চিরযৌবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সানজিদ আরা সরকার বিথী,ঢাবি প্রতিনিধি


বাঙালির সকল আন্দোলনের প্রানদাতা, স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যের জোগানদাতা, বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম কান্ডারী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত চিরযৌবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

যুগে যুগে মানবতার কাতরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মেধাবীদের তীর্থস্থানে পরিনত হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণায় কোণায় যেন ইতিহাসের রঙিন দেয়াল দোলা দেয়।

দেশের বহুপন্ডিত, জ্ঞানীগুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদের জন্ম দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শেখ মুজিবুর রহমান,ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস,বুদ্ধদেব বসু,হুমায়ুন আহমেদ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুনীর চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, জাহানারা ইমাম, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাসহ অসংখ্য বরেন্য ব্যক্তিত্বের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার অন্যতম কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। সকল আন্দোলনের নেপথ্যে মূল কারিগর হিসেবে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডাকসু।১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২ এর শিক্ষা রাজনীতি, ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার ডাকসু।

১৯২১ সালের ১ জুলাই ৩ টি অনুষদ ১২ টি বিভাগ,৬০ জন শিক্ষক ৩ টি হল এবং ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বর্তমানে ১৩ টি অনুষদ, ৭৭ টি বিভাগ, ১১ টি ইন্সটিটিউট, ১৮ টি আবাসিক হল এবং ৫১ টি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে; যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০এবং শিক্ষক প্রায় ২০০০ এর মত।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।

বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ঢাকার স্থানীয় মুসলিম নেতারা বিশেষ করে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ।

১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০।

সৃষ্টির শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। কলকাতার তৎকালীন একটি শিক্ষিত মহল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে।

১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ, আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং গৌরব কিছুটা মলিন হলেও এখনো মধুর ক্যান্টিনের চায়ের উত্তাপে উদ্বেলিত হয় রাজপথ।অপরাজেয় বাংলা সাক্ষ্য দেয় দাঁড়িয়ে আছি বাঙালি জাগরনের প্রতীক হয়ে।রাজু ভাস্কর্য স্মরন করায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো লক্ষ লক্ষ রাজুদার আত্মত্যাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে জাতীয় শহীদ মিনার যেন বর্নমালার রক্তিম প্রদীপ হয়ে জ্বলজ্বল করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ১০০ তম বছরে পদার্পণ যেন সকল ত্যাগ, তিতিক্ষা, আন্দোলন প্রতিরুপ হয়ে উঁকি দিচ্ছে।

Scroll to Top