কেমন আছে উপকূলের শিক্ষার্থীরা?

রিফাত নূর রাব্বি


বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরেছিলাম গত ১৭ই মার্চ, তখন ভেবেছিলাম এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ফিরতে পারিনি, আর কবে ফিরতে পারবো সেটাও অনিশ্চিত।

সরকার করোনা ভাইরাসের জন্য শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে আর সব প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খুলছে ৩১শে মে থেকে। স্বল্প ছুটিতে বাড়িতে আসার পর শুরুতে ভালো লাগলেও কিছুদিন পর সেটা দীর্ঘ ছুটিতে বন্দীদশায় পরিণত হয়।

বর্তমানে দুর্ভোগ,দুর্দশা ও হতাশা নিয়ে বেচে থাকার চেষ্টায় দিন কাটছে। কারণ আমার বাড়ির অবস্থান সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে,যা আম্ফান ঝড়ের ফলে এখন বন্যায় কবলিত। ছুটির প্রথম দিকে বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়ির সবাই নিয়ম মেনে হাত ধুয়া, মাস্ক পরা ও মুটামুটি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতো কোভিড-১৯ এর কারণে।

এমনকি বাড়ির পাশে অল্পসময় বাইরে বের হলেও দেখতাম গ্রামের মানুষ, মাস্ক পরা অবস্থায় বাইরে বের হয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি বাজার হওয়ায় তখন দেখেছি করোনার জন্য অধিকাংশ সময় বাজার জনশূন্য ও কোলাহল মুক্ত।

কোভিড-১৯ কে মার্চের মাঝামাঝি থেকে মে’মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত, আমাদের অঞ্চলের মানুষ জহির রায়হানের “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসের কলেরা মহামারীতে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ সংক্রামিত হয়ে মারা যায় তেমনটি ভেবে হয়তো বাইরে বের হতোনা, একারণে গ্রামে ছিল দিনরাত নিস্তব্ধ নিরবতা। ক’দিন বাদেই সরকার লকডাউন শিথিলতা দিলে ঈদের বাজারে জনসমাগম দেখে অবাক হই, তখনো করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভীতি এ এলাকার মানুষের মাঝে ছিল, এরইমধ্যে ২০ই মে আসে উপকূল অঞ্চলের জন্য অশনিসংকেত, যা বারবার উপকূলীয় এলাকার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। এবার আসে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, ইতোপূর্বে সিডর,আইলা,ফণি,বুলবুল ইত্যাদি উপকূলের সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ক্ষতি ও বন্যার সৃষ্টি করেছে।

এই করোনাকালে ‘ঘূর্ণিঝড় আম্ফান’ ক্ষতির পরিমাণে অতীতের সব রেকর্ডকে যেন ছাড়িয়ে গেছে উপকূল অঞ্চলকে। করোনার ছুটিতে শিক্ষার্থীরা বাড়ি থাকলেও করোনা কে ভূলে গেছে তারা। এখানকার শিক্ষার্থীরা করোনাকে এখন ভয় পায়না যেমন ভাবে ভয় পায়না ঘূর্ণিঝড় কে। এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের ভয় এখন একটাই, সেটা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাবার ভয়।

এই অঞ্চলের মানুষের হাজারো মাছের ঘের তলিয়েছে বাধ ভাঙ্গা বন্যায়, যা ছিল তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। রাস্তার ওপর খোলা আকাশের নিচে বসবাস যেন এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি। প্রতিদিন বাধঁ বাধার চেষ্টা করে যাচ্ছে এ অঞ্চলের হাজার-হাজার মানুষের সাথে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। জনগণের দাবি সরকারের কাছে এখন একটাই টেকসই বেড়িবাঁধ, কেউই এখন আর ত্রাণ চায় না।

দেশে মহামারী করোনা পরিস্থিতি দিনদিন আরো ভয়াবহ হচ্ছে, সব শিক্ষার্থীরা যখন চিন্তা করছে কবে খুলবে তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তখন উপকূল এলাকার শিক্ষার্থীরা চিন্তা করছে কবে শেষ হবে তাদের বাড়িতে জোয়ারভাটার পানি ওঠানামা। ইতোমধ্যেই খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ওইসব এলাকার অসহায় মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছে তারা।

হাজারো শিক্ষার্থীদের পরিবার এই করোনাকালে পানি বন্দী জীবনযাপন করছে। পড়াশোনার থেকে লোনা পানির সাথে সংগ্রাম করে বেচে থাকায় অনেকের কাছে এখন প্রধান। করোনা-আম্ফান হয়তো উপকূলের অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের ইতি টানবে,তার কারণ তাদের পরিবারের দারিদ্রতা। উপকূলের শিক্ষার্থীদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে আম্ফান, যার ক্ষতির ফলাফল করোনা থেকে কম।

বিশ্বের গবেষক বা শিক্ষার্থীরা যখন ক্ষুদ্র অনুজীব সংক্রমণ ঠেকাতে, অনুজীবর জিনোম সিকুয়েন্স বের করতে ব্যস্ত ঠিক তখন উপকূল এলাকার শিক্ষার্থীরা কয়েক কিমি লম্বা বেড়িবাঁধ বাধতে চেষ্টা করছে দিনরাত।

এমন পরিস্থিতির দ্রুত নিরসন হোক এটাই প্রার্থনা আর উপকূলের শিক্ষার্থীরা ফিরে পাক তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।


লেখকঃ রিফাত নূর রাব্বি, শিক্ষার্থী, সাতক্ষীরা।

Scroll to Top