়ী কার্যক্রম চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরের সবুজ চত্বরে মাটির সড়ক আর সবুজ গাছপালার মধ্যে গড়ে ওঠে দু’টি ভবন। ভবন দু’টি নিয়েই শুরু হয় মূল ক্যাম্পাসের কার্যক্রম।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি অনুষদ, ৩৪টি বিভাগ, একটি ইনস্টিটিউট এবং ১টি ল্যাবরেটরি স্কুল রয়েছে। এর অধীনে রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী, ৪১০ শিক্ষক, ৪২৫ কর্মকর্তা, ২০৯ সহায়ক কর্মচারী এবং ১৯০ সাধারণ কর্মচারী। এমফিল কোর্সে ২৮৫ জন এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে ৩৫৭ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে গবেষণাকর্মে নিযুক্ত রয়েছেন। এ পর্যন্ত ৬২১ জনকে এমফিল ডিগ্রি এবং ৪২১ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে।

১৭৫ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে ২টি প্রশাসনিক ভবন, চিকিৎসা কেন্দ্র, দেশের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। এছাড়াও রয়েছে ১টি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তন, সমৃদ্ধ ও আধুনিক লাইব্রেরী, উপাচার্য বাংলো, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক কোয়ার্টার, ছেলেদের জন্য ৫টি এবং মেয়েদের জন্য রয়েছে ৩টি আবাসিক হল। এছাড়া এখানে রয়েছে ক্যাম্পাস ভিত্তিক বৃহত্তম শহীদ মিনার, ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ মুর‌্যাল, একুশে কর্নার, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার, মুক্তবাংলা, স্মৃতিসৌধ এবং বঙ্গবন্ধু চেয়ার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এন এ মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী এবং বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. হারুন উর রশিদ আসকারী।

শতভাগ আবাসিকতার তকমা গায়ে নিয়ে বেড়ে উঠলেও গড়ে তুলতে পারেনি সম্পূর্ণ আবাসিকতা। প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও সে স্বপ্ন এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে।তবে বর্তমান উপাচার্যের আশ্বাসে আশায় বুক বেঁধেছেন শিক্ষার্থীরা। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর অবহেলিত এ প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন ইতোমধ্যে বরাদ্দ পেয়েছে ৫৩৭ কোটি টাকার মেগা প্রোজেক্ট।প্রোজেক্টে ৯টি ১০ তলা ভবন ও ১৯টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে স্বপ্ন পূরণের দিকে অনেক ধাপ এগিয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে।তবে অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। অল্প সময়েই ভর্তিচ্ছুদের পছন্দের তালিকায় ঢাবি,জাবি,জবি,রাবির পরেই এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই প্রতিবছরই বাড়ছে ভর্তি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেও স্নাতক সম্মান শেষেই চাকরির বাজারে অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি বিসিএস। আর সেই বিসিএস পরীক্ষায়ও তাদের সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়।

দেশের প্রায় সব সেক্টরেই এই সাহসী যোদ্ধারা দেশের সেবার কাজে নিয়োজিত আছে। প্রতি বছর আবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে দেশের শান্তি, উন্নয়ন ও মান রক্ষার কাজে নিয়োজিত হচ্ছে আর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।

এছাড়াও জাপান, কোরিয়া,চীন, নিউজিল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষকতা সুনামের সাথে করে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তজার্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাফল্য দেখাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণার সূতিকাগার। গবেষণা উপকরণের এবং সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা থাকলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটি হাঁটি পা করে সে দিকেই পথ চলছে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ বিভাগে এমফিল, পিএইচডির কার্যক্রমে প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ শাহীনুর রহমান বিগত কয়েক বছর ধরে এক গবেষণায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে তালের শাঁস ও ওলকচু এ বিষয়টি প্রমাণ করেন । অনুষদ বা বিভাগগুলোও নিয়মিত গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত করছে, যা তরুণ গবেষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করছে।

বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য প্রশংসনীয়। সময়ের আবর্তে ক্ষমতার পরিবর্তনে বাংলাদেশী নিয়মে ভিসির পালাবদল ঘটছে। প্রতিবছর ২ হাজারের ও অধিক শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েশন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। আবার প্রায় দুই হাজার চারশত মত শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বপ্নবোনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একদিন বিশ্বের বুকে স্বগৌরব ও ঐতিহ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হবে বিশ্ব সেরা কোনো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অথবা কলামিস্ট ।


লেখকঃ তাসনিমুল হাসান প্রান্ত
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া।


সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment