বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা: বৈরী পথের সঙ্গী হোক প্রেরণা

আলমামুন সরদারঃ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা জীবনটাকে নতুন করে বদলে দিতে শেখায়। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটার অন্যতম আরো একটা পদক্ষেপ। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেই তখনি জীবনের লক্ষ্য হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকর সকল কর্মকাণ্ডকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার।

করোনার সংকটকালীন মূহুর্তের ছবিটা সকলের হৃদয়ে ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছে। প্রায় তের লক্ষ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর অটো পাসের মাধ্যমে পাস করাতে বাধ্য হয়েছে সরকার ।কিছুদিনের মধ্যে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে স্বপ্নপ্রবণ এসব শিক্ষার্থীদের।

সবার ভিতরে হতাশা বিরাজ করছে কিভাবে এই যুদ্ধটাকে জয় করবো। অজপাড়া গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের এই কঠিন নির্মমতার সাক্ষী হতে হয় তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। আজকে এমনই হারতে হারতে জয়ী হওয়ার একটা গল্প শোনাবো।

আমি নবম শ্রেণীতে উঠতেই বাবা হটাৎ বলে ফেলল, আর লেখাপড়া করতে হবে না। চল আমার সাথে মাছ ধরতে যাবি। অবাধ্য হওয়ার সাহস ছিল না বলে, ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম। কিন্তু মন সবসময় পড়াশোনাকে বরণ করে নিয়েছিল। মা বাবার পা ধরে সেদিন বলেছিল, আমার ছেলেকে অনেক বড় কিছু করতে হবে। আপনি ওরে মুক্তি দেন। সেদিনই জীবনের গুরুত্ব বুঝেছিলাম। জীবনে কোনদিন স্কুলের বারান্দায় না গিয়েও আমার মা যদি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে, তাহলে আমি কেন পারবো না।

বাবা হয়ত চেয়েছিল আমি যদি সংসারের হাল ধরি তাহলে দারিদ্র্যতার রোষানলের এই সংসারের কষ্টটা লাঘব হবে। হয়ত মহৎ ছিল উদ্দেশ্যটা। কিন্তু আমার মায়ের ছিল আমার প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস আর আস্থা। তখনই বাবা রাগ করে বলেই বসলেন, আমাকে আর পড়াশোনার টাকাকড়ি দিতেই পারবেন না।

জীবনের সকল দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন অন্যের দরজাই পরামর্শের হাত পাততে হয়। তাই শিক্ষকের পরামর্শ মতাবেক নাইট ডিউটির কাজটা বেছে নিয়েছিলাম। দিনের বেলা বেশীরভাগ সময় নদীতে জালটানা আর রাতের বলা ঘেরে নাইট ডিউটি করে কোন মতে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে রেজাল্ট বের হলো। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫.০০ পেয়ে পাস করলাম। এটাই ছিল আমার মায়ের পুরোটা জীবনের আনন্দের অন্যতম একটা মূহুর্ত।

কিন্তু আমার কপালে ছিল চিন্তার ভাজ। মনে করেছিলাম এইচএসসি বুঝি আর পড়া হবে না। আমি আমার জীবনে বার বার আমার মায়ের আত্মবিশ্বাসের কাছে পরাজিত হয়ে গেছি। যখনি দিশেহারা হয়ে যেতাম মা কোন না কোন উপায় বাতলে দিতেন। রেজাল্ট ভাল হওয়ার জন্য সবাই বলেছিল শহরের ভালো কলেজে ভর্তি হতে। আমি সাহস করতে পারি নি সেদিন। আমার জীবনে আমার সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করিনি। আর আমার সিদ্ধান্তের মূল ভিত্তি ছিল আমার মায়ের দোয়া।

আমার সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে ভর্তি হয়েছিলাম গ্রামের একটা কলেজে। তার পরের ঘটনার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। বাড়ি থেকে খবর এলো বাবা আমার পরিবার ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি অন্য জায়গায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। কলেজের প্রথম মাস মায়ের জমানো টাকা দিয়ে চলার পর এমন ঘটনা শোনায় হতাশা আঁকড়ে ধরেছিল। ছোট তিন বোনের লেখাপড়া, পরিবারের সমস্ত ব্যয়ভার নিজের কাঁধে চড়ে বসেছিল।

বাড়িতে এসে মাটির কাজ করতাম সারাদিন। এমনভাবে বেশ কয়েকমাস পার হয়ে গেল। হটাৎ কলেজের এক বন্ধু ফোন করে খবর দিল তার বাড়ির পাশে একটা ছেলে রাখবে। তাদের বাড়িতে থাকার উদ্দেশ্যটা ছিলো তাদের ছেলেটিকে মানুষ করা।বিনিময়ে আমি পাবো তিন বেলা খাবার আর থাকার জায়গা। মা জোর করে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল সেদিন। কলেজ করার পাশাপাশি বাকি সময়টা কাজও করতাম। আর তাদের ছেলেটিকে পড়াতাম। মনে হচ্ছিল জীবন্ত লাশ আমি। না পারছি মরতে, না পারছি বেঁচে থাকতে। বাড়ির কথা মনে করতেই চোখ দিয়ে নির্গত অশ্রুধারা গুলো স্বাক্ষী হয়ে থাকবে আজীবন।

ছোট একটা ঘরে থাকার জায়গা হয়েছিল আমার। আমার সাথে থাকতো তাদের বাড়ির রাখাল বালক। সবার কথা অমান্য করলেও সে কোনদিন আমার কথা অমান্য করতো না। মাঝে মাঝে কলেজ শেষ করে তার জন্য মাঠে ভাতও নিয়ে যেতাম। কিছুদিনের মধ্যে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তারা আমাকে পাঁচ জন ছাত্র ছাত্রী যোগাড় করে দিয়েছিল। সকালে ভোরে উঠে, প্রায় সময় সবজির বোঝা মাথায় নিয়ে আড়ং যেতাম । তারপর গোসল করে কলেজ করা, কলেজ শেষে ছাত্র পড়ানোর ভিতরেই ছিল আমার জীবনের সীমাবদ্ধতা। পড়ানোর টাকাগুলো বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। এভাবেই চলে জীবনের প্রথম সংগ্রাম।

দেখতে দেখতে চলে আসলো এইচএসসি পরীক্ষা। পস্তুতি ভাল না থাকায় প্রথমে ভেবেছিলাম পরীক্ষা দিব না। কিন্তু মায়ের কথা মনে স্থান দিয়ে কোনমতে পরীক্ষা গুলো দিয়ে বাড়ি চলে আসি। কাজ করতে থাকি রীতিমতো। হটাৎ এক কাকুর মাধ্যমে জামাল ভাইয়ের (যিনি ছিলেন আমার জীবন বদলে দেওয়ার অন্যতম এক নায়ক, খুবিতে তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন, আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি পেয়েছি তার থেকে) সাথে পরিচিত হই। তিনি শুনেছি খুলনাতে কোচিং করাতেন। তিনি আমায় বললেন, তুমি ভর্তি পরীক্ষা দাও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তাঁর থেকে সব বিস্তারিত জেনে মাকে বললাম। মা আমাকে তিন হাজার টাকা দিয়ে বলেছিল, এইটা নিয়ে তুমি খুলনা চলে যাও।

আমি মায়ের কথামতো খুলনাতে আসি। থাকার কোন জায়গা ছিলনা। এক বন্ধুর সাথে কথা বলে তার কাছে কিছুদিন থাকব বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু আমি পৌঁছে ফোন দিতেই তার নম্বর বন্ধ পাচ্ছিলাম। সেদিন পার্কের পাশেই বসে রাতটা কেটে গিয়েছিল। খুব ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। জীবনে প্রথমে শহরে আসা। হয়ত এটা অবিশ্বাস্য হলেও মেনে নিতে হয়েছিল। পরদিন সকালে বন্ধুকে কল করে তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। গ্রামের সেই জামাল ভাইকে ফোন দিয়ে কান্না করেছিলাম আর বলেছিলাম, “ভাইয়া আপনি যদি আমাকে সারাদিন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন, তবে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকব। কিন্তু আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য যদি একটু পড়াতেন!” তিনি আমাকে বিনা টাকায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জীবনে যতোদিন বেঁচে থাকবো এই মানুষটিকে ভুলতে পারবো না।

বন্ধুর বাসায় রাতে থাকতাম আর দিনে পার্কে বসে পড়তাম। নিজেকে অসহায় লাগতো। মনে হতো পার্কে শুয়ে থাকা পাগল যেন আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। ওর যেমন থাকার জায়গা নেই, আমারও থাকার জায়গা নেই। বন্ধুর বাসায় থাকার জায়গা বেশিদিন কপালে জুটলো না। আমার থাকতে দেওয়ায় তার রুমমেট প্রতিদিন তাকে কথা শুনাতো। তারপরে চলে গেলাম আমার ছোটমামার মেসে। সেখানেও একই পরিস্থিতি। হটাৎ দেখা হলো এক পরিচিত কাকার সাথে। তিনি আমাকে একটা টিউশনি দিয়েছিলেন। তিনি আমার থাকার জায়গাও দিয়েছিলেন সেদিন। সেদিন থেকে টিউশনে যাওয়ার পরে আরো দুইটা টিউশনি পাই। নিজেকে নতুন করে গোছাতে থাকি। কাকার মেসে একটা সিটও নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করি।

পারিবারিক অশান্তি আর বাস্তবতার নির্মমতায় এইচএসসি রেজাল্টটা খুবই খারাপ হয়েছিল। জিপিএ- ৪.০৮ পেলাম। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মানবিক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিবো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম পূরণ করেছিলাম। কিন্তু কোন সাবজেক্ট পাইনি। হতাশায় জীবন কাটছিলো রীতিমতো। ভেবেছিলাম নিজেকে গোছাতে হলে সবকিছুর বন্ধনকে কিছুদিনের জন্য ভুলে থাকতে হবে। তাই বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে মার ফোন আসতো। আর আমাকে দেখার জন্য সে প্রচুর কান্না করত। সবকিছুকে সহ্য করতে পারতাম কিন্তু মায়ের হৃদয়ের কান্নার ধ্বনি আমার হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিত। নিজেকে কেমন যেন স্বার্থপর লাগত। কিন্তু হার মানি নি কখনো। অনেকগুলো টিউশন করে আসতে রাত এগারটা বেজে যেত। তার থেকে বাড়িতে টাকা দিতাম আর নিজের পড়াশোনা করতাম।

কিছুদিনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা চলে আসল। জগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ না জানা অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একজন ছাত্রই কেবল জানে একাকী ভর্তি পরীক্ষার পিছনে দৌঁড়ানোর কঠিন নির্মমতা। সেই কষ্টগুলো মনে করলে আজও চোখ দিয়ে অজান্তে পানি গড়িয়ে পড়ে। ঢাবি , জবি , রাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ঢাবির ইংরেজিতে ফেল আসলো। জবির ফলাফল পেলাম না। মনে হয়েছিলো বৃষ্টি ভেজা শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে রোলটা ভুল করে এসেছিলাম। রাবির ফলাফলে বিষয় এসেছিল ইসলামের ইতিহাস।

পরবর্তীতে পরীক্ষা দিলাম খুবি আর বশেমুরবিপ্রবিতে । বশেমুরবিপ্রবিতে পেলাম ইংরেজি আর আইন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলো প্রিন্টমেকিং ডিসিপ্লিন। প্রিন্টমেকিং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধের একটা বিষয় ছিল। তবুও কোন একদিন স্কুলের এক শিক্ষকের মুখ থেকে মা শুনেছিল “Khulna University” এই ইংরেজি নামটা। অন্য কোন কিছুর ইংরেজি উচ্চরণ ঠিক মতো বলতে না পারলেও এটা ভালোভাবে বলতে পারে। তাই মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম । হাসিমুখে বিষয়টিকে মেনে নিয়ে ক্লাস পরীক্ষা সব দিতে থাকি রীতিমতো। পাশাপাশি চলতে থাকে দ্বিতীয় বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। পরীক্ষা দিয়েছিলাম খুবিতে। ফলাফল পেলাম খুবির ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন। সমস্ত কষ্টকে ভুলে গিয়ে খুবিতে ভর্তি হয়ে যায়। জীবনে যতবার হতাশার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছি, আমার মায়ের দোয়া আর আমার প্রতি তার আত্মবিশ্বাস আমাকে ঠিক কোন একটা পথ বের করে দিয়েছে। আমি আজও বলি, ” হ্যাঁ মা, আমি হেরে গেছি, তোমার কাছে আমি পরাজিত “!!

সংকটকালীন সময়ে হতাশায় জীবন কাটাচ্ছে দেশের সমস্ত শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীরা এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যেতে পারে। অনেক মেধাবীরা হারিয়ে যেতে পারে ভয়ে ভীত হয়ে।বিশ্ববিদ্যালয় নামক হরিণটাকে আঁকড়ে ধরতে প্রচেষ্টারত যেসব শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য বলবো জীবনে সংগ্রাম করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করে শত বাঁধাকে অতিক্রম করতে হবে। আল্লাহ কখনো কাউকে নিরাশ করেন না। অনেক অনেক শুভকামনা সকলের জন্য। বৈরী এই পথে সফলতার গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন ধরার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকুক প্রতিটি জীবন।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

Scroll to Top