পৃথিবীর বুকে আবারও নতুন সূর্য উঠবে

তাসফীর ইসলাম (ইমরান)


এই অন্ধকারের ঘোর অমাবস্যা কেটে আবারও এই পৃথিবীর বুকে উদিত হবে সেই সোনালি উষা। এই মৃত্যুর মিছিল, এই অন্তঃসার নিরাবতা একদিন আর থাকবে না, কেটে যাবে এই অলিখিত লণ্ডভণ্ড মৃত্যুপরী সীমাহীন মৃত্যুছোবল। কেটে যাবে অন্ধকার। এই আসায় পুরোবিশ্ব আকুল হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি- ইদানিং প্রকৃতি নতুন রূপে হাজির হয়েছে পৃথিবীর সামনে। এতদিনকার বিশ্বায়নের অকল্যাণে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশ্বাস নিতে থাকা বায়ুমণ্ডল আজ আবারও দূষণ মুক্ত হতে শুরু করেছে।

হিমালয়ের চূড়া নাকি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলরাশি আবার গাঢ় নীল রঙ ধারণ করতে শুরু করছে, আকাশে মেঘেদের দলও আরও শ্বেতশুভ্র হয়ে উঠছে, অভয়ারণ্যে বন্য পশু-পাখি-প্রাণীরও অবাধ বিচরণ শুরু হয়েছে, প্রকৃতি আবার যেন প্রাণ চাঞ্চল্য খুঁজে পেয়েছে নতুন করে। এর কারণ শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস। গল্পটা কিন্তু বেশ মজার- ছোট্টবেলায় পড়া ঈশপের গল্পের মতো।

একবিংশ শতাব্দীর নতুন প্রজন্ম আমরা। মহামারির গল্প শুধু ছবি, গল্প, কাব্য ও রূপকথায় শুনেছি। আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি। দেখিনি মুক্তিযুদ্ধও। শুধু পূর্ববর্তী প্রজন্মের বাবা, দাদুর কাছে যুদ্ধের শাণিত চেতনার গল্প শুনেছি, পাঠ্যবইয়ে পরেছি আর বারবার শিহরিত হয়েছি এক গৌরবমাখা অনুভবে।

যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাভাবে নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার যুদ্ধের গল্পের আঁচও কিছুটা পেয়েছি বিভিন্ন শিল্প, সাহিত্যের চিত্রে। কিন্তু এবারই প্রথম আমাদের প্রজন্ম মহামারিকে দেখল, অনুভব করল অদ্ভুত এক রহস্যময় যুদ্ধকে।

এ যুদ্ধ এক অদ্ভুত অদেখা রহস্যময় শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞানীরা এই শত্রুর নাম দিয়েছেন কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে এর উৎপত্তি। ভাবতে অবাক লাগে ভেন্না ফলের মত দেখতে কাঁটা যুক্ত এই ক্ষুদ্র অদেখা জীবাণুটির কি চরম শক্তি যে, এক নিমিষে কাবু করে ফেলল মানব জাতিকে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন শুধু বিশ্বব্যপী আক্রান্ত আর মৃত্যু হার জরিপে ব্যস্ত।

কি অসীম ক্ষমতায় করোনা এক তুড়িতে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ভয় দেখিয়ে ঘরবন্দি করল সমগ্র পৃথিবীকে! পৃথিবীর মানুষ নতুন কিছু শব্দকে দৈনন্দিন জীবনের অভিধানে যুক্ত করল- কোয়ারেনটাইন, লকডাউন, সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্সিং। জীবনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার কত কায়দা কানুনও রপ্ত করলাম। পরিচ্ছন্নতা, নিয়মমাফিক জীবনযাপন, পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্ব- অনেক কিছুই শেখালো ‘করোনা’।

তবে আমি যদি করোনা নামের এই ক্ষুদ্র জীবাণুকে প্রকৃতি প্রেরিত এক রহস্যজনক মারণাস্ত্র হিসেবে দেখি, সেখানে করোনা অনেকাংশে সার্থক- প্রকৃতির পক্ষে মানুষের ক্রমবর্ধমান অহমিকাকে ধূলিসাৎ করতে। করোনার আক্রমণে, আতঙ্কে পুরো বিশ্ব হয়তো কাঁপছে। অনেক মানুষের জীবননাশের কারণও হয়েছে এই জীবাণু। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই ভাইরাস মনুষ্যজাতিকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। মৃত্যু আতঙ্কের কাছে দেশ, জাত, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, বিত্ত সব যে ঠুনকো- করোনা দেখিয়ে দিল।

মানুষ এখন আপন জীবন প্রার্থণায় ঘরবন্দি। নিজেদের কৃত পাপগুলোকে বিচার করতে শিখছে। সৃষ্টিকর্তা আর প্রকৃতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। বোধের কাছে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে অনেক মানুষের। অনেকের মানবতার পরশে পাশে থাকা অসহায় হতদরিদ্র দুঃস্থ মানুষগুলো একটু হলেও সাহস পাচ্ছে।

সামাজিক দুরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, এতসব সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে এবং তা মেনে প্রতিটা মানুষ এখন গৃহবন্দি হয়ে অবরুদ্ধ সময় পার করছে শুধুমাত্র ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিহতের চেষ্টায় এবং ইতিবাচকভাবে যদি দেখি মানুষ যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর এই যুদ্ধে নিরাপদ দূরত্ব রেখেও ঠিকই কিন্তু একসঙ্গে লড়ছে। পৃথিবীকে সুস্থ করতে এখন এই মুহূর্তে সামগ্রিকভাবে সমবেত চেষ্টার বিকল্প নেই। আমরা কেউই একা বাঁচতে পারি না, পারব না।

আমি সুস্থ থাকলেই আমার চারপাশটা সুস্থ-সুন্দর থাকবে। এই যে মানবতার মায়ায় ভালোবাসার জাল ছড়াতে শুরু করেছে তাতে মনে হয় না করোনা আর বেশিদিন বিরক্ত করবে পৃথিবীকে। খুব শীঘ্রই হয়ত অন্যসব ভাইরাসের প্রতিষেধকের মতো এরও প্রতিষেধক তৈরি হবে। করোনা নামের ভাইরাস হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানবজাতির আতঙ্কের ইতিহাস থেকে। তবে মহাকালের পাতায়, শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায় হয়তো করোনার পায়ের গভীর দাগ থেকে যাবে।

আমি বিশ্বাস করতে চাই, করোনা মনুষ্যজাতির চেতনায় যে পরিবর্তনটা এনে দিয়ে গেছে, সেটা সমুজ্জ্বল অটুট থাক। পৃথিবী মানবতার মায়ায় আবারও সুন্দর হোক। আবারও পৃথিবীতে উদিত হোক সোনালি উষা। একটা মহামারির আতঙ্ক থেকে অন্তত এই শিক্ষাটা ধারণ করুক মানবতা।

এখন সকলের একটাই আশা। আবারও ফুল ফুটবে, পথ শিশুরা হাসবে, অরণ্য মাঠ ফুলে ফলে সুজলা সুফলা হয়ে উঠবে, অন্তরে অন্তর মিলাবে সকল মানুষ। স্বপ্নের এক নতুন ডাক নিয়ে আবারও উদিত হবে পূর্ব আকাশে সেই নতুন শান্তির সোনালি উষা।
লোকারণ্যে আবারও একদিন ভরে উঠবে শহড়, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা আর অগনিত জনপদ।

এখন খালি হয়ে যাওয়া মোড়ের সেই চায়ের দোকানটা আবারও লোকারণ্য হবে সন্ধ্যার পরে কোনো এক আড্ডায়। বেঁচে থাকার তাগিদে লক্ষ-কোটি শ্রমিক আবারও একদিন ফিরবে নিজ নিজ কর্মস্থলে। আবারও সকল দূরবর্তী গাড়ি, ট্রেন চলবে।

আবারও শুনতে পারবো-

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?

একদিন জনসমাগমে ঈদ,কোরবানি ও পূজার সময় এ শহরে ট্রেনের টিকিট কেটে একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে। সেদিন পরাজিত হবে করোনা। সেদিন পৃথিবীর বুকে নতুন এক সূর্য উঠবে।

আজ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া নদীতে আবারও কল্লোল তুলে লঞ্চ, জাহাজ, স্টিমার চলবে।
আবারও সন্ধ্যে হলে লঞ্চ টার্মিনালে সোনা যাবে – (ঢাকা-বরিশাল, বগা-পটুয়াখালী) লাইনের সব থেকে বড় জাহাজ। ভোরে ভোরে ঢাকা, ভোরে ভোরে পটুয়াখালী। কার জাহাজে কে বেশি লোক তুলবে তা নিয়া চলবে মিছিল।

আবারও নতুন করে স্বপ্ন বুনবে ভালাবাসার (বা সা ই)। আবারও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে নতুন ড্রিম-মেকার তৈরির কারখানা। কাকে পিছনে ফেলে পরিক্ষার খাতায় কে ফাস্ট হবে তা নিয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিনরাত পড়াশোনার মিছিল চলবে। স্কুলের শিক্ষার্থী একদিন অনুপস্থিত থাকলে, ক্লাসে পড়া না পারলে আবারও কান ধরিয়ে দাড়া করিয়ে রাখবে শিক্ষক।

আবারও ঘাসফুলের মতো রঙিন হয়ে উঠবে খেলাধুলার মাঠ। শুরু হবে আন্তর্জাতিক প্রতি ম্যাচ, ঘরোড়া লীগ, আইপিএল, বিপিএল, বিগ-বস, অলিম্পিক, শুরু হবে কোপা-আমেরিকা, শুরু হবে সবার মনোমুগ্ধকর খেলা ক্রিকেট ও ফুটবল বিশ্বকাপ। আবারও গ্যালারির প্রতিটি কোনায় কোনায় দর্শকের সমাগম দেখা যাবে। ধোঁয়াশার মধ্যেও দর্শকদের অহরহ দেখা যাবে প্রতিটি স্টেডিয়ামে।

গানের আড্ডায় আবারও একদিন প্রান ফিরে পাবে সকলের প্রিয় ক্যাম্পাসগুলো। রাত ১ টায় শোনা যাবে লাল- কমলের পাড়ে বসে কোনো এক নতুন রমন গেয়ে উঠছে- ‘ঘুম ভালোবাসিরে আমি ঘুম ভালোবাসিরে’। অথচ সে ভোর চলে আসলেও ঘুমায় না।
নদীতে আবারও জোয়ার আসবে।

সেই নদীর পারে কিংবা কোনো এক মাঠের কোনে বসে জোছনা দেখতে আবারও একদিন মধ্যরাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াবে হাজারো হিমু (রমন-রমনীরা)। রমন হয়তো রমনীর হাত ধরে মাঝপথে দারিয়ে গেয়ে উঠবে-

নির্মলেন্দ্র গুনের গাওয়া-

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷
তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর।

বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷
নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷
তুই কেমন করে যাবি?

একদিন আবারও নতুন সূর্য উঠবে , সকাল দুপুরগুলো রৌদ্রময় হয়ে রবে। একদিন অন্ধকার কেটে সারা বেলা পৃথিবী সবার প্রিয়বন্ধু হবে। একদিন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবো করোনার ঘোর অমাবস্যা কেটে পৃথিবীর বুকে নতুন এক ভিন্ন সোনালি সূর্য উদিত হয়েছে।

কারন মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে। করোনার এই আঁধার কেটে সুদিন আসবেই। সেদিনের অপেক্ষায় হলেও অন্তত ঘরে থাকি সবাই। নিরাপদ হোক আগামীর দিনগুলো- এই স্বপ্নটাই কিলবিল করছে চোখের পাতায়। প্রকৃতি আবার হাসবে। আবার পৃথিবীর বুকে নতুন সূর্য উঠবে। আমরাও একসঙ্গে সবাই হাসব। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবো খোলা আকাশের নিচে।

আবারও কোনো নাছোড় বোকা প্রেমিক,
পথের পাশে করবে অভিমান।
দল পাকিয়ে স্কুলের কচিকাঁচা
বেসুর গলায় গাইবে চেনা গান।

আবারও কোনো ইতালিয়ান পাড়ায়
রাস্তা জুড়ে বাঝবে ভায়োলিন!
বারও কোনো স্তব্ধ শহরতলি
ব্যাস্ত হয়ে ছুটবে সারাদিন।

আবারও কোনো নাটক শো এর শেষে
রোলের দোকান, উপচে পরা ভীড়
দূর-পাল্লার ট্রেনের টিকেট কেটে
হঠাৎ কোনো শান্ত-নদীর তীর।

সেদিন প্রেমের গল্প হবে খুব
পলাশ ফুটবে ভরবে চারিদিক।
সেদিন সবাই নামবো মোরা পথে
‌পৃথিবী, তুমি সামলে নিতে পারবে তো ঠিক!!

আবারও একদিন এই পৃথিবী হাসবে, হ্যাঁ! অবশ্যই হাসবে, পৃথিবীকে যে আবারও হাসবে। হাসতে হবেই!! সেই একটা আশার আলো বুকে রেখে নতুন ভোরকে স্বাগত জানাতে চাই। সেই পর্যন্ত সবাই ঘরে থাকুন,সুস্থ থাকুন।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ সার্ভে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়।

Scroll to Top